×

জাতীয়

লালমনিরহাটে নদী ভাঙন কবলিত এলাকায় নীরব কান্না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৪:৪৩ পিএম

লালমনিরহাটে নদী ভাঙন কবলিত এলাকায় নীরব কান্না
‘একবার/দুইবার নয়। এই নিয়া চৌদ্দবার বাড়ি সড়বার নাগচি। গত আইতে একটা ঘর নদীত ভাসি গেইচে। বাকি ঘর তিনটা খুলচি। এগুলা নিয়া এলা হামরা কোনটে যাই বাহে। এই নদী হামাক ফকির বানাইছে।’ গত বুধবার বিকেলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের বাগডোরা মধ্যপাড়া গ্রামের বৃদ্ধ আব্বাস উদ্দিন। তিনি জানান, ত্রিশ বছর আগে বিশাল জোতদার ছিল আব্বাস উদ্দিনের। হঠাৎ তিস্তার ভাঙনে খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের কালমাটি হাট তিস্তায় বিলীন হয়। সঙ্গে পুরো কালমাটি গ্রাম তিস্তার গর্ভে চলে যায়। অন্যদের মতো এই জোতদার পরিবারের জায়গা হয় রাস্তার ধারে। সেখানে দুই বছরের ঘামঝড়া পয়সায় মাথা গোঁজা ঠাঁই করেন। সেটাও ভেঙে যায় তিস্তার স্রোতে। এভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্নে তেরোবার নতুন করে বসতভিটা বাঁধেন তিনি। কিন্তু কোনোটাই স্থায়ী হয়নি। এভাবে যৌবনের সব শ্রম তিস্তা নদী গিলে ফেলেছে। শেষ বয়সে এসে ছেলেদের আয়ে গত বছর দেড় লাখ টাকায় ১২ শতাংশ জমি কিনে বাগডোরা মধ্যপাড়ায় বসতভিটা বাঁধেন আব্বাস আলী। সেটাও বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে তিস্তার ভাঙনের কবলে পড়ে। একটি ঘর ভেসে গেলেও বাকি ঘরগুলো সরাচ্ছে নিরাপদে। কিন্তু বসতভিটা বাঁধার জায়গা নেই। রাস্তার ধারে ফেলে রেখেছেন। পরিবারকে পাঠিয়েছেন নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে। এক সময়ের জোতদার হলেও এখন ঘর দাঁড়ানোর জমি নেই আব্বাস আলীর। ওই গ্রামের দিনমজুর কালাম মিয়া (৫০) দশমবারের মতো একচালা টিনের ঘর করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। তার বেড়ার নিচে তিস্তার স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। পানির আঘাত হানছে তার এ শীর্ণ ঘরে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধটি রক্ষায় যৎসামান্য কিছু জিও ব্যাগ ফেলে আপাতত রক্ষার সান্ত¡না চেষ্টা করেছেন। সেই সান্ত¡নার ভরসায় পরিবার পরিজন নিয়ে আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে কালামদের। কালাম মিয়া জানান, ঘরটা সরিয়ে রাখার জায়গা নেই। তাই অনিরাপদ হলেও নদীর কিনারে থাকছেন তারা। রাতে স্বামী স্ত্রী পালাক্রমে পাহারা দেন। বাগডোরা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেয়া গৃহবধূ মৈরন বেগম (২৮) জানান, গত ঈদের দিন তাড়াহুড়া করে ঘর দুটি সরিয়ে রাস্তায় নিয়েছেন। একটি ঘর জায়গার অভাবে পাশের ডোবায় ফেলে রেখেছেন। বাকি আরেকটি ঘরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তবে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারিভাবে কোনো সহায়তা পাননি বলে দাবি করেন তিনি। আব্বাস উদ্দিন, কালাম বা মৈরন নন, গত এক মাসে বাগডোরা মধ্যপাড়া গ্রামে প্রায় অর্ধশত পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে রাস্তায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। জায়গার অভাবে কিছু পরিবার সব কিছু বিকিয়ে দিয়ে কাজের সন্ধানে পরিবার পরিজনসহ পাড়ি জমিয়েছেন ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়। কেউ আবার আত্মীয়ের বাঁশ বাগান বা ডোবা উঁচু করে, কেউ দাদন ব্যবসায়ীদের চড়া সুদে ঋণে জমি বন্ধক দিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছেন। কেউ রয়েছেন খোলা আকাশে। বাগডোরা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও বেড়িবাঁধটি রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে কালমাটি সলেডি স্প্যার বাঁধটি অকার্যকর হয়ে পড়বে। তিস্তা নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে আদিতমারী উপজেলার ভাদাই সতি নদী হয়ে সাপ্টিবাড়ি ইউনিয়ন হয়ে জেলা শহরে চলে যাবে। এতে কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসলও জলাবদ্ধতায় বিনষ্টের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। তাদের দাবি পানি উন্নয়ন বোর্ড ৩ হাজার জিও ব্যাগের জোড়াতালি দিয়ে দায়সারা কাজ করেছেন। সামান্য পানি বাড়লে এসব জিও ব্যাগ বসে যাচ্ছে। এ জন্য তারা আরো ৩ হাজার জিও ব্যাগ ফেলে বাঁধটি রক্ষার জোর দাবি জানান। আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা বাহাদুরপাড়া গ্রামের গরিবুলাটারী পাড়াটি গত এক সপ্তাহে নদীতে বিলীন হয়। গত বুধবার রাতে সর্বশেষ মাজেক মিয়ার বসতভিটা নদীতে বিলীন হয়। ভাঙনের মুখে পড়েছে বাহাদুরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাহাদুরপাড়া মসজিদ, ব্রিজ কালভার্টসহ কয়েক হাজার পরিবার। ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে এলাকাবাসী মানববন্ধন করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। ওই গ্রামের কলেজছাত্রী জাকিয়া ফারহানা বলেন, তিস্তায় বাঁধ নির্মাণ করে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ দিলে চরাঞ্চলের মানুষ বোঝা না হয়ে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে। এ জন্য দ্রæত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি। মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আজাহারুল ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে তার ইউনিয়নে ১৩০টি পরিবারের বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। তালিকা দিয়ে ঢেউটিন ও টাকার চাহিদা পাঠানো হয়েছে। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক শফিউল আরিফ জানান, ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে। তাদের মাঝে ঢেউ টিন ও নগদ অর্থ বিতরণ করা হবে। ভাঙন রোধে কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App