×

জাতীয়

জাতিসংঘ মিশন ব্যর্থ!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০১:১০ পিএম

জাতিসংঘে নালিশ জানিয়েও কোনো ফায়দা হাসিল করতে পারেনি বিএনপি। অনেকটা ব্যর্থ মনোরথে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বরং বিএনপির বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে রাজনৈতিক মহলে। এদিকে ফখরুলের যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালেই সে দেশের প্রশাসনে বিএনপির পক্ষে লবিস্ট নিয়োগের খবরে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হয়েছে দলটি। জনগণের প্রতি আস্থা নেই বলে বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়ে দেশের সম্মান নষ্ট করেছে বিএনপি এমন অভিযোগ তুলেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। ‘গোপন মিশন’ নিয়ে গত ১১ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে যুক্তরাষ্ট্রে যান মির্জা ফখরুল। দলের অনেক সিনিয়র নেতাও তার এই সফরের খবর জানতেন না। পরে জানাজানি হলে দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, জাতিসংঘ মহাসচিবের আমন্ত্রণে তার সঙ্গে বৈঠক করতে নিউইয়র্ক গেছেন ফখরুল। তবে বাস্তবে ঘটনা ছিল অন্যরকম। জাতিংঘেরই একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ইতিপূর্বে জাতিসংঘে লিখিত অভিযোগ জানায় বিএনপি। এ বিষয়ে একটি বৈঠক আয়োজনের জন্য কমপক্ষে তিনবার তদবির করে দলটি। তারই পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর জন্য বিএনপির একটি প্রতিনিধিদলকে সেখানে পাঠাতে বলে জাতিসংঘ। এটাকেই জাতিসংঘ মহাসচিবের আমন্ত্রণ বলে চালিয়ে দেয় বিএনপি। বিএনপি নেতা ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়ালকে সঙ্গে নিয়ে সংগোপনে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে যাত্রা করেন ফখরুল। লন্ডন থেকে তাদের সঙ্গে যোগ দেন দলের সহআন্তর্জাতিক সম্পাদক হুমায়ূন কবির। তবে সেখানে জাতিসংঘ মহাসচিবের দেখা পাননি বিএনপি মহাসচিব। মহাসচিবের তিন ধাপ নিচের পদ সহকারী মহাসচিব মিরোস্লাব জেনকার সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার বৈঠক করেন ফখরুল। জাতিসংঘে পদমর্যাদায় আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলেরও পরে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বা সহকারী মহাসচিবদের অবস্থান। পদমর্যাদায় জাতিসংঘ মহাসচিবের পরে রয়েছেন একজন উপমহাসচিব। তার নিচে রয়েছেন বর্তমানে ২১ জন আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল। এই আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলদের সহায়তায় রয়েছেন বিভাগভিত্তিক অনেক সহকারী মহাসচিব। মিরোস্লাব জেনকা তাদেরই একজন। অবশ্য জেনকাও নির্ভর করার মতো কোনো আশ্বাসের বাণী শোনাতে পারেননি মির্জা ফখরুলদের। তিনি শুধু এটুকু বলেন, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তারা জবাবদিহিতাপূর্ণ, বিশ্বাসযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য ভ‚মিকা রাখবেন। জেনকার সঙ্গে বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় মির্জা ফখরুলের মন্তব্য থেকেই। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে নিউইয়র্কে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, একদিনের বৈঠকে কি ফল জানা সম্ভব? ফখরুল বলেন, মহাসচিবের আমন্ত্রণে এ বৈঠকে এসেছিলাম। আসন্ন নির্বাচনসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে সরকারের চরম বৈরী আচরণের প্রসঙ্গও স্থান পায় এ বৈঠকে। এ বৈঠক সম্পর্কে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র ফারহান আজিজ হক বলেন, বিএনপির অনুরোধে সহকারী মহাসচিব মিরোস্লাভ জেনকা বিএনপি মহাসচিবকে সাক্ষাৎ দেন। বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মাঝেমধ্যেই সহকারী মহাসচিবের দপ্তর রাজনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে, এটি তার ব্যতিক্রম নয়। জাতিসংঘে ব্যর্থ মিশনের পর ট্রাম্প প্রশাসনে ধরনা দেন ফখরুল। ওয়াশিংটনে বৈঠক করেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিচের সারির কর্মকর্তাদের সঙ্গে। এ বৈঠক সম্পর্কে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র গত শুক্রবার জানান, ক‚টনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। বিএনপির সঙ্গে ওই বৈঠকও তারই অংশ। বাহ্যত মার্কিন প্রশাসনে তদবির করেও ইতিবাচক সাড়া পাননি ফখরুলরা। এদিকে ফখরুলের যুক্তরাষ্ট্র সফর চলার মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনে তদবির চালাতে বিএনপি ওয়াশিংটনে একটি ‘লবিং ফার্ম’ ভাড়া করেছে বলে খবর দেয় রাজনীতিবিষয়ক ম্যাগাজিন পলিটিকো। যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের বরাত দিয়ে গত মঙ্গলবার ওই ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আব্দুল সাত্তার নামে বিএনপির একজন’ গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্লু-স্টার স্ট্র্যাটেজিস’ এবং ‘রাস্কি পার্টনার্স’ এর সঙ্গে চুক্তি করেন, যাতে তারা বাংলাদেশের নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির পক্ষে ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে তদবির করে। অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এ খবরের সত্যতা অস্বীকার করে বিষয়টিকে ‘একটা মহলের অপপ্রচার’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, এ ধরনের ফার্মের আয়-ব্যয়ের বিবরণী জাস্টিস ডিপার্টমেন্টে জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই বিবরণীর ভিত্তিতেই এ প্রতিবেদন প্রকাশ করার কথা জানায় পলিটিকো। যুক্তরাষ্ট্রের এই সাময়িকী হোয়াইট হাউজ, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস, প্রশাসনসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় অর্থের বিনিময়ে তদবিরকারীদের যোগ্যতা, সক্ষমতা এবং কাজের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে নিয়মিতভাবে তা প্রকাশ করে। পলিটিকো লিখেছে, ব্লু-স্টার স্ট্র্যাটেজিস বিএনপির পক্ষে বিভিন্ন বার্তা তৈরি করে তা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে দেবে। এ ছাড়া মার্কিন কংগ্রেস; আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আর্থিক সংস্থা; স্বাস্থ্য, শ্রম, মানবাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা; যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক পলিসি ইনস্টিটিউট; সাবেক কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রদূত; বেসরকারি খাতের প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং প্রবাসীদের কাছে বিএনপির বার্তা পৌঁছে দিতে তারা কাজ করবে। চুক্তি অনুযায়ী এ কাজের জন্য আগস্ট মাসে ব্লু-স্টার স্ট্র্যাটেজিসকে দেয়া হয়েছে ২০ হাজার ডলার। আর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে প্রতি মাসে দিতে হবে ৩৫ হাজার ডলার করে। এর মধ্যে ব্লু-স্টারের সহযোগী রাস্কি পার্টনার্স আগস্টে ১০ হাজার ডলার এবং বছরের বাকি চার মাস ১৫ হাজার ডলার করে পাবে। ব্লু-স্টার স্ট্র্যাটেজিসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কারেন ট্রামোন্টানো সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ছিলেন। ওই ফার্মের চিফ অপারেটিভ অফিসার জন পডেস্টা একসময় ক্লিনটনের একজন জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ছিলেন। পলিটিকোর প্রতিবেদনে ব্লু-স্টারের সঙ্গে চুক্তিতে বিএনপির প্রতিনিধি হিসেবে যে আব্দুল সাত্তারের নাম লেখা হয়েছে তিনি যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কেউ নন বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা। তবে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির একজন নেতা বলেছেন, সাত্তার থাকেন লন্ডনে। দুই মামলার সাজা মাথায় নিয়ে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের সঙ্গেও সাত্তারের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এ বছরের শেষে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দশম সংসদ নির্বাচন বয়কটকারী বিএনপির মহাসচিবের জাতিসংঘ মিশন ও যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপির পক্ষে লবিস্ট নিয়োগের ঘটনা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে। বিদেশি মহলে বিএনপির ধরাধরিকে ভালো চোখে দেখছেন না কেউই। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা এ বিষয়ে বেশি সোচ্চার। যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপির লবিস্ট নিয়োগের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগের নামে নালিশ করতে বিএনপি লবিস্ট নিয়োগ করেছে। চুক্তি অনুযায়ী নিয়োগ ‘ব্লু-স্টার স্ট্র্যাটেজিক’কে আগস্ট মাসে ২০ হাজার ডলার এবং বছরের বাকি মাসগুলোয় ৩৫ হাজার ডলার করে দিতে হবে। বিএনপি এত টাকা কোথা থেকে পেল? এত টাকা লন্ডন থেকে এসেছে। লন্ডন মানে আপনারা বুঝতেই পারছেন ওখানে কে থাকে। ওবায়দুল কাদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে কেন লবিস্ট নিয়োগ করা হলো। আমাদের চাপ দেয়ার জন্য এটা করা হয়েছে। আমাদের শেকড় দুর্বল নয়। আমাদের শেকড় বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের বহু গভীরে। অন্য কারোর চাপে আমরা নতি স্বীকার করব না, আমরা নতি স্বীকার করব বাংলাদেশের মানুষের কাছে। মন্ত্রী বলেন, বিএনপি লবিস্ট নিয়োগ করতে পারে না। লবিস্ট নিয়োগের কী আছে। বাংলাদেশ কি পাকিস্তান, সুদান, সোমালিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান, ইয়েমেন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়া হয়ে গেছে যে লবিস্ট নিয়োগ করতে হবে? মির্জা ফখরুলের জাতিসংঘ মিশন সম্পর্কে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি জাতিসংঘে নালিশ করতে গেছে। বিএনপি আর আন্দোলন করতে পারে না। তাদের এখন নালিশই পুঁজি। তবে তাদের জাতিসংঘ মিশন ফেল করেছে। জাতিসংঘে মির্জা ফখরুলের বৈঠক ও যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপির পক্ষে লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে সমালোচনার মুখে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন দলটির নেতারা। তবে এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি হননি তারা। উদ্বৃত না করার শর্তে বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বলেন, সেখানে (জাতিসংঘ ও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক) কি হয়েছে তা আমরা জানি না। মির্জা ফখরুল দেশে ফিরলে তার সঙ্গে আলোচনা করে বলতে পারবো।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App