×

জাতীয়

সমুদ্রের করাল গ্রাসে কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৩:২৫ পিএম

সমুদ্রের করাল গ্রাসে কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান
জলবায়ুর বৈরী আচরণে ক্রমেই ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি। হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ বেষ্টনী। হারিয়ে যাচ্ছে প্রাণিক‚লের আশ্রয়স্থল। এক সময়ের সবুজের সমারোহে ভরপুর কুয়াকাটা সৈকতের সৌন্দর্য দেখে পর্যটকরা হারিয়ে যেতেন প্রকৃতির মাঝে। গত দশ বছর আগেও এমন চিত্র দেখা গেছে কুয়াকাটা সৈকতে। সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখন শুধুই স্মৃতি। পর্যটন নগরী কুয়াকাটার সৌন্দর্যমন্ডিত নারিকেল বাগানের পর এবার বিলুপ্তির পথে ‘কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান’। আগত পর্যটকদের বিনোদন কেন্দ্র জাতীয় উদ্যানের অন্যতম আকর্ষণ ঝাউবাগানের ৭০ শতাংশ বর্ষা মৌসুমে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। চলতি বর্ষা মৌসুমে বাকি অংশটুকুও সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় জেলেরা। ঢেউয়ের ঝাপটায় ঝাউবাগানের শত শত গাছ উপড়ে পড়ে আছে সমুদ্র সৈকতে। রক্ষার কোনো উদ্যোগ না থাকায় জাতীয় উদ্যানটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসেছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পর্যটকের বিনোদন কেন্দ্র কুয়াকাটার জাতীয় উদ্যান দাঁড়িয়ে আছে শুধু সাইন বোর্ডসর্বস্ব নাম নিয়ে। সৌন্দর্যমন্ডিত এ উদ্যানটি সমুদ্রের করাল গ্রাসে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রে জোয়ারের পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়ে বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে ক‚লে। প্রচন্ড ঢেউয়ের ঝাপটায় জাতীয় উদ্যানের প্রধান আকর্ষণ ঝাউবাগানের অসংখ্য গাছ উপড়ে পড়ে সৈকতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ফলে মোটরসাইকেলে ঘুরতে আসা পর্যটকরা সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ছেন। বিশেষ করে সূর্যোদয় দেখতে যাওয়ার পথে পর্যটকরা প্রতিনিয়ত আহত হচ্ছেন। ভোর রাতের দিকে গঙ্গামতি যাওয়ার পথে সৈকতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঝাউগাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। অপরদিকে জাতীয় উদ্যানে থাকা আকর্ষণীয় দৃষ্টিনন্দন লেকটি পরিণত হয়েছে কচুরিপানায় ভর্তি বদ্ধ জলাশয়ে। চারদিকের বর্ণিল পাতাবাহার গাছগুলো নেই, পরিণত হয়েছে জঙ্গলে। লেকটির মাঝখানের কাঠের ব্রিজটি ভাঙাচোরা কঙ্কালের মতো ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে। ৬টি প্যাডেল বোটের হদিস নেই। বাঁধানো ঘাটগুলোতে পুরো শ্যাওলার আস্তরণ। পিকনিক স্পটের টিনের ছাউনির ঘরগুলোর মধ্যে অধিকাংশরই হদিস নেই। জাতীয় উদ্যানের মূল সড়কটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। পর্যটক দর্শনার্থীরা এখন বাগানের ভেতরে যেতে পথ খুঁজে পাচ্ছে না। গত কয়েক বছর আগের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যমন্ডিত ইকোপার্কটি জাতীয় উদ্যানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জাতীয় উদ্যানটি এখন দেখলে পর্যটকরা আশাহত হয়। বনবিভাগের চরম উদাসীনতায় জাতীয় উদ্যানের এ হাল হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্যমন্ডিত স্পট ছিল জাতীয় উদ্যানটি। যা এখন ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। সিডর আইলার মতো সুপার সাইক্লোন কিংবা মহাসেনের মতো জলোচ্ছ্বাসে কয়েক দফা বিধ্বস্ত হয়। তারপরও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে পর্যটকরা বিমোহিত হয়ে এখানে আসত। কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে সৈকত লাগোয়া জাতীয় উদ্যানের অবস্থান। চারদিকে ঝাউবাগানে ঘেরা ছিল। ইকোপার্কটি বাইরে থেকে গহীন অরণ্য মনে হলেও মাঝখান দিয়ে একাধিক চলার পথ ছিল। ছিল ছোট ছোট বক্স কালভার্ট। এরই মধ্যে দৃষ্টিনন্দন লেক। লেকের মাঝখান দিয়ে চলাচলের জন্য ছিল একটি কাঠের ব্রিজ। লেকটির দুইপাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বিভিন্ন প্রজাতির বনজ, ফলদ, সৌন্দর্য বর্ধনকারী গাছের সমাহার। স্বচ্ছ টলমলে পানির মধ্যে বনবিভাগের ফাইবার প্যাডেল বোট ছিল। এখানে বেড়াতে আসা পর্যটককে উদ্যানটি বিশেষভাবে আকৃষ্ট করত। পাঁচ বছর আগে কুয়াকাটা ইকোপার্ক ও ফাতড়ার বনাঞ্চল এলাকা জাতীয় উদ্যানের আওতায় ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু বর্তমানে জাতীয় উদ্যানের কিছুই নেই। বিদ্যুৎ লাইন খুঁটিসহ সব লন্ডভন্ড অবস্থায় পড়ে আছে। শুধু গেটে কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান লেখা একটি সাইন বোর্ড রয়েছে। বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পর্যটন শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে কুয়াকাটায় জাতীয় উদ্যান করা হয়। যার মধ্যে কুয়াকাটার ইকোপার্ক ছাড়াও রয়েছে ফাতড়ার বিশাল বনাঞ্চল। প্রায় ১৮ হাজার একর বনভ‚মি এলাকা নিয়ে উদ্যানের অবস্থান। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বন অধিদপ্তরের উদ্যোগে প্রাথমিক পর্যায়ে দুই কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয় করে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ করা হয়। প্রথম দফায় ২১টি ধাপের মধ্যে ২০টির কাজ সম্পন্ন করতে ৬৩ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। পরবর্তী ধাপে করা হয় কাঠের ব্রিজ। ওই সময়ে প্রধান ফটক নির্মাণ, মেঠোপথ প্রশস্তকরণ, বক্স ও পাইপ কালভার্ট, ভূমির উন্নয়ন, গোলঘর ও জেটি নির্মাণ, ফিডার রোড, কার পার্কিং সুবিধা, পিকনিক শেড, টিকেট কাউন্টার, এপ্রোচ রোড, বিশুদ্ধ পানির সংস্থান, অভ্যন্তরীণ পানি সরবরাহ, সিটিং বেঞ্চ, লেক-পুকুর খনন ও বিদ্যুতায়ন করা হয়। এ ছাড়া ওই সময় প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ইকোপার্ক এলাকায় শোভা বর্ধনকারী বাগান, বন্য প্রাণীর আবাসস্থল উন্নয়নে বাগান সৃজনসহ ৪৭ হেক্টর বাগানে নারিকেল, ঝাউ, আমলকি, অর্জুন, জারুল, হিজল, চালিতা, পেয়ারা, জাম, হরীতকী, কাঠবাদাম, মহুয়া, কামিনী, লালকরমচা, পলাশসহ বিভিন্ন প্রজাতির লক্ষাধিক গাছের চারা রোপণ করা হয়। এর বাইরে এক হাজার ৬শ ৬৭টি নারিকেল চারাও লাগানো হয়। কিন্তু বর্তমানে এ সবের ৭০ শতাংশ নেই। সেগুলো বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের তান্ডবে ইকোপার্ক সংলগ্ন নারিকেল বাগান, ঝাউবনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ইতোমধ্যেই সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। শুধু মূল ফটকে একটি গেট রয়েছে। অরক্ষিত একটি বাউন্ডারি রয়েছে। ভেতরে একটি পাকা টংঘর তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। কুয়াকাটায় আসা একাধিক পর্যটক জানান, ইকোপার্কের মধ্যে কাঠের ব্রিজগুলো একেবারেই ভাঙাচোরা। এ ছাড়া সামান্য বৃষ্টি হলে কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেয়ার জায়গা নেই। স্থানীয় বনপ্রেমীরা জানান, সমুদ্র শাসন বা প্রটেকশন না থাকায় ঢেউয়ের তান্ডবে সৈকতের বালু সরে গিয়ে গাছগুলো উপড়ে পড়ছে। হরাচ্ছে এর সৌন্দর্য। এ বিষয়ে বনবিভাগের মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, জাতীয় উদ্যানের সৌন্দর্য বর্ধনসহ উন্নয়নের জন্য একটি প্রজেক্ট প্রোফাইল মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন হয়ে এলে এর কাজ আবার শুরু করা হবে। তবে ঝাউবাগান বা উদ্যানটি রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App