×

মুক্তচিন্তা

মেরামত না, চাই যত্ন আর পরিচর্যা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০১৮, ০৭:৩৩ পিএম

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর যে অডিও টেপ আমরা শুনলাম সেটাতো পরিষ্কার ইন্ধন। অপর প্রান্তে থাকা যুবকটি যখন বলছিল মানুষ তাদের সঙ্গে আছে। সমর্থন দিচ্ছে নেতা বলল : তাতে কি লাভ? তোমরা লোকজন নিয়ে নেমে পড়ো। ঢাকা অচল করে দাও। এটাই কি চেয়েছিল রাস্তায় নামা আমাদের বাচ্চারা? তারা কি রাস্তা অচল করতে চেয়েছিল? না তারা চেয়েছিল সচল পথ আর নির্বিঘ্ন জীবন? শান্তি ও সহযোগিতার বিষয়টা আমাদের অভিধান থেকে বিলুপ্ত।

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া

সম্প্রতি ভোরের কাগজের সম্পাদক এসেছিলেন সিডনি। আমার আবাল্যবন্ধু শ্যামল দত্ত। একসঙ্গে বড় হয়ে উঠেছিলাম আমরা। তার সঙ্গে আলাপ করার সুযোগে দেশের একটা হালচিত্র পাওয়া গেল। তার সম্মানে আয়োজিত এক সভায় যে বক্তব্য শুনলাম তাতে অনেক নতুন বিষয় উঠে এসেছিল। আমরা দূরদেশের মানুষ। বুকে মগজে বাংলাদেশকে ধারণ করলেও বাস্তব চিত্র অনেক সময় অধরা থেকে যায়। সেটাই স্বাভাবিক। জানলাম যে বাংলাদেশ আমরা দেখে এসেছি বা যার ছবি আমরা মনে ধরে রাখি তার সঙ্গে বাস্তবতার ব্যাপক তফাত এখন। বিশেষত শ্যামল যখন তারুণ্যও বদলে যাওয়া জীবনবোধ নিয়ে কথা বলছিলেন আমাদের বোধোদয়ের নতুন পাতা খুলতে শুরু করল বৈকি।

এই বাংলাদেশ সে বাংলাদেশ না। হওয়ার কথাও না। মানুষ পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীল বলেই আমাদের অগ্রজ বা মা-বাবাদের কাছে আমরা ছিলাম অচেনা। মনে আছে একাত্তরে বালক বেলায় আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ ও আদর্শের রাজনীতি দেখেছি তখন অগ্রজদের এক বিরাট অংশ মনে করতেন এগুলো হুজুগ। তাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল আমরা যেহেতু একটা ভীতু জাতি যেহেতু আমরা শারীরিকভাবে দুর্বল কিছুতেই পাকিদের সঙ্গে পেরে উঠব না। অথচ তখন নবীন রক্তের সঙ্গে মিলেছিল প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতৃত্ব। একদিকে বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদ সৈয়দ নজরুলদের ভাবনা আরেকদিকে তারুণ্যের টগবগ করা আশা। দুয়ে মিলে যে উচ্ছ¡াস তার স্রোতেই জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ। আজ আর এক প্রজন্ম একাধিক নতুন প্রজন্ম এসে ভিড় করেছে দৃশ্যপটে। এই প্রজন্ম আমাদের মতো না। আমরা এখন কম্পিউটার বা মোবাইল এসব যন্ত্র ছাড়া থাকার কথা চিন্তাও করতে পারি না। আমাদের এগুলো ব্যবহার করতে হয় বলে করি। কিন্তু আমরা কি আসলেই এগুলোর ব্যবহার জানি? মূলত অজ্ঞ আর মূর্খ আমরা। খেয়াল করেছি প্রযুক্তি বিষয়ক প্রশ্ন করলে সন্তানরা পিতা মাতার মুখের দিকে এমনভাবে তাকায় যেন এমন অজ্ঞ মানুষ তারা জীবনে আর একজনও দেখেনি। এর কারণ আমাদের পিছিয়ে থাকা মেধা আর প্রযুক্তি বিষয়ক দুর্বলতা। প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানে যত দূরত্ব থাকুক এই দুনিয়ায় প্রযুক্তি ছাড়া চলা যাবে না।

প্রযুক্তিনির্ভর এই তারুণ্যকে আমরা কোনোভাবেই অবহেলা করতে পারি না। তাদের আমরা অসংগঠিত কিংবা বিচ্ছিন্ন মনে করলেও তারা যে তা না সেটার প্রমাণ মিলেছে রাস্তায়। বুকে হাত দিয়ে বলুন কবে এমন প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ দেখা গেছে? বিএনপি ও বিরোধীদল নামে পরিচিত অকার্যকর রাজনৈতিক শক্তির লজ্জা নেই বলে মুখে বড় বড় কথা বলছে। বাস্তবে বাচ্চারা তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মানুষের মনে কত রাগ আর বেদনা লুকিয়ে। সে বেদনা বোঝার শক্তি হারানো রাজনীতি আজ এই বাচ্চাগুলোকে নিয়ে খেলতেও দ্বিধা করছে না। সেটাই দুর্ভাগ্যের। তারা যখন রাস্তায় নেমে এসেছিল তখনও বিরোধী দল টের পায়নি এর গুরুত্ব বা শক্তি আসলে কতটা। এই বিষয়টা আমরা কোটা আন্দোলনের সময়ও দেখেছি। তখনও গোড়ার দিকে আন্দোলনকারীদের বুঝতে অসমর্থ অপশক্তি নীরব ছিল। যে মুহূর্তে তারা নিশ্চিত হলো এরা অদম্য তখনই তারা এদের ন্যায্য আন্দোলন আর চাওয়াকে পুঁজি করে এমন জলঘোলা করল মানুষও বিরক্ত হয়ে বলতে শুরু করেছিল: অনেক হয়েছে এবার থামো। তাহলে বাস্তবে কারা আসলে আন্দোলন নষ্ট করেছে? কাদের হাতে পড়ে ন্যায্যতা অন্যায্য হয়েছে?

এবারের ঘটনায় বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর যে অডিও টেপ আমরা শুনলাম সেটাতো পরিষ্কার ইন্ধন। অপর প্রান্তে থাকা যুবকটি যখন বলছিল মানুষ তাদের সঙ্গে আছে। সমর্থন দিচ্ছে নেতা বলল : তাতে কি লাভ? তোমরা লোকজন নিয়ে নেমে পড়ো। ঢাকা অচল করে দাও। এটাই কি চেয়েছিল রাস্তায় নামা আমাদের বাচ্চারা? তারা কি রাস্তা অচল করতে চেয়েছিল? না তারা চেয়েছিল সচল পথ আর নির্বিঘ্ন  জীবন? শান্তি ও সহযোগিতার বিষয়টা আমাদের অভিধান থেকে বিলুপ্ত। এখন কথিত নেতারা চাইছে নতুন প্রজন্মও যেন শান্তি না পায়। এর মতো অপরাধ আর কি হতে পারে? আমি খুব খেয়াল করে দেখেছি বিএনপির একজন নেতাও দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতে পারেনি। উস্কানি আর সরকার বিরোধিতা ছাড়া কিছুই ছিল না তাদের কথায়। যে মন্ত্রীর হাসির কারণে এত গণ্ডগোল তার ব্যাপারেও তারা খুব সরব ছিলেন কি? তাদের সবার তলে তলে একটাই চাল যে ভাবে হোক সরকার হটানো। মজার ব্যাপার এই বাচ্চারা যখন রাস্তায় ব্যস্ত যখন তারা রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে বলে বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছিল তখন সুশাসনের জন্য নাগরিক নামের সংগঠনের এক সুশীলের বাসায় মিটিং করছিলেন ড. কামাল হোসেনরা। তারা কি মাঠে নেমে বাচ্চাদের কাছে যেতে পারতেন না? তারা কি তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারতেন না? তারা তা করেননি। কারণ তাদের জানের ভয় আছে। তারা লাঠিকে ভয় পায়। কি সাংঘাতিক। নিজেরা লাঠিকে ভয় পায় আর বাচ্চাদের ঠেলে দেয় লাঠির মুখে।

সে মানুষগুলো কীভাবে নতুন প্রজন্মের ভাষা বুঝবে? নতুন প্রজন্ম কি চায় কেন চায় সেটা আমি শ্যামল দত্তের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি কিছুটা। তা ছাড়া আমরা যখন দেশে যাই বা যখন এখান থকে যুক্ত হই তখন নিঃসন্দেহে বুঝতে পারি তারা অগ্রগামী। তাদের মুখের ভাষা বদলে গেছে বটে চিত্ত বা মনে তারা স্বদেশের মানুষ। তারাতো সে প্রজন্ম যারা জন্ম থেকে স্বাধীন। আমরা দুই দেশ ড. কামাল হোসেনরা তিন দেশের নাগরিক। এরা ব্রিটিশ পাকিস্তান তারপর স্বদেশের নাগরিক। বাচ্চারা তা না। তারা জন্মেই জেনেছে দুশমন থেকে দেশ স্বাধীন হয়েছিল রক্তের বন্যায়। তাদের সামনে আছে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা। তাই তারা শত উস্কানির মুখেও শক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধু আর আমাদের শহীদদের কথা বলছিল। এ সব বাচ্চা আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের ওপর ওঠানো লাঠির অযৌক্তিকতার বিচার হোক। বিচার হোক সেসব মানুষের যারা মৃত্যুতেও উল্লাস করতে জানেন। সঙ্গে তাদেরও বিচার হোক যারা এই প্রজন্মকে আসামি করে খালেদা জিয়ার মুক্তি চায়। যাদের অন্তরে জামায়াত যাদের ইচ্ছা দেশকে আবারো বর্বরযুগে ফিরিয়ে নেয়া তাদের ফাঁদে পা দেয়নি বাচ্চারা। মরতে মরতে বেঁচে গেছে এরা। সে ভাগ্য যেন আর কখনো ফিরে না আসে।

শেখ হাসিনার বলিষ্ঠতায় এখনো আমরা অন্ধকার যুগ এড়িয়ে চলছি বটে তবে একটা অনুরোধ করব। আওয়ামী লীগের বয়সী নেতাদের পাশাপাশি এখন তারুণ্যকে সামনে আনার সঠিক সময়। সেটা না হলে তারাও হালে পানি পাবেন না। প্রয়াত সাংবাদিক লেখক সন্তোষ গুপ্ত একবার দুঃখ করে আমাকে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের জনসভায় চল্লিশোর্ধ্ব মানুষের ভিড় দেখে তিনি একটা লেখা লেখার পর দল আর তাকে কোনো আয়োজনে দাওয়াত করত না। কি মুশকিল আর কি অভব্যতা। সময় পাল্টেছে। সরকারি দলকে তারুণ্যের ভাষা বুঝতেই হবে। তাদের তরুণ তরুণীদের দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। না হলে সামনের নির্বাচনে ভালো করা কঠিন হবে।

জবাবদিহিতা আর স্বচ্ছতার প্রশ্নে আজকের প্রজন্ম যে ভূমিকা রেখে গেছে যে রক্তের দাগ মাটি শুষে নিয়েছে আত্মশুদ্ধি ছাড়া তা থেকে পরিত্রাণ নেই। সরকারি দলকে তা বুঝতে হবে। নতুন প্রজন্মের নতুন ভাষা নতুন চিন্তা নতুন প্রেরণা যেন লাগাম না হারায়। সে দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বাংলাদেশ যে নতুন প্রজন্মের ওপর ভরসা করে চলবে তাদের যত্ন  করার সময় এখন দোরগোড়ায়। তাদের ভালো রাজনীতি আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার কাজটিও শুরু হোক তাহলে রাষ্ট্র মেরামতের কথাই উঠবে না কোনোদিন।

 

সিডনি থেকে অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App