×

বিনোদন

শিল্পকলার মঞ্চে ‘নদ্দিউ নতিম’ ও ‘সোনাই মাধব’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০২:৪৫ পিএম

শিল্পকলার মঞ্চে ‘নদ্দিউ নতিম’ ও ‘সোনাই মাধব’
অন্যরকম এক সূক্ষ পাগলামি কাজ করে প্রতিটি মানুষেরই অবচেতনে। সেই পাগলামি ব্যবহার করে কেউ কেউ প্রথাগত যুক্তি বুদ্ধির দেয়াল ভেঙে সামনে দাঁড় করান নতুন সমীকরণ। ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের ভেতর থেকেই সৃজনশীলতার আলোকে জাগ্রত হয় নতুন কিছু করার সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনাকে থিয়েটারের মাধ্যমে প্রকাশ করা এক নাট্যদল ম্যাড থেটার। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হলো দলটির দর্শকনন্দিত ৪৪তম প্রযোজনা ‘নদ্দিউ নতিম’। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘কে কথা কয়’ উপন্যাস অবলম্বনে নাটকটি রচনার পাশাপাশি নির্দেশনা দিয়েছেন আসাদুল ইসলাম। তিন চরিত্রের নাটকে অভিনয় করেছেন একই পরিবারের তিন সদস্য আসাদুল ইসলাম, সোনিয়া হাসান ও আর্য মেঘদূত। নদ্দিউ নতিমে একটি শিশুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে কাহিনী। সেই মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুকে বাঁচাতে নির্বিকার চিত্তে আত্মাহুতি দেন একজন কবি। একটি জীবন বাঁচাতে আরেকটি জীবন উৎসর্গ করার আদর্শিক ঘটনাটি কড়া নাড়ে দর্শকের চৈতন্যে। নাটকের কাহিনীতে আবির্ভূত হন মতিন নামের এক কবি। মনে মনে নিজেকে একজন উজবেক কবি হিসেবে কল্পনা করেন। কল্পনায় তার গাত্রবর্ণ হয়ে ওঠে ধবধবে, শরীরে জড়িয়ে যায় জোব্বার মতো একটি পোশাক। সেই লম্বাটে মুখ ও তীক্ষ্ন চোখ। এই মতিনের মধ্যে বাস করে অন্য এক মতিন। দিনে দিনে মতিন উদ্দিন হয়ে ওঠে নদ্দিউ নতিম। মতিনের হৃদয়ের সবটুকু দখল করে নেয় সহপাঠিনী নিশু। ভাবের ভেলায় ভেসে বেড়ালেও ভাবাবেগে ডুবে যায় না মতিন। সে বুঝতে পারে নিশুর মতো স্কলার মেয়ের যোগ্য সে নয়। এর মাঝে মতিনের একদিন চোখে পড়ে পত্রিকার পাতায় তিন লাইনের ছোট্ট একটা বিজ্ঞাপন একজন সার্বক্ষণিক টিউটর প্রয়োজন, টিউটরের সৃজনশীলতা ব্যক্তিগত যোগ্যতা হিসেবে ধরা হবে, বেতন আকর্ষণীয়। আকর্ষণীয় বেতনের প্রভাবে মতিন তার কবিসত্তাকে সাময়িক স্তিমিত রেখে কমল নামের এক মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর টিউটর পদে অভিসিক্ত হন। মতিনের কর্মকান্ডে অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হওয়ায় তাকে টিউটর পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু প্রতিবন্ধী বাচ্চাটি কবিকে ভোলে না। বাচ্চাটি কবির সঙ্গে কথা বলতে চায়, কিন্তু সে সুযোগ তো আর নেই। কবি চলে গেছেন। শিশুটি জেদ ধরে, সে কথা বলবেই বলবে। একপর্যায়ে সুযোগ হয় কবির সঙ্গে কথা বলার। কমল মতিনের সঙ্গে তার জীবনের একটি সিক্রেট শেয়ার করে, যে সিক্রেটের জন্য মতিনকে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়াতে হয়। হাসপাতালের এক হিমশীতল ঘরে সে শুয়ে থাকে। তার কাছে মনে হয়, সে যেন অনন্তকাল এভাবেই শুয়ে ছিল। কবির জীবন বিসর্জনের মাধ্যমে জানা যায় শিশুটির সেই গোপন কথা। নাটকটির সহযোগী নির্দেশকের দায়িত্বে ছিলেন আনিসুল হক বরুণ। সেট ও লাইট ডিজাইন করেছেন ফয়েজ জহির। লোকনাট্য দলের ‘সোনাই মাধব’ সোনাই এবং মাধবের প্রেম ও বিচ্ছেদের কাহিনী, আর এর মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠা মানব সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে নাটক ‘সোনাই মাধব’ গতকাল সন্ধ্যা মাতাল। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ অবলম্বনে পদাবলি যাত্রা ‘সোনাই মাধব’। লোকনাট্য দলের আয়োজনে গতকাল শনিবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটারে হলভর্তি দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে সোনাই মাধব। নাটকে ব্যবহৃত গানের সুরারোপ করেছেন দীনেন্দ্র চৌধুরী ও লিয়াকত আলী। নতুন আঙ্গিকে করা নাটকটির পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী। নাটকে তিনি অভিনয়ও করেছেন। ‘সোনাই মাধব’ নাটকে দেখা যায় গ্রামের দেওয়ান ‘ভাবনা’র অত্যাচারে সুন্দরী মেয়েরা ঘরের বাইরে যেতে পারছে না। সে সোনাইয়ের কথা জেনে তার মামার কাছে যায়। মামা প্রথমে সোনাইকে ভাবনার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয় না, পরে মৃত্যুর ভয় দেখালে সে বলে দেয় নদীতে জল আনতে গেলে যেন সোনাইকে সে বজরায় তুলে নেয়। ভাবনা তাই করে। বজরা থেকে কান্নার শব্দ শুনে মাধব গিয়ে তাকে উদ্ধার করে এবং দেখে সে মেয়ে তারই সোনাই। ঘরে নিয়ে আসে, বিয়ের আয়োজন করে। কিন্তু দেওয়ান মাধবের বাবাকে ধরে নিয়ে যায়, তাই বাবাকে উদ্ধার করার জন্য মাধব যায় দেওয়ানের কাছে। সোনাই এক বছর একা থাকে ঘরে। তারপর ফিরে আসে তার শ^শুর, বলে সোনাই না গেলে মাধবকে ছেড়ে দেবে না। বাধ্য হয়ে সোনাই যায় মাধবকে ছাড়াতে। দেওয়ান মাধবকে ছেড়ে দিয়ে ঘরে এসে দেখে সোনাই বিষপানে আত্মহত্যা করেছে। কাহিনী শেষ হয় মাধবের হাহাকারে, সে নদীর ঘাটে বসে সোনাইকে ডেকে চলে। এ যেন নাট্যগাথার এক অভাবিত ইন্দ্রজাল। আমাদের লোকজ নাট্য আঙ্গিক এবং এলিজাবেথিয়ান নাট্য আঙ্গিক যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এর কুশীলব, নাট্য কুশীল, গায়ক-গায়িকারা সবাই পালার ঢঙে চতুষ্কোণ মঞ্চের চারধারে বসে ছিল। মঞ্চে তাদের প্রবেশ আর বের হওয়া ছিল উপভোগ্য, কারণ চরিত্রকে ধারণ করে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মঞ্চে প্রবেশ করছিল এবং মঞ্চের বাইরে গিয়ে চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসছিল। নাটকটির প্রায় সব কুশীলবই সঙ্গীত ও নৃত্যবহুল এই প্রযোজনায় মনোগ্রাহী অভিনয় করেছেন। মুখ্য চরিত্র সোনাই আর মাধবের ভূমিকায় রূপসা ও লিটন বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করেছেন। তবে দেওয়ান ভাবনার ভূমিকায় লিয়াকত আলী লাকী তার অনন্য অভিনয় প্রতিভার স্ফুরণ ঘটিয়ে দর্শককে মুগ্ধ করেছেন। যেমন নৃত্যে ছিল তার কুশলী দেহ-ভঙ্গিমা, তেমনি সঙ্গীত ও কথনে ছিল তার পারঙ্গমতা। লাকী আর তার সহশিল্পীদের অভিনয় দর্শকদের আনন্দ-হাসির বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছে নাট্যের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তগুলোতে। লাকী ট্র্যাজিক মুহূর্তেও সমসক্ষমতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন। সোনাই চরিত্রে রোকসানা, মাধব চরিত্রে জাহিদুল কবির অভিনয় করেছেন। নাটকের অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন রহিমা খাতুন, উম্মে মরিয়ম, কিশোয়ার জাহান, মোমিন মিয়া, সুচিত্রা রানি সূত্রধর, রওশন হোসেন, তাজুল ইসলাম মুন্সি প্রমুখ। ১৯৯০ সালে নাটকটি ঢাকার মঞ্চে আসে। এরপর ৭৯টি প্রদর্শনী হয়। এরপর দলটির একটি অংশ আলাদা হয়ে গেলে তাদের অংশটি (সিদ্ধেশ্বরী) আর এ নাটকের প্রদর্শনী করেনি। নাটকটি নতুন করে প্রযোজনা করা হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App