×

মুক্তচিন্তা

উন্নয়নে আস্থা প্রয়োজন

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৮:০৪ পিএম

মানুষই বড় কথা। এই মানুষের দায়িত্ববোধের দ্বারা কর্তব্যকর্ম সুচারুরূপে সম্পাদনের মাধ্যমে সমাজ সমৃদ্ধি লাভ করে। আবার এই মানুষের দায়িত্বহীনতার কারণে সমাজের সমূহ ক্ষতিসাধিত হয়। মানবসম্পদ না হয়ে সমস্যায় পরিণত হলে সমাজের অগ্রগতি তো দূরের কথা সমাজ মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি সভ্যতার বিবর্তনে সহায়তা হয়। মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ কিংবা মারণাস্ত্রে মানুষের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে।

মানুষ মূলত বিশ্বাসের বিশ্বে বাস করে। মানুষের পরস্পরের সম্পর্ক, সমাজের সব শক্তির সৌহার্দ্য ও সহযাত্রা, জরুরি উন্নয়ন কর্মভাবনার সফল বাস্তবায়ন, চিন্তা ও চৈতন্যে সমন্বয় সবই আস্থার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। আস্থা আত্মবিশ্বাসকে বলিয়ান করে, আত্মমর্যাদাবোধকে জাগ্রত করে, জাতীয় ঐক্য চেতনায় প্রেরণা জোগায়, গঠনমূলক ও উন্নয়নধর্মী কর্ম উদ্যোগে প্রত্যয় ও প্রতীতি দান করে। পক্ষান্তরে পারস্পরিক আস্থাহীনতা জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরায়, বিভেদের দেয়াল গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলে সব মুক্ত চেতনার প্রহরকে, নিরুৎসাহ-নিরুত্তাপ-নিষ্পৃহতাকে লালন-পালন করার ফলে মানুষ ও প্রকৃতি সৃষ্ট সমস্যারা সমাধানের পথ পায় না, সখ্য, সম্মান সমীহ ও সৃজনশীলতা তিরোহিত হয়, চরিত্রবল ও সৃজনশীল কর্মপ্রেরণায় স্থবিরতা নেমে আসে।

বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির বয়স এখন প্রায় আটচল্লিশ। একজন মানুষ এ বয়সে থাকে পুরোমাত্রায় পারঙ্গম, উদ্ভাবনায় উৎকৃষ্ট, অভিজ্ঞতায় অধিষ্ঠিত এবং চিন্তা-চৈতন্যে সজাগ সতেজ ও সপ্রতীভ। তবে উন্নয়ন ভাবনায় ও অভিযাত্রায় প্রায় পাঁচ দশকের পথ চলা একটা দেশ এবং অর্থনীতির জন্য এটা হয়তো খুব বড় একটা সময় নয়। বিশেষ করে বিশেষ ভূরাজনৈতিক অবস্থানে, দুর্যোগপ্রবণ প্রাকৃতিক পরিবেশে, জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ, আস্থা অনাস্থার দোলাচলে সমাজ ও রাজনৈতিক অর্থনীতির সামষ্টিক ব্যবস্থাপনার বিবরে বেড়ে ওঠা একটা উন্নয়ন অভিমুখী দেশের পক্ষে।

কর্মযোগী কর্মসূচির দুর্নীতি দীর্ঘসূত্রীয় দুর্দশায়, অপ্রতিরোধ্য আত্মসাৎ ও অব্যবস্থাপনায়, প্রতিকারহীন অন্যায় ও অনিয়মে, সীমাবদ্ধ স্বার্থে জাতীয় স্বার্থ, সম্পদ ও অর্থ অপব্যয়ে, সম্পদ ও সেবা উৎপাদন ব্যতিরেকে অর্থ আয় ব্যয়ে, অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহিরহিত পরিবেশে পারঙ্গমতার সঙ্গেও পরিচালিত কর্মকাণ্ড যে কোনো দেশ ও অর্থনীতির কপোলে আস্থাহীনতার তিলক পরিয়ে থাকে। তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানরের উপরে ওঠার চেষ্টা প্রচেষ্টার মতো সম্ভাবনাময় অর্থনীতিরও শনৈ গতিতে শীর্ষে যাত্রার পথে বারবার বাধা আসে। সবার প্রয়াসে অর্জিত সাফল্যকে নিজেদের সাফল্য বলে বড় করে দেখানোর প্রগলভতায়, পারস্পরিক দোষারোপের প্রবণতায়, অপরিপক্ব সংক্ষোভে ফেটে পড়াও এ শ্রেণির দুর্ভাগ্য ভারাক্রান্ত অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। সার্বিক উন্নয়নে উত্থান-পতন থাকবেই কিন্তু উত্থান বেশি না পতন বেশি না সমান সমান তা দেখা দরকার। ধরা যাক কোনো এক সম্ভাবনাময় অর্থনীতিতে ১০ বা তার বেশি শতাংশে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হওয়ার কথা, সার্বিক সক্ষমতা তাই বলে, কিন্তু ৬ বা ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনকে বড় দেখিয়ে বাকি ২-৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে নানান অস্থিরতায়, অনিয়মে, অপব্যয়ে, আত্মসাতে লোপাট হতে দেয়ার সুযোগ ও ব্যবস্থা থেকে সবার দৃষ্টি সরানো সহজ হতে পারে। অর্থাৎ মানুষ ও প্রকৃতি সৃষ্ট দুর্যোগ, দুর্নীতি আর আত্মসাৎ লুটপাট না থাকলে আরো বেশি প্রবৃদ্ধি হিসাবায়িত হতে পারত। এর ফলে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের টার্গেট ধোঁয়াশা হতে পারত না।

বিগত সময়ে বাংলাদেশের অর্জন অবশ্যই নেহাত নয়, আস্থা সৃষ্টির মতো অনেক অনেক অর্জন আছে। কৃষিতে অভূতপূর্ব নীরব সাফল্য রয়েছে- সে কৃতিত্ব কৃষককে দিলাম কি দিলাম না খোদ কৃষক তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। বিশ্বের বহু উন্নয়নশীল দেশে দেখা গিয়েছে যে যার যা প্রাপ্য তা তাকে না দিয়ে অপ্রাপ্য বর্ণচোরাদের বেসাতির বন্যায় ভেসে সেসব দেশের সাফল্য তথাকথিত বড়দের ভাগাভাগির ভাগাড়ে চলে গিয়েছে। বিশ্ব সংস্থার সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে সেসব দেশে সে কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রণোদনা ও তাদের বিকাশ সম্ভাবনা উন্নয়ন ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেও যেন আসে না। পক্ষান্তরে তথাকথিত বড় বড় গ্রুপের কাছে চলে যায় সৃষ্ট পুঁজির সিংহভাগ, করায়ত্বে তাদের সব ব্যবসা-বাণিজ্য সব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ। এই ভূখণ্ডেই অতীতেও যেভাবে কুক্ষিগত হয়েছিল দেশের সহায় সম্পদ কতিপয়ের হাতে আর সেই শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গোটা জাতি। যেখানে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যবোধ ও উন্নয়ন ভাবনার সমন্বয় প্রয়োজন সেখানে উন্নয়ন দৌড়ে সাফল্য লাভের জন্য ঠুনকো বিষয় নিয়েও দলাদলি রেষারেষি আর দোষ চাপানোর চাপাবাজির মহড়া অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধতার পর্যায়ে দিকে নিয়ে যেতে দেখা গিয়েছে।

শোষণ বঞ্চনা আর বণ্টন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার বাঙালির ঐতিহাসিক মুক্তির সংগ্রাম এর প্রকৃত অর্জন বা বিজয় বিবেচনার জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিবেশ পরিস্থিতির পরীক্ষা পর্যালোচনা একটি প্রত্যয় ও প্রতীতি জাগাতে পারে। যেমন তৃণমূল পর্যায়ে সঞ্চয়ের অভ্যাস বাড়িয়ে, বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে দেশের অর্থনীতিকে স্বয়ম্ভর করার মন্ত্র মানতে অপচয় রোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। বিয়ের উৎসবে সামাজিকতার দোহাই দিয়ে নানান অনুষ্ঠানের নামে অর্থ অপচয়ে সংযমী হওয়ার যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত কারণ রয়েছে। দিনের বেলাতেও রাস্তার বাতি জ্বালানো, ট্যাপের মুখ খোলা রেখে পানি অপচয়ের মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ক্ষতির দিকটি বিদ্যুৎ আর পানি উৎপাদনে ব্যয়ের পরিমাণ বিবেচনায় এনে বুঝতে হবে। বৃক্ষরোপণে শুধু ‘দিবস’ আর ‘উচ্চমহলের নির্দেশমতে’ পালনের সীমারেখায় না বেঁধে একে সহজাত বোধ, উপলব্ধি ও কর্তব্য জ্ঞানে আনতে হবে। নিজের সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে তার প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করাকে সর্বোচ্চ দায়িত্বজ্ঞান বিবেচনা করে নিজের ছেলেমেয়েকে পড়াশুনায় সহায়তা করে তাকে কোচিংয়ের ওপর নির্ভরশীলতা ও তার ব্যয় হ্রাস করা যেতে পারে। কিন্তু এ সবের জন্য তৈরি হতে হবে উপযুক্ত পরিবেশ। পরিস্থিতিই যেন অধিকতর অনিয়মের দোসর না সাজে।

সবার উপর মানবসম্পদ সত্য তার উপরে নাই। বাংলাদেশের জনসংখ্যা স্বাধীনতার পর দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। পৃথিবীর খুব কম দেশেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির এমন পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। আর তারচেয়ে বড় কথা জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের সংস্থান, বিশেষ করে তাদের কর্মসৃজন সুযোগ সম্প্রসারণের প্রয়াস প্রচেষ্টায় সফলতাও বাংলাদেশের বেলায় ভিন্ন। মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের সাফল্য সূচক অনেক দেশের নিচে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট পর্যায়ে পৌঁছালেও তার ফসল ঘরে তুলতে না পারলে অপারগতায়, প্রকারান্তরে তা ডিজাস্টারে পরিণত হতে পারে। উপযুক্ত শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ব্যতিরেকে পয়মন্ত জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে পাওয়া যাবে না।

মানুষই বড় কথা। এই মানুষের দায়িত্ববোধের দ্বারা কর্তব্যকর্ম সুচারুরূপে সম্পাদনের মাধ্যমে সমাজ সমৃদ্ধি লাভ করে। আবার এই মানুষের দায়িত্বহীনতার কারণে সমাজের সমূহ ক্ষতিসাধিত হয়। মানবসম্পদ না হয়ে সমস্যায় পরিণত হলে সমাজের অগ্রগতি তো দূরের কথা সমাজ মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি সভ্যতার বিবর্তনে সহায়তা হয়। মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ কিংবা মারণাস্ত্রে মানুষের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। মানবতার জয়গান মানুষই রচনা করে আবার মানবভাগ্যে যত দুর্গতি তার স্রষ্টাও সে। মানুষের সৃজনশীলতা, তার সৌন্দর্যজ্ঞান, পরস্পরকে সম্মান ও সমীহ করার আদর্শ অবলম্বন করে সমাজ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলে। পরমত সহিষ্ণুতা আর অন্যের অধিকার ও দাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মাধ্যমে সমাজে বসবাস করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সুতরাং সবার সহযোগিতা ও সমন্বিত উদ্যোগে সমাজ নিরাপদ বসবাসযোগ্য হয়ে উঠে। সমাজবিজ্ঞানীরা তাই মানুষের সার্বিক উন্নয়নকে দেশ জাতি রাষ্ট্রের সব উন্নয়নের পূর্বশর্ত সাব্যস্ত করে থাকেন। সমাজের উন্নতি, অগ্রগতি ও কল্যাণ সৃষ্টিতে মানুষের সার্বিক উন্নতি অপরিহার্য শর্ত। আগে সমাজ না আগে মানুষ এ বিতর্ক সার্বজনীন। মানুষ ছাড়া মনুষ্য সমাজের প্রত্যাশা বাতুলতামাত্র। সুতরাং একেকটি মানুষের উন্নতি সবার উন্নতি, সমাজের উন্নতি। একেক মানুষের দায়িত্ববোধ, তার কাণ্ডজ্ঞান তার বৈধ অবৈধতার উপলব্ধি এবং ভালোমন্দ সীমা মেনে চলার চেষ্টা-প্রচেষ্টার মধ্যে পরিশীলিত পরিবেশ গড়ে ওঠা নির্ভর করে। রাষ্ট্রে সব নাগরিকের সমান অধিকার এবং দায়িত্ব নির্ধারিত আছে। কিন্তু দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা অধিকার আদায়ের সম্ভাবনা ও সুযোগকে নাকচ করে দেয়। পণ্য ও সেবা সৃষ্টি না হলে চাহিদা অনুযায়ী ভোগের জন্য সম্পদ সরবরাহে ঘাটতি পড়ে। মূল্যস্ফীতি ঘটে সম্পদ প্রাপ্তিতে প্রতিযোগিতা বাড়ে। পণ্য ও সেবা সৃষ্টি করে যে মানুষ সেই মানুষই ভোক্তার চাহিদা সৃষ্টি করে। উৎপাদনে আত্মনিয়োগের খবর নেই- চাহিদার ক্ষেত্রে ষোলোআনা টানাপড়েন তো সৃষ্টি হবেই। অবস্থা ও সাধ্য অনুযায়ী উৎপাদনে একেকজনের দায়িত্ব ও চাহিদার সীমারেখা বেঁধে দেয়া আছে কিন্তু এ সীমা অতিক্রম করলে টানাপড়েন সৃষ্টি হবেই। ওভারটেক করার যে পরিণাম দ্রুতগামী বাহনের ক্ষেত্রে, সমাজে সম্পদ অর্জন ও ভোগের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রমণে একই পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে থাকে। সমাজে অস্থিরতা ও নাশকতার যতগুলো কারণ এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে এই মৌলিক অধিকার অস্বীকৃতি, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধে বিভ্রান্তি ও বর্জন, সম্পদের বণ্টন ও অর্জনে বৈষম্য এবং আত্মত্যাগ স্বীকারে অস্বীকৃতি মুখ্য।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : উন্নয়ন অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক চেয়ারম্যান, এনবিআর।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App