×

মুক্তচিন্তা

সড়কের শৃঙ্খলা : নিরাপদ সড়ক কতদূর

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০১৮, ০৭:৫৩ পিএম

সড়কের শৃঙ্খলা : নিরাপদ সড়ক কতদূর
সড়কের শৃঙ্খলা : নিরাপদ সড়ক কতদূর

যদি দেশজুড়ে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চাকে গতিশীল করা যায়, যদি সংস্কৃতিচর্চার পথ সুগম করতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা যায় এবং তার সঙ্গে যুগপৎ মানবসম্পদ উন্নয়নে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের-তরুণদের দেশপ্রেমে ব্রতী করে তুলতে ব্রতচারী মন্ত্রে দীক্ষিত করে তোলা যায়, তাহলে যে কোনো অসাধ্য সাধন সম্ভব! অবশ্য এখানেও সরকারের প্রবল ভূমিকার প্রয়োজন। নিরাপদ সড়কের দাবি তখন আর অলীক চাওয়া হবে না মানুষের। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কল্যাণ ও মঙ্গলের পথে ঐক্যবদ্ধ হব কি? বোধোদয় হবে কি আমাদের?

ক’দিন আগেই নিরাপদ সড়কের দাবিতে গোটা দেশ উত্তাল ছিল। স্কুল-কলেজের কোমলমতি ছেলেমেয়েরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠল, সাধারণের ভোগান্তি চরমে উঠল; সপ্তাহখানেক টানটান উত্তেজনার পর ধীরে ধীরে প্রশমন হলো সব। শোনা গেল সরকার তাদের দাবি মেনে নিয়েছে। এরপর আমরা দেখলাম বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে তোলপাড়! নানান গুজব ছড়াতে লাগল; আর গুজব যখন ছড়ায় তখন গুজবের সঙ্গে ছড়ায় বিভ্রান্তিও এবং এসব ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা থাকে ঘোলাজলে মাছ শিকারের ধান্দায়! আর আমরা যারা সাধারণ, তারা থাকি বিভ্রান্তির বিবরে। ঘোলাজল থিতু হওয়ার পর আমরা যোগ-বিয়োগ করে দেখতে চাই আমাদের গোলায় ফসল কতটা উঠল। গোলা ভরে ওঠার পর আমরা যদি পরিতৃপ্তির আনন্দ নিয়ে ঘুমাতে যাই, সেটা কী আমাদের অপরাধ?

ধারণা করি সা¤প্রতিক আন্দোলনের পর আমরা যারা তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছি, তাদের আশায় গুড়েবালি পড়েছে। ঘুম ভেঙে আমরা যখন গোলার খোঁজ করতে গিয়েছি, অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম গোলার ধান সব ‘চিটা’! ‘চিটাধান’ দিয়ে কী করব আমরা? তবে কি আমরা সেই তিমিরেই রয়ে গেলাম, যে তিমিরে সবাই ছিলাম? ছেলেমেয়েদের আন্দোলনের পর আমরা যারা আশায় বুক বেঁধেছিলাম, আমাদের সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে, সে আশার গুড়ে তাহলে বালিই পড়ল? এত চিৎকার-উত্তেজনা, এত উদ্বেগ-শঙ্কা, এত স্বপ্ন-আশাবাদ, সবই তাহলে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো?

বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার, তথ্য-প্রযুক্তির এত আলোড়ন, উন্নয়নের এত ডামাডোল, এর মধ্যে কি আমাদের সামান্য স্বপ্ন পূরণ হতে পারে না? আমরা কি প্রত্যাশা করতে পারি না, আমার বাবা-ভাই-পুত্র-কন্যা-জায়া-জননী, যারাই ঘর থেকে বাইরে যাচ্ছে, তারা নিরাপদে-অক্ষত ফিরে আসবে ঘরে? আমাদের এ আকুতির উত্তরে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কে দেবেন? সরকার? পরিবহন মালিক-শ্রমিক নাকি অন্য কেউ? আমরা নিজেরাই কি নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট? যখন পত্রিকার পাতা খুললে দেখতে পাই, গাড়িতে সামান্য বচসার জেরে চলন্ত গাড়ি থেকে যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যা করা হচ্ছে, যখন দেখতে পাই পথের পাশে অপেক্ষমাণ মানুষের ওপর গাড়ি উঠিয়ে দিয়ে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হচ্ছে, আন্দোলনোত্তর এ ক’দিনে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান যদি নিতে যাই, তাহলে কি আমাদের আশাবাদী হওয়ার অবকাশ আছে?

‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন তো আমাদের দেশে নতুন কোনো দাবি নয়? তাহলে কেন এখনো আমরা কাক্সিক্ষত ফল লাভ করতে পারছি না? আমরা কি সড়ক দুর্ঘটনার কারণসমূহ নিরূপণেই ব্যর্থ? নাকি বিষয়টিকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় আনছি না? এই যে সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, এনজিও, মোটর মালিক-শ্রমিক সংগঠন, সবাই মিলে আলোচনা, সভা-সমিতি, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, বৈঠক করে যাচ্ছি, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে টক শো হচ্ছে, সবাই মিলে কি আমাদের আশ্বস্ত করার মতো কোনো দিশা দিতে পারলেন? নাকি কেবল ফাইল বাড়ছে? রিম রিম কাগজের অপচয় হচ্ছে? আমরা কি সারারাত সাপ মেরে সকালের আলোয় দেখছি ‘দড়ি’? সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে যখন পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে, অথবা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় যে সব প্রতিবেদন প্রচারিত হচ্ছে, লক্ষ করে দেখেছি বিশেষজ্ঞরা যে সব মন্তব্য করছেন, সেগুলো অনেকটা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো।

আমি কোনো বিশেষজ্ঞ নই, তবুও একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার কিছু সামান্য পর্যবেক্ষণ আছে, সমস্যা হচ্ছে সাধারণের পর্যবেক্ষণ বিবেচনায় আনার মতো ঔদার্য আমাদের আছে কি? নাকি বিবেচনায় আনার যুক্তি আছে? ‘হাতি-ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল’! লোকবাংলায় প্রচলিত এ প্রবাদবাক্যটি মনে রেখেও আমি আমার পর্যবেক্ষণটি সবার সামনে তুলে ধরার স্পর্ধা দেখাচ্ছি; কারো মনে চাইলে বিবেচনা করবেন, অন্যথায় অযোগ্যের প্রলাপ বলে ভুলে যাবেন।

পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝাতে সা¤প্রতিক অসংখ্য সংবাদ আপনাদের সামনে তুলে ধরতে পারি, কিন্তু সে বোকামি আমি করতে চাই না, আমি জানি আজকের তথ্যপ্রবাহের যুগে আমার চেয়ে আপনি কম খবর রাখেন না।

আমাদের এই হতদরিদ্র দেশে প্রতিটি সমস্যাই পর্বতসমান, বিশেষত গোটা সমাজ যখন অনাচারে নিমজ্জিত তখন একটি একটি করে সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সহজ কথা নয়, কারণ নিমজ্জমান সমাজে প্রতিটি সমস্যাই সম্পর্কযুক্ত। একটি সমস্যা সমাধান করতে চাইলে সহস্র সমস্যা হাহাকার করে ওঠে। বিভিন্ন বিবেচনায় আমি প্রথম দাবিটি করতে চাই, সমাজে মানুষের মধ্যে সংযম-সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি, মানুষকে সদাচারী করে তোলা, পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্ব এবং শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তোলা, আমাদের আত্মার জমিনে ভালোবাসার বিপুল চাষাবাদের আয়োজন করা। সমাজের প্রতিটি সেক্টরে যারা প্রাগ্রসর, যারা নেতৃত্বে আছেন তাদের সবার আগে প্রস্তুত করে তোলা আবশ্যক। যারা রাজনৈতিক নেতৃত্বে আছেন, যারা শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে আছেন, ব্যবসায়ী শ্রেণির নেতৃত্বে আছেন, যারা শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক শ্রেণির নেতৃত্বে আছেন, যারা ধর্মীয় নেতৃত্বে আছেন এবং যারা প্রশাসনিক নেতৃত্বে আছেন, প্রথমত তাদের মধ্যে বিষয়টিকে প্রথিত করতে হবে। প্রত্যেকের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে দেশাত্মবোধ। প্রত্যেকের ক্বলবের ভেতর থেকে কালিমা দূর করতে হবে! প্রত্যেককে কল্যাণের পক্ষে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে এবং নিজেদের প্রতিজ্ঞাটি ছড়িয়ে দিতে হবে নিজের ঘরে, পরিপার্শ্বের।

সড়কের যে বেহাল অবস্থা তাতে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে, এ সংকট দূর করবে কে? প্রশ্নাতীতভাবে সরকার। কেবল সড়কের বেহাল অবস্থা দূরীকরণই নয়, পরিবহন খাতে যত নৈরাজ্য, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, প্রতিটি খাতের অনাচার দুর্বৃত্তায়ন রোধে প্রথম এবং প্রধান ভূমিকা সরকারের। নাটোরে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহতের ঘটনায় ঘাতক বাসটি অনেক আগেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছিল বিআরটিসি। সেটি ভাঙ্গাড়ি হিসেবে নিলামে কিনে মেরামতের পর চ্যালেঞ্জার পরিবহন নামে রাস্তায় নামান মালিক মঞ্জু সরকার। এমনকি এ বাসের কোনো রুট পারমিটও ছিল না। গত রবিবার মঞ্জু সরকারকে বগুড়া শহরের মধ্য পালশা থেকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটকের পর এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। তবে অজ্ঞাত কারণে আটকের ৯ ঘণ্টা পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।’ এ সব বাস্তবতা থেকে জাতিকে পরিত্রাণ দেয়া সরকারের দায়, সরকারের অঙ্গীকারও। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে শর্ষের ভেতর যদি ভূত থাকে তাহলে সে শর্ষে দিয়ে কি ভূত তাড়ানো সম্ভব? বিষয়টি ভাবতে হবে সরকারকেই।

আমি অবশ্য অন্য একটি কথাও বলতে চাই; সরকার চাইলেও সমাজ থেকে এসব অনাচার-দুর্বৃত্তায়ন-অরাজকতা দূর করা সম্ভব নয়। আমি বিশ্বাস করি সমাজের প্রতিটি অংশের মানুষ যদি সচেতন হয়ে উঠি, আমরা সবাই যদি অনাচার-দুর্বৃত্তায়ন-অরাজকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হই এবং নিজেরা নিজেদের জীবন থেকে দুর্নীতি-অসততা-স্বার্থান্ধতা-লোভ-কূপমণ্ডূকতা-লালসাকে নির্বাসন দিতে পারি তাহলে কল্যাণ ও প্রাগ্রসরতার পথে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অনেকটাই সহজ হবে। আমার এ বক্তব্যকে অনেকের অলীক ভাবনা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আমার বিশ্বাস, যদি দেশজুড়ে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চাকে গতিশীল করা যায়, যদি সংস্কৃতিচর্চার পথ সুগম করতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা যায় এবং তার সঙ্গে যুগপৎ মানবসম্পদ উন্নয়নে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের-তরুণদের দেশপ্রেমে ব্রতী করে তুলতে ব্রতচারী মন্ত্রে দীক্ষিত করে তোলা যায়, তাহলে যে কোনো অসাধ্য সাধন সম্ভব! অবশ্য এখানেও সরকারের প্রবল ভূমিকার প্রয়োজন। নিরাপদ সড়কের দাবি তখন আর অলীক চাওয়া হবে না মানুষের। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কল্যাণ ও মঙ্গলের পথে ঐক্যবদ্ধ হব কি? বোধোদয় হবে কি আমাদের?

ফরিদ আহমদ দুলাল : লেখক ও গবেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App