×

মুক্তচিন্তা

খবর এবং পেছনের খবর

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৮:৩৩ পিএম

যারা বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মুখস্ত বাক্য উচ্চারণ করছেন, তারা জঙ্গিবাদের বিপদের কথাটা মাথায় রাখছেন কিনা, সেটা একটি বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশের মানুষ একটি ভালো নির্বাচন চায়, ভোট দেয়ার অধিকার চায়- এটা যেমন সত্য তেমনি ভোট দিয়ে এমন কাউকে ক্ষমতায় বসাতে চায় না, যারা ক্ষমতায় বসে বা তার আগেই ২০০১ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে।

চলতি হাওয়া

সেপ্টেম্বর মাসে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা গরম হবে বলে কোনো কোনো মহল থেকে প্রচার করা হচ্ছে। রাজনীতির মাঠের নানা ধরনের খেলোয়াড়রা মাঠে নামার চেষ্টা করছে। সরকারের বিরুদ্ধে একটি চক্রব্যূহ রচনার চেষ্টা হচ্ছে। সরকার হুমকি দিচ্ছে বিএনপি-জামায়াতকে, আর সরকারবিরোধী সবাই কখনো একসঙ্গে, কখনো ভিন্নভাবে সরকারকে হুমকি দিচ্ছে। এসব পাল্টাপাল্টি হুমকিতে সাধারণ মানুষের কারো মধ্যে কিছু আগ্রহ তৈরি হচ্ছে, কেউ এসবকে কোনো ধর্তব্যের মধ্যেই আনছে না। সরকার মনে করছে তাদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত আছে। বিরোধী দল তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারছে না। আবার বিরোধী দল মনে করছে সরকারের পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান’। তবে প্রকৃত ঘটনা হলো পরিস্থিতি সব সরলরেখায় অগ্রসর হচ্ছে না। নানা ধরনের অন্তঃস্রোত বইছে বলে মনে হচ্ছে। আমি আমার প্রায় সব লেখায় একটা কথা বলার চেষ্টা করি যে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেমন জয়লাভের লক্ষ্য নিয়ে অংশ নেবে, তেমনি সম্মিলিত আওয়ামী বিরোধী শক্তিও নির্বাচনে যাবে আওয়ামী লীগকে হারানোর জন্য। এখন দুপক্ষের মুখোমুখি লড়াইয়ে ফলাফল কি হবে তা এখনো বলার মতো হয়নি।

পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে চারটিতে জিতে আওয়ামী লীগ একটি শক্ত অবস্থানে আছে। আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বলে বিএনপি যে ঢালাও সমালোচনা করে সেটার যথার্থতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। যদিও সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো সুষ্ঠুভাবে হয়নি বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু স্থানীয় জনগণের পক্ষ থেকে বড় কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়নি। আবার আওয়ামী লীগের এই জয়ের ধারা চ্যালেঞ্জ করে সিলেট সিটি করপোরেশনে বিএনপি জয়লাভ করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বিএনপি ভোট শেষ হওয়ার আগেই নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জন করেছিল। অথচ ফলাফল ঘোষণার পর দেখা যায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিএনপির প্রার্থীর তুলনায় এগিয়ে আছে। তার মানে আওয়ামী লীগ গায়ের জোরে বা অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ভোটে জেতে, সেটা সম্ভবত শতভাগ সত্য নয়।

এখন প্রশ্ন এসেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে কি হবে, কেমন হবে? জাতীয় নির্বাচন কি সিটি নির্বাচনের মডেলে হবে? ফলাফল কি হবে ৪:১? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক ও ভিন্ন মত আছে। কেউ বলেন, সিটি নির্বাচনের স্টাইলেই জাতীয় নির্বাচনও হবে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে ভালো, তাদের কিছু আসন দেয়া হবে। সংসদে প্রধান বিরোধী দলের সম্মান দেয়া হবে। আবার এমন কথাও শোনা যায় যে খালেদা জিয়া এ ধরনের কোনো সমঝোতায় রাজি নন। দেশে বড় ধরনের কোনো গণআন্দোলন গড়ে না উঠলে বিএনপি অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই নির্বাচনে যেতে বাধ্য হবে।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। এরশাদ বলেছেন, বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন করবেন। আর খালেদা জিয়া অংশ না নিলে তিনি বিরোধী দলের অংশ হবেন।

এরশাদের অবস্থান পরিষ্কার। তিনি যে কোনো অবস্থায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকবেন! এখনো তিনি তাই আছেন। এখন রাজনীতিতে বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হলো আওয়ামা লীগ কি বিএনপিকে বাইরে রেখে এবারো একটি বিতর্কিত নির্বাচনের ঝুঁকি নেবে? বিএনপি অংশ না নিয়ে একশটি দলও যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে তাকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলে দেশের মানুষ মনে করে না। তাহলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য আওয়ামী লীগ কি কোনো ছাড় দেবে? শেখ হাসিনাকে যারা ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন, তারা এটা বোঝেন যে খালেদা জিয়াকে ছাড় দেয়ার কোনো সামান্য ইচ্ছাও শেখ হাসিনা মনের কোণে পোষণ করেন না। তাহলে বিএনপি কি আওয়ামী লীগের শর্তেই আগামী নির্বাচনে যাবে? না গেলে বিএনপির সামনে ভালো বিকল্প কি আছে?

বিএনপি মনে করছে, শেখ হাসিনার সরকার এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তাই বিএনপি একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জোরালোভাবে সামনে আনবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি আওয়ামী লীগবিরোধী সব রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন পাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির পক্ষে দেশে কোনো বড় আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব কিনা! অর্থাৎ দেশের মানুষ বিএনপির নেতৃত্বে কোনো আন্দোলনে মাঠে নামবে কিনা? অভিজ্ঞতা এটা বলে যে মানুষ বিএনপির দাবির প্রতি একাত্ম হলেও তাদের ডাকে আন্দোলনে নামে না। আবার ছাত্রদের সাম্প্রতিক অন্তত দুটি আন্দোলনে মানুষের ব্যাপক সমর্থন লক্ষ করা গেছে। তবে সেখানেও দেখা গেছে, আন্দোলন দীর্ঘমেয়াদি এবং সহিংস হয়ে উঠলে মানুষ দূরে সরে গেছে। তার মানে, মানুষ কোনোভাবেই আর অশান্তি চায় না। ভবিষ্যতে কোনো আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়ার আগে বিএনপি এবং তার মিত্রদের মানুষের এই বিশেষ মনস্তাত্তি¡ক দিকটির কথা বিবেচনায় রাখতে হবে।

বিএনপিকে এটাও মনে রাখতে হবে যে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই শিথিল হয়নি। সরকারের সঙ্গে তার দল এবং দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন যেমন আছে, তেমনি আছে সরকারের শক্তিশালী প্রশাসন। দেশে যে কোনো অরাজকতা বা নাশকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা কঠোরভাবে দমন করার ক্ষমতা সরকারের এখনো আছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক পণ্ডিত একটি আপ্তবাক্য উচ্চারণ করে থাকেন যে, অত্যাচার করে কোনো সরকার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে না। কথাটা ঠিক এবং আবার বেঠিকও। আওয়ামী লীগ একটি জনসমর্থনপুষ্ট দল। এই দল শাসন ক্ষমতায় থেকে কিছু জনবিচ্ছিন্ন হলেও প্রতিটি বাড়িতে এই দলের সমর্থক আছে। এই দলের বড় শক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কাজেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হলে যে ধরনের গণজাগরণ দেশে ঘটাতে হবে সেটা করার ক্ষমতা বিএনপির নেই। সবচেয়ে বড় কথা, বিএনপি এর আগে ক্ষমতায় ছিল। তারা যে আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো শাসন উপহার দিতে পারে না, এটা দেশের মানুষের অজানা নয়। ভাত রান্না না করে চাল খাওয়ার কারণে এক গৃহস্থ স্ত্রী বদল করেছিলেন। তো, দেখা গেল নতুন বউ চাল ঝাড়ারও প্রয়োজন মনে করে না, তুষ-কুড়াসহই খেয়ে ফেলে।

আজ যারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা কিন্তু দেশকে এর চেয়ে ভালো শাসন উপহার দেয়ার জন্য ব্যস্ত নয়। তাদের ব্যস্ততার কারণ লুটপাটে অংশ নেয়া। এর সঙ্গে আছে জঙ্গিবাদ-সাম্প্রদায়িক শক্তির উৎপাতের আশঙ্কা। জঙ্গিবাদ এখন এক বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় শেখ হাসিনার সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের যারা বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মুখস্ত বাক্য উচ্চারণ করছেন, তারা জঙ্গিবাদের বিপদের কথাটা মাথায় রাখছেন কিনা, সেটা একটি বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশের মানুষ একটি ভালো নির্বাচন চায়, ভোট দেয়ার অধিকার চায়- এটা যেমন সত্য তেমনি ভোট দিয়ে এমন কাউকে ক্ষমতায় বসাতে চায় না, যারা ক্ষমতায় বসে বা তার আগেই ২০০১ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে।

আমাদের দেশে একশ্রেণির সুশীল নাগরিক তৈরি হয়েছেন যারা আওয়ামী লীগকে অগণতান্ত্রিক দল বলতে মজা পান কিন্তু বিএনপির মতো একটি শঠতাপূর্ণ দলের গায়ে গণতন্ত্রের আলখাল্লা চড়িয়ে দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। মার্কিন ডলারে বেতন পেয়ে যারা দেশে সুশাসন কায়েম করতে চান, নাগরিক আন্দোলনের নামে যারা বিদেশি ক‚টনীতিকদের সঙ্গে খানাপিনা করে দাঁতের ফাঁকে লেগে থাকা গোস্তের অংশবিশেষ খিলান দিয়ে পরিষ্কার করে দেশবাসীকে গণতন্ত্রের সবক দিতে চান তাদের মুখোশ উন্মোচন করাও এখন একটি জাতীয় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিবিদদের আয়ের উৎস নিয়ে যাদের মনে প্রশ্ন জাগে তাদের মনে তো দৃশ্যত রোজগারহীন সুশীলদের পাজেরো হাঁকানো এবং বিদেশিদের মেহমানদারির ব্যয়ের উৎস নিয়েও প্রশ্ন ওঠা উচিত নয় কি?

বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App