×

মুক্তচিন্তা

আলট্রা পুওর বনাম আলট্রা ওয়েলদি

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৭:২৯ পিএম

আলট্রা ওয়েলদিদের তালিকা করে উত্থানের পেছনের ঘটনা শনাক্ত করা দরকার যদি প্রকৃত অর্থে দেশটাকে আমরা উন্নয়নশীল দেশে উপনীত করতে চাই, যদি আমরা প্রকৃত গণতন্ত্রের কথা ভেবে থাকি। নতুবা এই আলট্রা ওয়েলদিরাই একদিন দেশে আলট্রা পুওরের সংখ্যা বহুগুণ করে দেবে। আমি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এ বিষয়ে।

এতদিন শুনে এসেছি বাংলাদেশে রয়েছে আলট্রা পুওর বা অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী। এই দরিদ্র অবস্থা থেকে তাদের মুক্ত করার জন্য শুরু হয়েছিল সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি। যা আজ অবধি চলমান। এই আলট্রা পুওর জনগোষ্ঠীর মুক্তির জন্য তথা দারিদ্র্য বিমোচন লক্ষ্যকে সামনে রেখে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় এ দেশে আবির্ভূত হয়েছে, জন্ম নিয়েছে অনেক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। সরকারের পাশাপাশি এসব সংগঠন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নিরলস কাজ করে চলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে যে মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদায় আসীন হওয়ার সম্ভাবনায় স্বীকৃত হয়েছে, তাতে কিন্তু সরকারের পাশাপাশি এসব বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থারও অবদান যথেষ্ট। একজন উন্নয়নকর্মী হিসেবে কাজ শুরুর প্রথম দিন থেকেই এই আলট্রা পুওর বা অতিদরিদ্র শব্দের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে। সম্প্রতি নতুন এক জনগোষ্ঠীর নাম জানলাম, আলট্রা ওয়েলদি বা অতি ধনী। যারা বাংলাদেশে রয়েছে এবং যাদের সংখ্যা বিশ্বের অনেক দেশকে হার মানিয়েছে। এই তথ্য দেশের কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান দেয়নি, দিতে পারেনি। দিয়েছে উন্নত দেশের একটি প্রতিষ্ঠান।

ওয়েলথ-এক্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেই প্রতিষ্ঠান। ৩ কোটি মার্কিন ডলার বা ২৫২ কোটি টাকার সম্পদ থাকলে তাদের আলট্রা ওয়েলদি বা অতি ধনী হিসেবে গণ্য করে থাকে এই প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি ‘ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৮’ প্রকাশ করেছে। তারা এই প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশে সম্পদশালীর সংখ্যা বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরেছে। এই প্রতিষ্ঠান দাবি করে যে, তাদের তথ্য ভাণ্ডারে এ রকম ১ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি ধনকুবেরের তথ্য রয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশের ধনকুবের আছেন। আর এই অবস্থায় তাদের প্রকাশিত বৈশ্বিক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, বিশ্বে আলট্রা ওয়েলদি বা অতি ধনীর উত্থানে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। তাদের প্রতিবেদনে এই আলট্রা ওয়েলদি বা অতি ধনী শ্রেণির সন্ধান পাওয়া গেল, যাদের ৩ কোটি মার্কিন ডলার বা ২৫২ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। তার মানে কী এই দাঁড়াল যে, বাংলাদেশে এক শ্রেণির মানুষই ধনী থেকে আরো ধনী হচ্ছেন? মোটেও কিন্তু তা নয়। কিছুদিন আগে স্থানীয় একটি জরিপে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫ হাজার নতুন কোটিপতি হওয়ার তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। আর এখন ওয়েলথ-এক্স তথ্য দিয়েছে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পৌঁছার যাত্রাপথেই বাংলাদেশ ২০১২ সাল থেকে অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক থেকে সবার শীর্ষে অবস্থান করছে! এটাকে কি বাংলাদেশের অর্জন বলব, বলব কি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাফল্য? দারিদ্র্যমুক্তির ত্বরিত অভাবনীয় অর্জন? নাকি স্ববিরোধী অর্থনৈতিক সংস্কৃতির এক মরণছোবল, যা বৈষম্যের একটি মোটা দাগের বৃত্ত এঁকে চলেছে অবিরত। বৃত্তের ভেতর সম্পদ কেন্দ্রিভূত হচ্ছে ক্রমশ এবং ত্বরিত গতিতে। এই বৃত্তের মালিক হচ্ছেন বিশেষ একশ্রেণির মানুষ নির্বিঘ্নে। এভাবে বৃত্ত আকার আয়তনে বাড়ছে, বাড়ছে বৃত্তের মালিকশ্রেণির সংখ্যা। অর্থাৎ দেশের সম্পদের একটি বড় অংশ একটি শ্রেণির হাতেই কেন্দ্রিভূত হচ্ছে দিন দিন, সম্পদের সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণির পরিধি বাড়ছে এবং তা আশ্চর্যজনকভাবে।

মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন, সরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কতিপয় অসাধু, অসৎ ব্যক্তির দুর্নীতি রাতারাতি তাদের অর্থ সম্পদশালী করে তুলেছে, এমন তথ্য আর কারোর কাছে গোপন নয়। বন কর্তৃপক্ষ গাছ বিক্রি করে রাজা হয়েছেন, মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী ঘুষ, দুর্নীতি, তদবিরে কোটিপতি হয়েছেন, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনে সক্রিয় হয়ে শিক্ষার্থী কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, এসব কিন্তু নতুন কথা নয়। আর এই ধনী হওয়ার প্রক্রিয়া কিন্তু কখনো বন্ধ হয় না, বন্ধ হয়নি। গণতন্ত্রের অজুহাতে যে রাজনীতি বাংলাদেশে, তা কখনোই এসব সম্পদ তৈরির অবৈধ প্রক্রিয়াকে নিষ্ক্রিয় করেনি। নিরুৎসাহিত করেনি। বরং ক্ষমতায় বসা, ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য এই অনিয়মকে প্রশ্রয় দিয়েছে কৌশলে।

একটু শঙ্কায় ছিলাম, এই আলট্রা ওয়েলদি সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী না জানি কী বলে বসেন। আদৌ কিছু বলেছেন কিনা জানি না। তবে তার কাছ থেকে আলট্রা ওয়েলদি সম্পর্কে একটা যৌক্তিক, গ্রহণযোগ্য বিশ্লেষণ আশা করছি। সরকার কী ভাবছেন এই শ্রেণিকে নিয়ে সেটাও জানার আগ্রহ জেগেছে। অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ আলট্রা ওয়েলদির শীর্ষে অবস্থান পেয়েছে, মানে বাংলাদেশ সম্পদশালী ব্যক্তি হওয়ার প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে, এটা কি সাফল্য, নাকি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার ফাঁকফোকর কিংবা দুর্বলতা, জরুরি ভিত্তিতে তা খতিয়ে দেখা দরকার। উন্নয়ন যেন রিপু করা পোশাকের মতো না হয়, সামান্য টান বা চাপে যেন ফেঁসে না যায়।

পরিশেষে বলি, যে দেশ আলট্রা পুওরের বিরুদ্ধে নানাবিধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত স্বাধীনতা-পরবর্তী থেকেই, সেই দেশে আলট্রা ওয়েলদির উত্থান ভয়ানক এক ইঙ্গিত। অসমতা, অরাজকতার এক বারতা। আলট্রা ওয়েলদিদের তালিকা করে উত্থানের পেছনের ঘটনা শনাক্ত করা দরকার যদি প্রকৃত অর্থে দেশটাকে আমরা উন্নয়নশীল দেশে উপনীত করতে চাই, যদি আমরা প্রকৃত গণতন্ত্রের কথা ভেবে থাকি। নতুবা এই আলট্রা ওয়েলদিরাই একদিন দেশে আলট্রা পুওরের সংখ্যা বহুগুণ করে দেবে। আমি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এ বিষয়ে।

স্বপ্না রেজা : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App