×

মুক্তচিন্তা

ভোট সামনে রেখে জোট

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০১৮, ০৭:৩৫ পিএম

বাংলাদেশে ভোট মানেই এখন হচ্ছে জোট। জোট গঠনই প্রাথমিক সিগন্যাল দিবে, ক্ষমতার শক্তিকেন্দ্র কোন দিকে ঝুঁকে আছে। জোট গঠনে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে দল এগিয়ে থাকবে, সেই দল নির্বাচনেও থাকবে এগিয়ে। এদিক থেকে এখনো পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আছে এগিয়ে। ১৪ দল ন্যূনতমভাবে ভাঙার কোনো আশঙ্কা এখনো নেই।

দিন মাস বিচারে এখন দরজায় নির্বাচন কড়া নাড়ছে। তাই ঈদের মধ্যেও নির্বাচনমুখী তৎপরতা আরো দানা বেঁধে উঠেছে। বিগত নির্বাচনের মতো এবারো বিএনপি-জামায়াতের ২০ দলীয় জোট ভোট বয়কট করবে কিনা এবং সেই পথ কতক ডান মধ্য বাম দল অনুসরণ করবে কিনা প্রশ্নটা কুয়াশাচ্ছন্ন থাকলেও প্রাথমিক কাজকর্ম সব দলই শুরু করে দিয়েছে। জোটের পরিধি সম্প্রসারণ কিংবা জোটকে নবরূপে সাজানো, জনসমাবেশ ও প্রার্থী ঠিক করার প্রক্রিয়া প্রভৃতি ইতোমধ্যে সব দল ও জোটই অগ্রসর করে নিচ্ছে। সব দল যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তবে তা দেশের সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য বিশেষ অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। আর গতবারের মতো যদি বয়কটের ধারা অব্যাহত থাকে, তবে হয় বর্তমানের মতো সংসদ চলবে নতুবা অনিশ্চয়তার শঙ্কা সৃষ্টি হবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, সবটাই নির্ভর করছে বিএনপির সিদ্ধান্তের ওপর। গতবার নির্বাচনের সময় আগুন সন্ত্রাস চালিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট চেয়েছিল, নিজের নাক কেটে হলেও পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে। তবে তাতে কেবল নাক কাটা যায়নি, পরের বছর আবারো সেই একই অপকৌশল কার্যকর করতে গিয়ে আম-ছালা দুই-ই হারিয়েছে। বিএনপি এখন সংসদেও নেই, মাঠেও নেই। বিপর্যস্ত দলটির প্রধান দুই নেতা আদালতের রায়ে শাস্তি পেয়ে একজন জেলে আর অপরজন পালিয়ে প্রবাসে। এই অবস্থায় আবারো অরাজকতা-অস্থিরতা সৃষ্টি করে নির্বাচন বয়কট করলে গণতন্ত্রের সংকট অব্যাহত থাকলেও বিএনপির অবস্থা নিঃসন্দেহে আরো খারাপ হবে।

অবস্থাদৃষ্টে যতটুকু মনে হচ্ছে, বিএনপির হাইকমান্ড এটা বুঝতে পেরেছে। আর তাই শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইলেও দলটির নির্বাচনমুখী তৎপরতা ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। প্রসঙ্গত, গত শনিবার কারাগারে বন্দি খালেদা জিয়ার সঙ্গে এককভাবে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেখা করে আসার পর সাংবাদিকদের বলেছেন, ম্যাডামের সঙ্গে ‘রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক বিষয়ে কোনো কথা হয়নি।... তবে উনার মনোবল শক্ত আছে।’ প্রশ্ন যদি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক আলোচনা না হয় তবে মির্জা ফখরুল বুঝলেন কীভাবে, উনার ‘মনোবল শক্ত’ আছে? জনগণকে ‘পাগল বা শিশু’ বা বোকা ভাবার অভ্যাসটা বিএনপির এখনো গেল না।

ফলে ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না প্রবাদটা এখানে প্রযোজ্য হয়ে উঠেছে। নির্বাচন সামনে রেখে বেগম জিয়া যে অবস্থায় পড়েছেন, তাতে উনার মনোবল কতটা শক্ত, তা জনগণ অভিজ্ঞতা থেকে অনুধাবন করতে পারে। আদালতের রায়ে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি হারিয়ে তিনি প্রকাশ্যে কেঁদেছিলেন আর নেতারা প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠতে না পারায় তাদের বলেছিলেন ‘আঙুল চোষা’। এখন এতদিন জেলে থাকার পর বিন্দুমাত্র আন্দোলন না হওয়ায় তার মনোভাব শক্ত থাকবে এমনটা ভাবা যায় না। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে হয় মনটা তার শক্ত নয়, বেশ নরম রয়েছে। আর তাই পরে জানা গেল, ওই সাক্ষাৎকারে তিনি ‘বিএনপির ও ২০ দলীয় ঐক্য ধরে রাখার ওপর জোর দিয়েছেন। পাশাপাশি একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ার যে প্রক্রিয়া চলছে, তা দ্রুত এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন। আন্দোলন ও নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিতে’ বলেছেন।

একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, গতবার তিনি ছিলেন যতটা ‘আপসহীন’ ও শক্ত, এবার ততটাই আপসকামী ও নরম। গতবার তিনি দর্পভরে অসৌজন্যমূলক কথায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেলিফোন কল। একইভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল সংসদের সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের আহ্বান। সরকারের পতন না দেখে তিনি কথিত সেই ‘আন্দোলন’ থেকে সরে না আসার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এবারে!

বিএনপি নেত্রীর কথা থেকেই বোঝা যায়, দলীয় ঐক্য আর সেই সঙ্গে ২০ দলীয় ঐক্য রক্ষা পাবে কি পাবে না প্রশ্নে তিনি সন্দিহান। এইসঙ্গে আন্দোলনের ব্যাপারে সন্দিহান বলেই ‘আপসহীন নেত্রী’র সেই দর্পভাব আর নেই। দণ্ডিত বিধায় তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন কিনা সন্দেহ রয়েছে। তারেক রহমান তো পারবেনই না। নির্বাচন কমিশন আরপিও সংশোধন করলে দণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে বিএনপির প্রধান পদ থেকে মা ও ছেলেকে সরে যেতে হবে। তারপর রয়েছে ২১ আগস্ট মামলাসহ নানা মামলার খড়গ। রাজনীতিতে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করছেন তিনি। এবার বেকায়দা সত্ত্বেও ভোটের পথে না এলে হয়তো জাতিকে আরো একটি গণসমর্থিত দলের হাওয়া ভবনের মতোই হাওয়া হওয়ার দৃশ্যাবলি প্রত্যক্ষ করতে হতে পারে।

তবে এটা ভালোর দিক যে, বিএনপি ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সরকারকে বিচ্ছিন্ন করা এবং ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে এখন বিএনপির টার্গেট আর তাই ‘একটি বৃহত্তর ঐক্য’ গড়ার তৎপরতা চালাচ্ছে। বলাই বাহুল্য এমন ধরনের একটি ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে বিএনপির গলার কাঁটা হচ্ছে জামায়াত। এত শিক্ষার পরও যেহেতু নিবন্ধনহীন জামায়াতকে বিএনপি ছাড়ছে না, তাই এক ছাতার নিচে সরকারবিরোধী এ টু জেড বৃহত্তর ঐক্য বিএনপি গড়তে পারবে না। তবে অবস্থা পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে, বিএনপি এখন দুই পাখায় ভর করে উড়তে চাইছে। দলটির ডান দিকে থাকবে ২০ দলীয় ঐক্যজোট আর বাম দিকে কথিত সেই ‘বৃহত্তর ঐক্য’। রাজনীতির এক সহকর্মী কৌতুক করে আমাকে বললেন, পুতুল এখন পরী হতে চাইছে। তবে নবরূপে সাজতে যাওয়া কি এতটাই সহজ!

আসলে একেবারেই সহজ নয়। ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করতে যাদের বিএনপি বৃহত্তর ঐক্যে শামিল করতে চাইছে, তাদের মধ্যে মূলে রয়েছে চারটি দল- গণফোরাম, বিকল্প ধারা, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য। গণসমর্থনহীন এই চার দলের চার নেতার রাজনৈতিক বায়োডাটা ডিগবাজিতে ভরপুর। ড. কামাল ও ডা. বদরুদ্দোজা ছিলেন যথাক্রমে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে। দুজনই দলে থাকতে না পেরে বাধ্য হয়ে বের হয়ে এসেছেন। আ স ম আব্দুর রব ছাত্রলীগ থেকে জাসদ হয়েছিলেন। পরে এরশাদ আমলে দেশের রাজনীতিতে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ শব্দটির জন্ম দিয়েছিলেন। ভোল একদম পাল্টিয়ে তিনি ১৯৯৬-০১ শাসনামলে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হয়েছিলেন। আর মাহমুদুর রহমান মান্না ছিলেন তীব্র আওয়ামী লীগ বিরোধী জাসদ-বাসদে। তারপর ডিগবাজি দিয়ে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগে।

মজার ব্যাপার হলো, আলাপ-আলোচনায় ‘উনিশ পিপে নস্যি’ শেষ করেও এই চার দল নিজেরা একটি ঐক্যবদ্ধ জোট গড়ে তুলতে পারেননি। শেষ তিনজন গঠন করেছেন যুক্তফ্রন্ট, তারপর যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে প্রথমজন মিলে গড়ে তুলেছেন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া। এই দুই ঐক্যজোট রেখেই গড়তে চাওয়া হচ্ছে কথিত সেই বৃহত্তর ঐক্য। ত্রয়োস্পর্শ হলেই নাকি ঘটে বিপদ! উল্লিখিত সব ঐক্য হলে কত স্পর্শ হবে পাঠকরা ভাবুন তো! আরো মজার ব্যাপার হলো, উল্লিখিত জনসমর্থনহীন চার পার্টির কথিত সেই বৃহত্তর ঐক্য গড়ার দরকষাকষির বহর। শুরু হয়েছিল ১৫১ আসন ছেড়ে দেয়া নিয়ে। এখন এই সংখ্যা কত কে জানে!

সর্বোপরি ওই জোট থেকে নাকি খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার মুক্তি চাওয়া যাবে না। ধারণা করা যায়, জামায়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান থাকবে অন্তত ড. কামালের। ওই ঐক্য গড়ে উঠলে এবং আসন বণ্টনের দিকে গেলে ২০ দলীয় জোটে জামায়াত বিদ্রোহের ঘটনাও ঘটতে পারে। সর্বোপরি এ রকম একটি হ-য-ব-র-ল বৃহত্তর জোট করতে পারবে বিএনপি তা কল্পনা করতে পারবে বলে মানুষ মনে করে না। তবে ওই যে প্রবাদ আছে ফাটা বাঁশের চিপা! ওই চিপায় পড়ে এখন বিএনপিকে অনেক কিছুই গলাধঃকরণ করার চেষ্টা করতে পারে বিএনপি। তবে গলার কাঁটা সব সময়ই গলাধঃকরণের বিপরীতে কাজ করে। তাই বিএনপি উল্লিখিত দুই পাখা একে অপরের পরিপূরক না হয়ে হবে বিপরীতধর্মী। শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়া যায়। কিন্তু হাওয়ায় অবাধে উড়তে পারা যায় না। বিএনপির প্রার্থীরা ইতোমধ্যে এই বৃহত্তর ঐক্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না বলে ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করতে সবাই লন্ডনে ভিড় জমাচ্ছেন। তাই ক্ষত-বিক্ষত দল এবং সামনে বিভিন্ন সব মামলার আগুন জ¦লন্ত রেখে সেই ধরনের উড়ার পরিণাম বিএনপির জন্য হতে পারে ভয়াবহ।

এদিকে জোট গঠনের খেলা যখন বিএনপি খেলছে, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বসে থাকবে এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। রাজনীতির নিয়মই হচ্ছে প্রতিদ্ব›দ্বী এক পক্ষ ডালে ডালে চললে অপর পক্ষকে পাতায় পাতায় চলতে হয়। জানা যাচ্ছে, এই চার দল এবং কর্নেল অলির লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও মেজর জেনারেল অব. ইব্রাহীমসহ ২০ দলীয় জোটের কয়েকটি দলের কাছে ইতোমধ্যে প্রস্তাব গেছে, বিএনপির সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্যে না গিয়ে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য গড়ার। প্রত্যাশা অনুযায়ী সাংসদ, রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী সব দেয়ার প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। প্রত্যাখ্যান বা নীরব থাকার কথা শোনা গেলেও ক্ষমতার রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। খুনি মুশতাক, সেনাশাসক জিয়া ও এরশাদ এবং জরুরি আইনের সময়ের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে সহজেই ধারণা করা যায়, ক্ষমতার ভারে অনেক মান-অভিমান, নীতি-নৈতিকতা চাপা পড়ে যেতে পারে।

পর্দার অন্তরালে এসব প্রস্তাব থাকার বিষয়টির দিকে লক্ষ রেখেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলে দিয়েছেন, জোট-বন্ধুদের জন্য ৭০টি আসন ছাড়বে আওয়ামী লীগ। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ভোট মানেই এখন হচ্ছে জোট। জোট গঠনই প্রাথমিক সিগন্যাল দিবে, ক্ষমতার শক্তিকেন্দ্র কোন দিকে ঝুঁকে আছে। জোট গঠনে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে দল এগিয়ে থাকবে, সেই দল নির্বাচনেও থাকবে এগিয়ে। এদিক থেকে এখনো পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আছে এগিয়ে। ১৪ দল ন্যূনতমভাবে ভাঙার কোনো আশঙ্কা এখনো নেই। জাতীয় পার্টির এরশাদ ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন, বিএনপি নির্বাচন করলে থাকব আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোটে আর বিএনপি নির্বাচন না করলে আলাদা নির্বাচন করব।

এটা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, নির্বাচনের এত কাছে এসে সরকারকে কোনো কিছু করতে বাধ্য করার মতো আন্দোলন শুরু করা আদৌ সম্ভব নয়। মানুষ এখন আর আন্দোলনের মুডে থাকবে না। নির্বাচন-পাগল দেশের মানুষ নির্বাচনের দিকে ঝুঁকে পড়বে। তাই বিএনপি যদি নির্বাচনে যোগ দেয়, তবে আজ থেকে প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের দিন পর্যন্ত চলমান জোট গঠন কিংবা আসন বণ্টন প্রক্রিয়া কি রূপ নিয়ে দাঁড়ায়, তার ওপরই নির্ভর করবে নির্বাচনে বিজয়ী হবে কোন দল, আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপি!

শেখর দত্ত : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App