×

মুক্তচিন্তা

বস্তিবাসীদের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০১৮, ০৮:০৭ পিএম

বস্তিতে যারা বসবাস করেন, তারা উপায়ন্ত না দেখে মূলত এমন নাগরিক সুবিধাদি বঞ্চিত জায়গায় বসবাস করেন। এ সব বস্তি কীভাবে গড়ে ওঠে, উঠছে তা কিন্তু আমরা সবাই জানি। সরকারের খাসজমিতে যে বস্তি গড়ে ওঠে তার মালিক হন অবৈধ ব্যক্তিগোষ্ঠী। পেশিশক্তির দাপটে চলেন, রাজনৈতিক ও স্থানীয় প্রশাসনের সমর্থন-সহায়তা পান এমন ব্যক্তি অবৈধ পন্থায় বস্তির তথাকথিত মালিক বনে যান।

সম্প্রতি সোনারগাঁওয়ে দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এই নগরীর বস্তিগুলো বহুতল ভবনে প্রতিস্থাপিত হবে, যাতে করে নগরবাসী উন্নত স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে জীবনযাপন করতে পারে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে আরো জেনেছি যে, তিনি বলেছেন, সবাই ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকবে আর আমার বস্তিবাসী থাকবে না, এটা কেমন কথা। বিদ্যুৎ, পানির প্রিপেইড মিটার থাকবে, তারা যতটুকু ব্যবহার করবে তার বিল দেবে। কারণ শহর যত উন্নত হয় তার কাজের জন্য এ ধরনের কর্মীও লাগে। কাজেই তাদের জীবনমানটি যেন উন্নত হয় সেদিকেও ভালোভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর মানবিক, যৌক্তিক এবং উন্নয়ন ভাবনার কথা স্বস্তি এনে দেয় নিঃসন্দেহে। বস্তিবাসীদের নগরে অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করেছেন। একটি সুন্দর নগর কখনোই একাংশ নগরবাসীর সুবিধাভোগ, সুবিধাপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় না। প্রধানমন্ত্রী এই সত্য অনুধাবন করেছেন, বলেছেনও। অনেকটা এরকম, একটা সুন্দর ছবি অঙ্কনের জন্য ক্যানভাসের প্রতি ইঞ্চি জায়গার কথা যেমন একজন চিত্রশিল্পীকে ভাবতে হয়, তেমনি পুরো ক্যানভাসে রংয়ের ব্যবহারে তাকে সৃজনশীল, সতর্ক থাকতে হয়। যদি রাষ্ট্রকে ভেবে নিই একটি ক্যানভাস, তাহলে নিঃসন্দেহে সরকার প্রধান সেই ক্যানভাসের একজন প্রধান চিত্রশিল্পী। প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার কথা, স্বপ্নের কথা নতুন কিছু নয়। নব্বই দশকের শেষ দিকে লাগাতার বস্তি উচ্ছেদের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেন, বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের আগে একটি বস্তিও যেন উচ্ছেদ করা না হয়। এই প্রসঙ্গে আজকে নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা প্রাসঙ্গিকক্রমে খুব বলতে ইচ্ছে করছে। আমি তখন একটি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করি। আমার কাজ নগর এলাকার সুবিধাবঞ্চিতদের নিয়ে। যার একটি অংশ বস্তিবাসী। বস্তিবাসীদের আবাসন সমস্যা নিরসনে, বাসস্থানের মতো একটি মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা তখন তৎপর, সক্রিয়। তৎকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ, ঘোষণা বস্তিবাসীদের মতো আমাদেরও আশ্বস্ত করেছিল। উন্নয়ন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়ে উঠছিল। সম্ভবত একদিন কী দুদিন পর, বাবুপুরা বস্তি উচ্ছেদ করা হলো। ওই বস্তি আমার কর্ম এরিয়ার মধ্যে ছিল। পত্রিকার পাতায় ফলাও করে বস্তি উচ্ছেদের সচিত্র সংবাদ ছাপা হয়েছে। পত্রিকা হাতে সহকর্মীকে নিয়ে ছুটলাম মন্ত্রণালয়ে। উদ্দেশ্য, তৎকালীন ভূমিমন্ত্রীর কাছে কৈফিয়ত চাওয়া পুনর্বাসনের আগে এই উচ্ছেদ কেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে অবমাননা করা হয়েছে, লঙ্ঘন করা হয়েছে, যা তারা পারেন না। সাক্ষাতের কোনো পূর্বানুমতি নেয়া ছিল না। আমিও নাছোড়বান্দা। সাক্ষাতের অনুমতি ও প্রবেশপত্র পেলাম। ভূমি প্রতিমন্ত্রী রাশেদ মোশারফ তার কক্ষে ডেকে নিলেন। তাকে পত্রিকা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আদেশ আমান্য করা হয়েছে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই, এই দেখুন। পত্রিকা হাতে নিয়ে তিনি চুপ হয়ে গেলেন। আমি বললাম, প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকারকে লঙ্ঘন করা হয়েছে, সেই দুঃসাহসের তথ্যটি আপনাকে পৌঁছাতে চেয়েছি মাত্র। মন্ত্রী বাবুপুরা বস্তিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমার অফিস জানল আমি মন্ত্রণালয়ে এসে এতসব করেছি। আরো একজন ঊর্ধ্বতন এসে আমার সঙ্গে যোগ দিলেন। ভূমিমন্ত্রী বাবুপুরা বস্তিতে এসে বস্তিবাসীদের অভয় দিলেন। বস্তিবাসীদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। তারপর আমাদের নিয়ে গেলেন তার মিন্টো রোডের বাসায়। প্রশ্ন করলেন, বলো, তুমি আর কী চাও? আমার কণ্ঠস্বরের কোনো পরিবর্তন নেই। বললাম, প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার তার সরকারের লোকজন যেন রক্ষা করেন। গল্পটা বস্তি আর বস্তিবাসী সম্পর্কিত যতটা, তার অধিক সত্য হলো প্রধানমন্ত্রীর একটি অঙ্গীকারকে অবমাননা করা হয়েছিল সেদিন। এমন অনেক ঘটনাই ঘটে দেশে, যা হয়তো তার অঙ্গীকার, স্বপ্নকে নসাৎ করে বসে তার সরকার বা দলেরই কেউ। এই শ্রেণির লোকজন তার ভাবমূর্তি নষ্ট করে আবার তারই জয়গান করে চলে। এতে সাধারণ জনমনে সরকার সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা জন্মে। যেটাকে সবচাইতে ধ্বংসাত্মক বলে আমার মনে হয়। যা হোক সম্প্রতি সেই একই সরকার প্রধানের কণ্ঠে পুনরায় বস্তিবাসীদের জন্য আবাসনের স্বপ্ন।

নগরবাসী উন্নত স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে যাতে জীবনযাপন করতে পারে সেজন্য এই নগরীর বস্তিগুলো বহুতল ভবনে প্রতিস্থাপিত হবে- এভাবে না ভেবে যদি আমরা ভাবি এবং বিশ্বাস করি, বাসস্থান একটি মৌলিক অধিকার এই বস্তিবাসীদের, এটা নিশ্চিত করা জরুরি এবং সেটাই করবে সরকার। এতে বস্তিতে বসবাসকারী সুবিধাবঞ্চিত মানুষের নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পায়। জনসচেতনতা বাড়ে। আর এভাবে না ভাবলে মানে দাঁড়ায়, বস্তিগুলোর কারণেই হয়তো নগরে উন্নত স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নেই বা থাকছে না। শুধু বস্তির কারণেই নগর উন্নত স্বাস্থ্যসম্মত নয়, এমন মনে করা কতটা যৌক্তিক, তা ভাবার দাবি রাখে। বস্তিতে যারা বসবাস করেন, তারা উপায়ন্ত না দেখে মূলত এমন নাগরিক সুবিধাদি বঞ্চিত জায়গায় বসবাস করেন। এ সব বস্তি কীভাবে গড়ে ওঠে, উঠছে তা কিন্তু আমরা সবাই জানি। সরকারের খাসজমিতে যে বস্তি গড়ে ওঠে তার মালিক হন অবৈধ ব্যক্তিগোষ্ঠী। পেশিশক্তির দাপটে চলেন, রাজনৈতিক ও স্থানীয় প্রশাসনের সমর্থন-সহায়তা পান এমন ব্যক্তি অবৈধ পন্থায় বস্তির তথাকথিত মালিক বনে যান। এ ছাড়া বেসরকারি জায়গাও কিছু বস্তি গড়ে ওঠে। বস্তিবাসীদের মাসিক ভাড়া, ইলেকট্রিক বিল, গ্যাস, পানির বিল পরিশোধ করতে হয়। বস্তির তথাকথিত মালিকরা ভাড়ার সঙ্গে এ সব আদায় করেন। বিভিন্ন বিভাগের কিছু অসাধু, অসৎ কর্মকর্তা, কর্মচারীর সঙ্গে আঁতাত করে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের অবৈধ লাইন সংযোজন করে থাকেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে এইসব বস্তির মালিকগণ। এরা বিল পরিশোধ করেন না বরং অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ দিয়ে, মাসিক মাসোহারা দিয়ে চলেন। উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, পানির সুষ্ঠু সরবরাহ, বৈধ বিদ্যুৎ লাইন সংযোজন, এ সব কিন্তু বস্তিবাসীদের দীর্ঘদিনের চাহিদা। তারা উপযুক্ত বিল পরিশোধ করে এই নাগরিক সুবিধাদি পেতে চান, দীর্ঘদিন ধরে চেয়ে আসছেন। আবার দেখা গেছে যে, ওয়াসা কর্তৃক স্বল্প আয়ের কমিউনিটিতে যে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা চালু আছে, তাতে নিয়মিত বিল পরিশোধ করে আসছেন বস্তিবাসীরা। কোনো বকেয়া নেই তাদের। যেখানে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত শ্রেণির অনেক বিল অপরিশোধিত থাকছে দিনের পর দিন। পয়ঃনিষ্কাশনের বিষয়ে দেখা যায় ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনের সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব ও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। ফলে আবর্জনা অপসারিত হওয়ার উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকছে না। তার ওপর ঠিকাদার ও বিভাগীয় লোকজনের অনিয়ম, দুর্নীতি তো আছেই।

বস্তির মতো একটি নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত জায়গায় বস্তিবাসীরা বসবাস করতে চান না কখনো। দীর্ঘদিনের বাসস্থানের দাবি ও আন্দোলন, তারই ফলশ্রুতি। তারা কখনোই বিনামূল্যে এ সব সুবিধা পেতে চাননি, চান না। মূল্য কিস্তিতে পরিশোধ করে বসবাসের জন্য একটি স্থায়ী আবাসনের দাবি জানিয়ে আসছেন তারা দীর্ঘদিন ধরে। এই বস্তিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী হলো নগরের চালিকাশক্তি। নগরের প্রাণকে সচল রাখেন। পরিচ্ছন্নতা কর্মী, নির্মাণ শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, পোশাক শ্রমিক, কারিগরি শ্রমিক, দিনমজুর, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার স্বল্প আয়ের কর্মচারী ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার মানুষ বসবাস করেন বস্তিতে। তাদের অগ্রাহ্য করে উন্নত ও আধুনিক নগরের চিন্তা অযৌক্তিক, অবাস্তবিক। সুতরাং বস্তিবাসীদের স্থায়ী আবাসন ব্যবস্থা সবার আগে নিশ্চিত করা জরুরি। সমস্যা হলো প্রায় ক্ষেত্রেই বস্তিকে অবৈধ মাদক ব্যবসায়ী, উচ্ছৃঙ্খল রাজনীতিক নেতাকর্মী, প্রশাসনের অসৎ কিছু ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন। ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বস্তি অসামাজিক কার্যকলাপের একটি জায়গা হয়ে দাঁড়ায়। এই অজুহাতে কখনো সখনো বস্তি উচ্ছেদের পাঁয়তারা চলে, উচ্ছেদ হয়। বিত্তের ওপরের সীমায় অবস্থানকারী জনগোষ্ঠী ভেবে নেন, বিশ্বাস করতে শুরু করেন বস্তি হলো অস্বাস্থ্যকর ও সন্ত্রাসের একটি আখড়া। এভাবে বস্তি সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা সমাজে বিস্তার লাভ করে।

পরিশেষে বলি, নগরকে উন্নত স্বাস্থ্যসম্মত করতে নগরের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে হবে এবং সেটা প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে। সে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন ও অঙ্গীকার পূরণে তার সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাজের স্বচ্ছতা থাকতে হবে। আমি বিশ্বাস করি যে, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক দল ও সরকারের কেউ যদি তার ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন কোনো কাজ না করেন, কাজ থেকে নিবৃত্ত থাকেন, তাহলে নির্ঘাত, নিশ্চিত দেশ উন্নয়নের দিকে এগোবে।

স্বপ্না রেজা : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App