×

মুক্তচিন্তা

নানকার স্মৃতিসৌধ : কমিউনিস্ট পার্টি থেকে সাংস্কৃতিক কমান্ড

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০১৮, ০৭:৫৬ পিএম

আশির দশকের শেষের দিকের বিপ্লবে উন্মাতাল করা সেই দিনগুলো এখনো ভাবতে গেলে স্মৃতিকাতর হয়ে যাই আমরা। হয়তো পারিনি টিকে থাকতে, কিন্তু সেই দীক্ষাই আমাদের প্রাণিত করে, পথ দেখায় আগামীর দিকে। আর সে জন্যই শিকড় খোঁজতে যাওয়া বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই যখন যাই, তখন সেই সৌধটা আমাকে টানে। নানকার স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে সোনাইর স্রোত দেখি, ভাবতে থাকি একদিন এই খরস্রোতা নদীর রক্তস্রোতই পাল্টে দিয়েছিল সভ্যতার চাকা।

লন্ডন থেকে

আজকের বিয়ানীবাজারকে একটা সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে। এ জনপদের মানুষগুলোর পূর্বসূরিদের কথা বারবার উচ্চারিত হয় বিভিন্নভাবেই। সমাজ-সভ্যতার প্রগতির চাকায় সেই পূর্বসূরিরা আমাদের আলোকবর্তিকা হিসেবে এখনো পথ দেখাচ্ছেন। সাহিত্যে মহেশ্বর ন্যায়লংকার থেকে শুরু করে অনেক সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীর প্রজ্ঞার প্রতিফলন হয়েছিল সেই আদিকালে। বিয়ানীবাজার ও আরো কিছু এলাকার মিলিত নাম ছিল পঞ্চখণ্ড, এই পঞ্চখণ্ড ছিল পণ্ডিতদের চারণভূমি। আর সে কারণেই আজকের বিয়ানীবাজার পরিচিত ছিল সে আমলের ক্ষুদে নবদ্বীপ হিসেবে। ঠিক সেভাবেই সংগ্রাম কিংবা সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে এ এলাকার মানুষের আত্মদান কিংবদন্তি হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়।

অগ্নিযুগে বাংলার মানুষ জড়িয়েছিল অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে। ব্রিটিশদের শাসন-শোষণ থেকে স্বাধীনতা পেতে সারা ভারতের মানুষের সঙ্গে এই বিয়ানীবাজার কিংবা পঞ্চখণ্ডের সংগ্রামী মানুষগুলোও জড়িয়েছিল। নেতৃত্বের সারিতে ছিলেন ছইদ আলীর (কংগ্রেস নেতা) মতো অনেকেই। সংগ্রাম আর রক্তাক্ত ইতিহাস পেরিয়ে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলেও সামন্ততান্ত্রিক শোষণ যেন আরো পোক্ত হয়। ব্রিটিশদের জিইয়ে রাখা শ্রেণি আর বৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকে অখণ্ড পাকিস্তানের অগণিত মানুষ। ব্রিটিশদের তৈরি করা শোষক শ্রেণি দেশ বিভাগের পর দাপটের সঙ্গেই রাজত্ব করতে থাকে। জমিদারি শোষণে শ্রমজীবী মানুষগুলো নিষ্পেষিত হতে হয় বংশ পরম্পরায়। আজকের ইতিহাসে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাটা উচ্চারিত না হলেও এই ব্যবস্থায় মানুষকে নির্যাতন নিগ্রহ করা ছিল তৎকালীন জমিদারদের নিত্যদিনের সংস্কৃতি। মুখ আর চোখ বুঁজে সহ্য করতে হতো এসব নির্যাতন। এই নির্যাতন-নিপীড়ন দিনের পর দিন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সয়ে যেতে হয়েছে শ্রমজীবী মানুষকে, অনাহার-অর্ধাহারকে তাদের নিয়তি ভেবেই। কিন্তু ইতিহাসের একটা অনিবার্যতার কাছে শোষণ-নির্যাতনকারীদেরও হোঁচট খেতে হয়েছে। ক্ষমতা-দম্ভ-রাষ্ট্র সব রক্তচক্ষুর বিপরীতে গিয়ে মানুষ যে কীভাবে এগিয়ে আসে, তাই আমাদের দেখিয়ে দেয় ইতিহাস। তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে তরুণ নেতা জমিদারদেরই বংশধর কমরেড অজয় ভট্টাচার্য স্থানীয়ভাবে সংঘটিত করতে থাকেন এ এলাকার আন্দোলন। এ ছাড়া ছিলেন কমরেড সুরত পাল, কমরেড অনিতা পাল, কমরেড অনিতা পালসহ অনেকেই। তাদের নেতৃত্বে বিয়ানীবাজারের শানেশ্বর-উলুউরি গ্রাম গর্জে উঠে। কমিউনিস্ট পার্টির ছায়াতলে মানুষ তাদের অধিকার নিয়ে জড়ো হয়। শুরু হয় নতুন বিপ্লবের জন্য জান বাজি রাখা যুদ্ধ, শাসকের বিরুদ্ধে, শোষণ মুক্তির লক্ষ্যে। মুক্তির লড়াই, অথচ অপপ্রচার ছিল ধর্মদ্রোহীদের আন্দোলন। যুগে যুগে এভাবেই ধর্ম ব্যবহৃত হয়, ধর্মকে ব্যবহার করেই আজো প্রগতির পথ রুদ্ধ করতে চায় যেমন উগ্র ধার্মিকরা এই বাংলাদেশে, ঠিক তেমনই ধর্মনিয়ন্ত্রিত দেশ ভারতেও এর বিস্তার যেন রুদ্ধ করা যাচ্ছে না। কিন্তু কোনো অপপ্রচারেই তখন সাধারণ মানুষকে দমাতে পারেনি কেউ। শোষিত মানুষ আর ঘরে ফেরেনি। রক্তস্নাত হয় শানেশ্বর আর উলুউরী গ্রাম। সোনাই নদী তীরবর্তী স্থানে আন্দোলনরত মানুষের ওপর গুলি চালায় পাকিস্তানি শাসকের তাবেদার বাহিনী অর্থাৎ মুসলিম লীগ সরকার। রজনী দাশ, ব্রজনাথ দাশ, প্রসন্ন কুমার দাস, পবিত্র কুমার দাস, অমূল্য কুমার দাস, কুটুমনি দাসের রক্তের ধারা গড়ায় সোনাই নদীর স্রোতধারায়। বিপ্লবীদের রক্তস্রোতে শোষক তথা রাষ্ট্রক্ষমতার ভিতে কাঁপন ধরায়। ১৮ আগস্ট ১৯৪৯ সালের শানেশ্বর-উলুউরীর এই রক্তই শেষ পর্যন্ত সারা পূর্ববঙ্গে নানকার প্রথা বিলুপ্তি টানে। পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয় সরকার। শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ত্রিশের দশকে শুরু হওয়া টংক-তেভাগা-নানকার আন্দোলন মুক্তিকামী মানুষের বীরত্বগাথারই আন্দোলন। মুক্তির সংগ্রামে সাধারণ মানুষের বিজয়ী হওয়ার অধ্যায় এগুলো। বিয়ানীবাজার তথা সারা পূর্ব পাকিস্তানেই নানকার আন্দোলন কমিউনিস্টদের ছিল একটা সফল আন্দোলন, মানব মুক্তির সংগ্রামের এক অনন্য বিজয়।

১৯৮৮ সালে সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতা কমরেড বারীন দত্তের (আব্দুছ ছালাম) উপস্থিতিতে প্রথম একটা জনসভা হয়। সময়ের স্রোতধারায় ১৯৯১ সালে কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা যিনি আজকের বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীর (নুরুল ইসলাম নাহিদ) নেতৃত্বে সোনাই নদীর তীর ঘেঁষে নানকার আন্দোলনের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।

তারপর সময় আমাদের ঠেলে দেয় কোনো অজানায়, আমরা কোনো না কোনোভাবে দেশ ছাড়ি। একঝাঁক তরুণ যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দেয়। রাজনীতিতে হয় নতুন মেরুকরণ। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের ভাঙনের সুর বাজে বাংলাদেশেও। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার অনেক নেতাই পুঁজিবাদ আর মুক্তবাজার অর্থনীতির হাওয়ায় নিজেকে পাল্টে নেন। স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির হাওয়ার সে জাপটা বিয়ানীবাজারেও অনেক কিছুই পাল্টে দেয়। থমকে যায় নানকার স্মৃতিসৌধের কাজও। কিন্তু এরপরও ইতিহাসের গতিধারার অনিবার্যতাকে রুখতে পারে না কেউই। কেউ না কেউ এগিয়ে আসে। প্রগতির ঝাণ্ডা যারা উড্ডিন রাখতে চায়, তারা যে রাজনীতির আদর্শে বিশ্বাসী হোক না কেন, তারা আগায়। সেরকমই একটা সংগঠন বিয়ানীবাজার সাংস্কৃতিক কমান্ড। সেই সংগঠনটির সার্বিক ব্যবস্থাপনায় আজকের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত নানকার স্মৃতিসৌধ মাথা তোলে দাঁড়ায়, ইতিহাসের পাতায় নতুন সে অধ্যায় সূচিত হয় ২০০৯ সালে। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আরেকটা সংগঠনের নাম সংযুক্ত হয়, আর সেটা হলো বিয়ানীবাজার সাংস্কৃতিক কমান্ড।

আশির দশকের শেষের দিকের বিপ্লবে উন্মাতাল করা সেই দিনগুলো এখনো ভাবতে গেলে স্মৃতিকাতর হয়ে যাই আমরা। হয়তো পারিনি টিকে থাকতে, কিন্তু সেই দীক্ষাই আমাদের প্রাণিত করে, পথ দেখায় আগামীর দিকে। আর সে জন্যই শিকড় খোঁজতে যাওয়া বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই যখন যাই, তখন সেই সৌধটা আমাকে টানে। নানকার স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে সোনাইর স্রোত দেখি, ভাবতে থাকি একদিন এই খরস্রোতা নদীর রক্তস্রোতই পাল্টে দিয়েছিল সভ্যতার চাকা। সামন্তবাদের পতন ঘটিয়েছিল এ রক্তস্রোত, বর্বর জমিদারদের অত্যাচার-নির্যাতন-যৌনতা তথা শোষণের প্রাথমিক জাঁতাকল ভেঙেছিল এ রক্তস্রোত।

সোনাই নদীর সে স্রোত এখন নেই। ধীরে চলা সোনাইর জলের মতোই এই সভ্যতায় যেন আটকে গেছে শৃঙ্খল ভাঙার শপথ। স্বপ্ন দেখি, অজয় ভট্টাচার্যদের মতে কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে, কোটি কোটি জনতার বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়ে গড়বে একটা সুন্দর উজ্জ্বল বাংলাদেশ।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App