×

মুক্তচিন্তা

এবার বিএনপির ‘জীবন বাজি রেখে লড়াই’!

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০১৮, ০৯:৪৩ পিএম

সরকারকে ‘বাধ্য’ করার ক্ষমতা বিএনপির আছে কিনা সেটা যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, তেমনি বিএনপির নেতাকর্মীরা ‘জীবন বাজি রেখে’ লড়াইয়ে নামবে কিনা সেটাও দেখার বিষয়। বিএনপির আন্দোলনে সফলতার রেকর্ড নেই। কিন্তু বিএনপির আন্দোলন মোকাবেলার সক্ষমতা আওয়ামী লীগ তথা সরকারের আছে। উভয় পক্ষ মুখোমুখি হলে বোঝা যাবে হার-জিত কার জন্য অপেক্ষা করছে।

চলতি হাওয়া

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হলেও দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল ওই দিনটি দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন করে। খালেদা জিয়ার জন্মদিন যে ১৫ আগস্ট এটা তিনি ১৯৯২ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে জানা যায়নি। তার মা-বাবা কেউ বলেননি তাদের কন্যা খালেদার জন্ম হয়েছিল ১৫ আগস্ট। তার স্কুল সার্টিফিকেট কিংবা বিয়ের কাবিননামা কোথাও জন্ম তারিখ ১৫ আগস্ট উল্লেখ নেই বা ছিল না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জানা গেল খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংসভাবে হত্যা করা করা হয়েছিল। ওই শোকাবহ দিনটিকে খালেদা জিয়া জন্মদিন হিসেবে বেছে নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক কুৎসিত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এবং চরম মানসিক বিকৃতির পরিচয় দিয়েছেন। অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় এটাই যে অনেক পদ্ধতি-বুদ্ধিজীবীও এই খারাপ কাজটির নিন্দা না করে মদদ দিয়েছেন, খালেদা জিয়া ও তার সমর্থকদের কেক কেটে ঘটা করে জন্মদিন পালনকে উৎসাহ জুগিয়েছেন।

ফল কি হয়েছে? আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে রেষারেষি বেড়েছে। সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে। রাজনৈতিক পরিবেশ বিদ্বিষ্ট ও কলুষিত হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। রাজনৈতিক বিষয়ে সমঝোতার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। আমরা এটা স্পষ্ট করেই বলেছি যে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যদি কোনো রাজনৈতিক সমঝোতার সদিচ্ছা বিএনপির থাকে তাহলে একতরফাভাবে তাদের অন্তত তিনটি ঘোষণা দিতে হবে।

১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার স্থপতি এবং জাতির জনক হিসেবে মেনে নিতে হবে। ২. মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী দালালদের বিচারের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে এবং ৩. ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন বন্ধ করতে হবে।

এর কোনোটি করতেই বিএনপি কখনো আগ্রহ দেখায়নি। বরং আওয়ামী লীগের জন্য স্পর্শকাতর এ বিষয়গুলো নিয়েই বিএনপি রাজনীতি করে এসেছে, আসছে। মুখে নিজেদের গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন বলে দাবি করলেও বিএনপি হত্যা-ক্যুয়ের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকেছে, গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগের কয়েকজন জনপ্রিয় নেতা নিহত হয়েছেন। ঘাতকদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। তাদের বরং আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে জনসভায় গ্রেনেড হামলার মতো দুষ্কর্মও সরকারি ছত্রছায়ায় করা হয়েছে।

এখন যারা আওয়ামী লীগের মধ্যে ‘ফ্যাসিবাদী’ প্রবণতা লক্ষ করে উদ্বেগাকুল, আওয়ামী লীগের মধ্যে স্বৈরাচারী মনোভাব দেখে যারা কাতর- তারা কিন্তু বিএনপির রাজনীতিতে ফ্যাসিস্ট ও গণতন্ত্রহীনতা দেখেননি, দেখেন না। বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটি কোনো স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করেনি। বিএনপির গড়ে ওঠা এবং বেড়ে ওঠার মধ্যে নীতিনৈতিকতা, গণতান্ত্রিকতার কোনো বালাই ছিল না। মূলত ক্ষমতার শক্তি ব্যবহার করে, সুযোগ সন্ধানী সামরিক-বেসামরিক আমলা, স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক শক্তি, দলছুট, সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদদের সমন্বয়েই সামরিক ডিকটেটর জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতার ভিত পোক্ত করার জন্য বিএনপি নামক একটি দলের জন্ম দিয়েছিলেন। আর জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলও কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। জাতীয় ঐক্য ও সমন্বয়ের রাজনীতির নামে জিয়া দেশের রাজনীতিতে কতগুলো স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে গেছেন। স্থায়ী অনৈক্যের ভিত গড়ে দিয়ে গেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছেন। পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে দেশে ফেরার সুযোগ করে দিয়েছেন। সংবিধান সংশোধন করে সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ উন্মুক্ত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতি যে মূল্যবোধগুলো অর্জন করেছিল, জিয়া তা বর্জন করে দেশকে পাকিস্তানি ধারায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র প্রশস্ত করেছেন। জিয়া রাজনীতিকে কেনাবেচার পণ্যে পরিণত করেছেন। ছাত্রদের হাতে অর্থ ও অস্ত্র তুলে দিয়ে দেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র আন্দোলনকে বিপথগামী করেছেন। দেশের রাজনীতিতে আজ যে সর্বনাশা অবক্ষয় তা সবই জিয়ার হাত ধরে শুরু হয়েছে। জিয়া রাজনীতিকে দুর্নীতিগ্রস্ত করেছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় বিএনপি ছিল না। কিন্তু জিয়াউর রহমান ছিলেন। ছিলেন উপসেনা প্রধান। ১৫ আগস্টে তার ভ‚মিকা ছিল খুনিদের অনুক‚লে। তারপর তিনি ক্ষমতায় বসে এবং বিএনপি তৈরি করে খুনিদের বিচারের আওতায় না এনে কার্যত ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজের একাত্মতাই প্রকাশ করেছেন। তার মৃত্যুর পরও বিএনপি বঙ্গবন্ধু হত্যা প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি অথবা বলা যায় খুনিদের প্রতি দুর্বলতা দেখাতে ভুল করেনি।

গত ১৬ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিদেশে দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা এবং ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে জাতির পিতার খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করেছিলেন জিয়াউর রহমান। আর তার স্ত্রী খালেদা জিয়া ভোট চুরি করে সেই খুনিদের জাতীয় সংসদে বসিয়েছিলেন। এর অর্থ কি দাঁড়াচ্ছে? জিয়া শুধু নিজেই নন, তার স্ত্রীও ১৫ আগস্ট হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং তাতে কোনো সন্দেহ...’।

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য কারো কারো অপছন্দ হবে কিন্তু এই বক্তব্য যুক্তিহীন নয়। জিয়া এবং খালেদা জিয়া- দুজনেই বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধাভোগী। বঙ্গবন্ধুর প্রতি খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ১৫ আগস্ট ভুয়া জন্মদিন বানানোর মধ্য দিয়ে।

বহু ঘটনা উল্লেখ করে এটা বলা যায় যে বিএনপি গণতান্ত্রিক রাজনীতির চেয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভিন্ন পথকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। দেশে তাদের বিপুলসংখ্যক সমর্থক আছে। তারপরও তারা ষড়যন্ত্রের রাজনীতি থেকে দূরে থাকে না। কিন্তু বিএনপি যতদিন পর্যন্ত গণতন্ত্র চর্চায় অভ্যস্ত না হবে, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি থেকে যতদিন সরে না আসবে, ততদিন আওয়ামী লীগও রাজনীতির বর্তমান ‘দুষ্টচক্র’ থেকে বেরিয়ে আসার গরজ বোধ করবে না। আওয়ামী লীগকে লক্ষ করে বিএনপি ঢিল ছুড়বে আর আওয়ামী লীগ বিএনপির দিকে ফুল ছুড়বে বলে যারা আশা করেন তারা বিদ্যমান বাস্তবতা অস্বীকার করে এক কল্প জগতে বাস করেন।

আত্মরক্ষার জন্য আওয়ামী লীগের অতি সতর্কতা অকারণ এবং অযৌক্তিক নয়। আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনেক ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবেলা করেই সামনে অগ্রসর হতে হয়েছে। ভেতরের এবং বাইরের শত্রু বারবার আওয়ামী লীগকে দুর্বল করতে অপচেষ্টা চালিয়েছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। তারপর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। এই দুটি ঘটনা নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। বিএনপি সুযোগ পেলে আবারো ওই ধরনের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে না- তার নিশ্চয়তা কি বিএনপি দিতে পারবে?

বিএনপি ক্ষমতার বাইরে আছে এক যুগ হতে চললো। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তারা এখন মরিয়া। আওয়ামী লীগবিরোধী সব শক্তি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। আগামী নির্বাচন দেশের জন্য, আওয়ামী লীগের জন্যও বিশেষ পরীক্ষা। নানা ধরনের গোপন তৎপরতার কথা শোনা যাচ্ছে। দেশি-বিদেশি শক্তি সক্রিয়। ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে বিশেষ মহল বিশেষ ছক কেটে অগ্রসর হচ্ছে বলেও বাতাসে কথা ভাসছে। ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক সন্দেহজনক ব্যক্তি। আইনজীবী হিসেবে তার খ্যাতি ও পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে তিনি সুস্থ ধারার রাজনীতির নামে রাজনীতিতে অস্থিরতা তৈরির পাঁয়তারা করেন বলে মনে করা হয়। দেশের বড় বড় সংকটের সময় তার অতীত ভ‚মিকা অস্বচ্ছ এবং রহস্যময়। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য হওয়ার বিষয়টিকে তিনি এখন অতি দক্ষতার সঙ্গে আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা বিরোধিতার কাজে ব্যবহার করেন। সাম্প্রতিক সময়ে তার সক্রিয়তা রাজনীতির আকাশে দুর্যোগের মেঘ জমার ইঙ্গিতবহ কি না সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে ড. কামাল যাদের নিয়ে জোটবদ্ধ হতে চান, তাদের কারো জনসমর্থন নেই। কেবল বিএনপির সঙ্গে ভিড়তে পারলেই ফলপ্রসূ কিছু হতে পারে। তবে রাজনীতির হিসাব-নিকাশ খুব সহজ-সরল হয় না। বিএনপির হিসাব এবং অন্যদের হিসাব একবিন্দুতে মেলার মতো অবস্থা হয়েছে কি না বলা যাচ্ছে না।

খালেদা জিয়া কারাগারে। তিনি কবে মুক্তি পাবেন সেটা কেউ বলতে পারে না। এবারো বিএনপি ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন করেছে। ঘটা করে কেক না কাটলেও তার দীর্ঘায়ু ও রোগমুক্তি কামনায় ঢাকাসহ সারা দেশে দোয়া মাহফিল করেছে বিএনপি। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত দোয়া মাহফিলে কর্মীদের লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আজকে রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য হচ্ছে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার জন্য, গণতন্ত্রকে মুক্ত করার এবং দেশের মানুষের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য আমাদের জীবন বাজি রেখে লড়াই করতে হবে। খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে, সংসদ ভেঙে দিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে এই সরকারকে বাধ্য করতে হবে’।

সরকারকে ‘বাধ্য’ করার ক্ষমতা বিএনপির আছে কিনা সেটা যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, তেমনি বিএনপির নেতাকর্মীরা ‘জীবন বাজি রেখে’ লড়াইয়ে নামবে কিনা সেটাও দেখার বিষয়। বিএনপির আন্দোলনে সফলতার রেকর্ড নেই। কিন্তু বিএনপির আন্দোলন মোকাবেলার সক্ষমতা আওয়ামী লীগ তথা সরকারের আছে। উভয় পক্ষ মুখোমুখি হলে বোঝা যাবে হার-জিত কার জন্য অপেক্ষা করছে।

বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App