×

মুক্তচিন্তা

সাক্ষরতাই নয়, জরুরি শিক্ষাগত যোগ্যতা সাক্ষরতাই নয়, জরুরি শিক্ষাগত যোগ্যতা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৭:০৩ পিএম

বিশে^র অনেক দেশই তাদের শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত অর্থের ব্যবস্থা রাখে। বাংলাদেশকেও ওই পথই ধরতে হবে। তা না হলে বিপুলসংখ্যক অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী নিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সার্থকতা অর্জন করা যাবে না। তাই বাজেটের এবং পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত বিলাস ব্যাসনের আমদানি নীতি নয়, দেশের শতভাগ মানুষকে শিক্ষিত করে তোলা, তাতে রয়েছে অনেক আনুষঙ্গিক সমস্যার সমাধান। এটা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে হবে।

মানব সমাজে তথা সভ্য সমাজে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলোর অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষার অধিকার- যেমন অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য ও বাসস্থান ইত্যাদি। ১৯১৭ সালে স্বৈরশাসিত রাশিয়ায় রুশ বিপ্লবের পর নতুন সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল বিপুলসংখ্যক নিরক্ষর দেশবাসীকে, বিশেষ করে অশিক্ষিত, সাক্ষরপ্রাপ্ত কৃষক সমাজকে শিক্ষিত করে তোলা, তাদের মৌলিক অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তোলা যাতে তারা বিপ্লবের সুফল যথাযথভাবে গ্রহণ করে সামাজিক উন্নতি ঘটাতে অংশ নিতে পারে। তারা অতি দ্রুত গোটা জাতিকে শিক্ষিত করে তোলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩০ সালে রাশিয়া সফরে গিয়ে মুক্তকণ্ঠে সেখানকার শিক্ষা-সংস্কৃতির বিরাজমান অবস্থার প্রশংসা করেছিলেন, দ্রষ্টব্য তার ‘রাশিয়ার চিঠি’ গ্রন্থটি।

বাঙালিয়ানার প্রবল আবেগ নিয়ে সংঘটিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের পরিণামে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে এমনই একটি প্রত্যাশা ছিল অনেকের, যেমন শিক্ষা খাতে তেমনি মাতৃভাষা বাংলা মাধ্যমের ব্যবহারের ক্ষেত্রে। ঐতিহাসিক একুশের একটি বহু উচ্চারিত স্লোগান, মিছিলে মিছিলে ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু কর।’ বাংলাদেশের সংবিধান তেমন কথাই বলতে চেয়েছে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে এমন ভাষ্যের ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’।

আসলে প্রশ্নটি বাংলা মাধ্যমেরই নয়, এ ক্ষেত্রে আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষার হার, অন্য কথায় সেটা জাতিকে শিক্ষিত করে তোলার বিষয়টি নিয়ে। কারণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় অন্যতম দায়দায়িত্ব যেমন অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন তেমনি যত দ্রুত সম্ভব গোটা জাতিকে শিক্ষিত করে তোলা। রাশিয়া ছাড়াও আশপাশের দুয়েকটি উদাহরণও আমাদের আকাক্সক্ষার টানে সায় দেয়, যুক্তি তৈরি করে- যেমন শ্রীলঙ্কা কিংবা প্রতিবেশী দেশ ভারতের কেরালা রাজ্য।

আমাদের সে আকাক্সক্ষা গত ৪৭ বছরেও পূরণ হয়নি। বরং শিক্ষিতের বদলে জাতিসংঘের শিক্ষানীতির নিরিখে সাক্ষরতার বিষয়টি বিচার-বিবেচনায় সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আমাদের শাসন ব্যবস্থা সেটাই গ্রহণ করেছে, যদিও সাক্ষর আর শিক্ষিতের মধ্যে ব্যবধান বিস্তর এবং তা গুণগত দিক থেকে পর্যায়ক্রমিক। বিশেষ করে এই অর্থে যে শিক্ষিত বলতে আমরা কোন স্তরের শিক্ষিতকে বিবেচনায় আনব, মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তরের কোন স্তরটিকে।

হয়তো তাই জাতিসংঘের নির্ধারিত সাক্ষরতার সংজ্ঞাটিকে বিশে^র অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গ্রহণ করেছে। তবু আমাদের মনে প্রশ্ন থেকে যায়, শিক্ষা-শিক্ষিতের সামাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতার প্রয়োজনের দিকটি কি সাক্ষর-সাক্ষরতার মাধ্যমে মিটবে? লক্ষ্যটা সম্ভবত আরেকটু উঁচু তারে বাঁধা দরকার, যেমন সবাইকে অন্তত মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন। যাতে শিক্ষার সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক সংযোগের ভারসাম্য তৈরি হতে পারে- এক কথায় শিক্ষার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও তার প্রতিফলন।

দুই. সেদিককার অর্জন তো দূরস্ত। আপাতত দেখা যাক সাক্ষরতার সংজ্ঞাই বা কি এবং সে সাক্ষরতায় আমাদের অর্জন কতদূর? সাধারণ বিচারে পড়া, লেখা ও হিসাব-নিকাশের দক্ষতাই এক কথায় সাক্ষরতার প্রাথমিক সংজ্ঞা। আরেকটু স্পষ্ট করে বলতে গেলে সাক্ষরতার অর্থ নির্দিষ্ট ভাষিক জাতিসত্তার অন্তর্গত প্রতিটি সদস্যের মাতৃভাষায় বইপড়া, লেখার মাধ্যমে মনোভাব প্রকাশ এবং লিখিতভাবে হিসাব-নিকাশ রক্ষণের দক্ষতা।

প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা এ প্রয়োজনটুকু মিটাতে পারলেও এটা যে যথেষ্ট নয় এমন বিবেচনা পরে এসেছে, তাই সাক্ষরতার সংজ্ঞাও সেই সঙ্গে পরিবর্তিত হওয়ার দাবি রেখেছে। কারণ এতে সামাজিক প্রয়োজন, জাতীয় প্রয়োজন মেটার কথা নয় শিক্ষাগত বিচারের ক্ষেত্রে। কারণ আধুনিককালে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব বেড়েছে বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায়। সে জন্যই আমরা শিক্ষিতের সর্বনিম্ন স্তর হিসেবে মাধ্যমিক শিক্ষার কথা উল্লেখ করেছি, যা পরবর্তী শিক্ষাস্তরে যাওয়ার অনুক‚ল। জাতিসংঘের ১৯৪৮-এর ঘোষণায় যে প্রাথমিক স্তরের সাক্ষরতার কথা উল্লিখিত, সেখানে ওই পর্যায়ে নাগরিক মাত্রকেই বিনামূল্যে শিক্ষাদান রাষ্ট্রের পক্ষে বাধ্যতামূলক।

বাংলাদেশ অবশ্য এ পর্যায় থেকে কিছু ওপর স্তরে চেষ্টা রেখেছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লক্ষ্য নির্ধারণ করে, কিন্তু ওই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়নি মূলত অর্থনৈতিক কারণে। সেই সঙ্গে অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষক সরবরাহের মতো বিষয়ও এর সঙ্গে জড়িত। এ দেশে শিক্ষার প্রসার সময়ে সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হতে পারেনি বলেই দীর্ঘকাল মক্তব, পাঠশালা, টোল বা চতুষ্পাঠাতেই প্রাথমিক শিক্ষা আবদ্ধ থেকেছে। আর বিদেশি শাসনের লক্ষ্য ছিল শিক্ষার ব্যাপক প্রসার জনস্তরে পৌঁছে না দিয়ে তাকে সীমাবদ্ধ বৃত্তে ধরে রাখা। আর উচ্চশিক্ষা তো বিত্তবানদের জন্য- তা সে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত যাই হোক।

ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিক জীবনে, এমনকি জাতীয় জীবনে শিক্ষার অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। শিক্ষা জীবন ও জীবিকার অধিকল্প শর্ত, জীবনে প্রতিষ্ঠার অনিবার্য সোপান, যেখানে ধাপে ধাপে উত্থান। সাক্ষরতা সেক্ষেত্রে তার সূচনা ধাপ মাত্র, যেখান থেকে যাত্রা শুরু ক্রমান্বয়ে উত্তরণের।

তাই জাতীয় পর্যায়ে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সাক্ষরতাকে শিক্ষার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। ওই দুই পর্যায়ে শিক্ষাকেই জাতীয় অর্জনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে হবে। মানবসম্পদ নামে যে শব্দটির কথা সর্বদা বলা হয় তার মূল শর্ত শিক্ষা, গতানুগতিক অর্থের সাক্ষরতা নয়।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে শিক্ষা শুধু জীবিকা বা পেশার ভিতই তৈরি করে না, যুক্তিবুদ্ধি বিচার বিবেচনার উপযুক্ত মানসিক দক্ষতা তৈরি করে, যা প্রকৃতপক্ষে মননশীলতার বাস্তব ভিত্তি। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনা ও রাজনৈতিক ঘটনাবলীর বিচার-বিশ্লেষণের যোগ্যতা তৈরি করে। যে জনগণকে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের চালিকা শক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়, তাদের চিন্তা-ভাবনা যদি শিক্ষায় আলোকিত না হয়ে ওঠে, তাহলে সে রাষ্ট্রের নেপথ্য শক্তির ভিত কখনো মজবুত হতে পারে না, উন্নয়ন টেকসই হওয়ার কথা নয়। জাতীয় জীবনের উন্নয়নের সূচনাগুলো সর্বজনীন চরিত্র অর্জন করতে পার একমাত্র সর্বজনীন শিক্ষার মাধ্যমে। আর সে জন্যই দরকার বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর সর্বাত্মক শিক্ষা, অর্থাৎ প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষিত হয়ে ওঠা।

তাই আমরা আনুষ্ঠানিক সাক্ষরতার (যেমন জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস) পরিবর্তে শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করতে চাই, সর্বশেষ পর্যায়ের সম্প্রসারিত শিক্ষা যা তার কাছাকাছি। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালন করে আসছে আনুষ্ঠানিকভাবে। এই তো কয়েকদিন আগে (৮ সেপ্টেম্বর) বিশ^জুড়ে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালিত হলো, হয়েছে বাংলাদেশেও। এ উপলক্ষে দৈনিকগুলোতে যা কিছু লেখা হয়েছে তাতে কিছুটা আত্মতৃপ্তির আভাস রয়েছে। উল্লিখিত হয়েছে যে বর্তমানে বাংলাদেশে সর্বশেষ সংজ্ঞা মাফিক সাক্ষরতার হার প্রায় ৭৩ শতাংশ।

রাজধানীর বৃহৎ বস্তিবাসী ও নিম্নবর্গীয়দের সংজ্ঞা, বিশেষ করে বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাগত পরিস্থিতি হিসাবে আনলে ওই তথ্য আপাতত বিচারে অবিশ্বাসী মনে হয়। সে জন্যই আমাদের দেশে পরিচালিত জরিপে সাক্ষরতার সংজ্ঞাটি জানতে ইচ্ছা হয়। বাস্তবতার সঙ্গে কোথায় যেন ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হয়।

তবে পরিচালিত জরিপের পরিসংখ্যান মতে ১৯৭১ বা ১৯৭২-এর সূচনালগ্ন থেকে সাক্ষরতার ক্রমবর্ধমান হার সন্তোষজনকই বলতে হয়। লক্ষণীয় যে পুরুষের তুলনায় নারী সাক্ষরতার হার অনেক কম। গোটা বিষয়টি নিয়ে আমরা যেন আত্মতৃপ্তিতে না ভুগি। কারণ তুলনীয় বিশ^পরিমাপে সাক্ষরতার দিক থেকে আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি।

যেমন উইকিপিডিয়ার হিসাব মতে পৃথিবীর ৭৭.৫ কোটি পূর্ণ বয়স্ক নিরক্ষর মানুষের প্রায় ৭৫ শতাংশ মাত্র ১০টি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং দেশগুলোর প্রায় সবক’টিই আফ্রিকা-এশিয়া মহাদেশের অন্তর্গত। তার মধ্যে রয়েছে এটা বিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশ, বাংলাদেশ। বিশ্বজুড়ে দুই-তৃতীয়াংশ নিরক্ষর মহিলাদের মধ্যে সর্বনিম্ন সাক্ষরতা আবারো দৃশ্যমান আফ্রিকার অঞ্চল বিশেষসহ দক্ষিণ এশিয়া, অর্থাৎ এই নারী নিরক্ষতার হিসাবেও রয়েছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির নাম। এ কারণেই উল্লেখ করেছিলাম যে জরিপে প্রকাশিত পরিসংখ্যান যেন আমাদের আত্মতৃপ্তির বিভ্রান্তিতে ভুগতে সাহায্য না করে। কারণ আমাদের সাক্ষরতার আরো একটি দুর্বলতা এর সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার ঘাটতি, যে দক্ষতার ঘাটতির কারণে আমাদের বিদেশযাত্রী কর্মীরা বিদেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে পদে পদে সমস্যার সম্মুখীন হয়। এ কারণেই কথাটা বারবার আসছে যে আমাদের সাক্ষরতা অর্জনের সংজ্ঞাটিকে কিছুটা সম্প্রসারিত করার জরুরি প্রয়োজন রয়েছে, সেই সঙ্গে সাধারণ মাপের কারিগরি দক্ষতা। এমন লক্ষ্য নিয়েই আমাদের দেশে সাক্ষরতার সংজ্ঞাটি নির্ধারণ করতে হবে এবং তা দ্রুত শতভাগ অর্জনের পক্ষে।

বলা বাহুল্য এর জন্য প্রয়োজন হবে শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত অর্থায়ন, বাজেটে প্রতি বছর তেমন ব্যবস্থা। বিশ্বের অনেক দেশই তাদের শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত অর্থের ব্যবস্থা রাখে। বাংলাদেশকেও ওই পথই ধরতে হবে। তা না হলে বিপুলসংখ্যক অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী নিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সার্থকতা অর্জন করা যাবে না।

তাই বাজেটের এবং পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত বিলাস ব্যাসনের আমদানি নীতি নয়, দেশের শতভাগ মানুষকে শিক্ষিত করে তোলা, তাতে রয়েছে অনেক আনুষঙ্গিক সমস্যার সমাধান। এটা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে হবে।

আহমদ রফিক : ভাষাসংগ্রামী, কবি ও গবেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App