×

জাতীয়

সরিষাবাড়িতে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের অভিযোগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০১৮, ১২:৫৯ পিএম

সরিষাবাড়িতে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের অভিযোগ
সরিষবাড়িতে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা ও কাবিটা) কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা ভুয়া প্রকল্প এবং নামমাত্র কাজ করে শতভাগ কাজ দেখিয়ে কোটি টাকা লোপাট করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এতে স্থানীয় শ্রমজীবী মানুষ বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি বেস্তে গেছে সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। গত এক সপ্তাহ সরিষাবাড়ি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে সরেজমিন খোঁজ নিয়ে কাবিখা, কাবিটা ও হতদরিদ্রদের জন্য চল্লিশ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্প বাস্তবায়নে এসব অনিয়ম দুর্নীতির চিত্র পাওয়া গেছে। সরিষাবাড়ি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা প্রশাসন ২০১৭-১৮ অর্থবছরের কাবিখা (সাধারণ) দ্বিতীয় পর্যায়ের উন্নয়ন খাতে ৬টি প্রকল্পের অনুক‚লে ১৪৭.৩৮৬ টন চাল, কাবিটা কর্মসূচির আওতায় টাকার পরিবর্তে ৬টি প্রকল্পের অনুক‚লে ৮৩.৪০৪ টন চাল এবং অতিদরিদ্রদের জন্য চল্লিশ দিনের কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪০টি ওয়েজ প্রকল্পের অনুক‚লে ৩ হাজার ২৪০ শ্রমিকের ৪০ দিনের মজুরি বাবদ ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ৩৮টি নন ওয়েজ প্রকল্পের অনুক‚লে ১১ লাখ ৭৫ হাজার ৮৭৫ টাকা ও প্রকল্পের সাইনবোর্ড পিআইসি আনুষঙ্গিক বাবদ ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের নানা অভিযোগে ভিত্তিতে গত সপ্তাহে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিংনা ইউনিয়নের বারইপটল পালপাড়া ভাঙ্গা থেকে বাদলের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের জন্য উপজেলা প্রশাসন কাবিটা দ্বিতীয় পর্যায়ে বরাদ্দ থেকে গত ৮ মে সাড়ে ৭ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। ওই এলাকার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম ও শঙ্কর চন্দ্র পালসহ উপস্থিত গ্রামবাসীরা জানান, গত ৪ বছরের মধ্যে এই রাস্তাটির কোনো কাজ হয়নি। প্রকল্পের সভাপতি পিংনা ইউনিয়নের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য মীনা রানী বলেন, আমি প্রকল্পের সভাপতি হিসেবে শুধু স্বাক্ষর করেছি। কাজের বিষয়ে চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন বলতে পারবেন। এই প্রকল্পের কাজের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেনের কাছে জানতে চাইলেও তিনি কোনো সুদোত্তর দিতে পারেনি। উপজেলার কামরাবাদ ইউনিয়নের স্থানীয় সংসদ সদস্যের বরাদ্দ থেকে কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) প্রথম পর্যায়ের বরাদ্দ থেকে ডিগ্রিপাঁচবাড়ি সোরহাব আলীর বাড়ি থেকে দক্ষিণে ছাইফুল মেম্বারের বাড়ির সামনে ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার কাজের জন্য ৫ লাখ টাকা একটি প্রকল্প দেয়া হয়। এই প্রকল্পের সভাপতি ছিলেন সাবেক মেম্বার আশেক আলী। প্রকল্পের কাজের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকার (অর্ধেক) কাজ করার কথা স্বীকার করে বলেন, আমাকে ২ লাখ ২৪ হাজার টাকা দেয়া হয়। এই প্রকল্পের সম্পূর্ণ টাকা উত্তোলন করা হলেও তাকে অবশিষ্ট টাকা না দেয়ায় তিনি কাজ সমাপ্ত করতে পারেননি। একই রাস্তায় কর্মসৃজন প্রকল্প দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এই ওয়ার্ডের বড় বাড়িয়া চৌধুরী বাড়ির মোড় থেকে ভিপি ফজলের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের জন্য কাবিটা সাধারণ উন্নয়ন প্রথম পর্যায়ের বরাদ্দ থেকে ১ লাখ ৮৪ হাজার ২৫ টাকার একটি প্রকল্প দেয়া হয়। একই রাস্তার নাম পরিবর্তন করে ডিগ্রিপাঁচবাড়ি জামালের বাড়ি থেকে মরহুম ভিপি ফজলের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের জন্য কাবিটার কর্মসূচির সাধারণ দ্বিতীয় পর্যায়ের বরাদ্দ থেকে সাড়ে ৪ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। যার সরকারি মূল্য ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। এ ছাড়া এই রাস্তায় কর্মসৃজন কর্মসূচির প্রকল্প দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ স্থানীয়দের। এক অর্থবছরে একটি প্রকল্প দেয়ার নিয়ম থাকলেও তা না মেনে একাধিক প্রকল্প দেখিয়ে সরকারি অর্থ লোপাট করা হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিদের যোগসাজশে কামরাবাদ ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি রাস্তায় একাধিক প্রকল্প দেখানোর পাশাপাশি হতদরিদ্রদের জন্য চল্লিশ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের ২২৪ শ্রমিকের বরাদ্দকৃত ১৮ লাখ ৪ হাজার টাকাসহ লাখ লাখ টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। উপজেলার আওনা ইউনিয়নের কাবিখা বিশেষ বরাদ্দ হিসেবে ৫টি প্রকল্পের অনুক‚লে ৬০ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, এসব প্রকল্পের মধ্যে বাটিকামী আওনা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তনুআটা হয়ে কাবারিবাড়ি আজাহার মাস্টারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মাটি দ্বারা মেরামতে জন্য ১৫ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। এ রাস্তায় শুধু ঘাস পরিষ্কার করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে। একই ইউনিয়নের কাবারিবাড়ি লতিফের বাড়ি থেকে শহীদ নগর রেলস্টেশন পর্যন্ত মাটির রাস্তা সংস্কারের জন্য কাবিখা বিশেষ প্রকল্প থেকে ১০ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রকল্পের সভাপতি মো. মেছের খানের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললে তিনি জানান, ৫ টন চালের মূল্য বাবদ ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা পেয়েছেন। এর মধ্যে ৭৫ হাজার টাকা কাজ করেছেন। বাকি চালের টাকা পাননি তিনি। অথচ প্রতি চাল সরকারি মূল্য ধরা হয়েছে সাড়ে ৩৮ হাজার টাকা। বর্তমান বাজার মূল্যও রয়েছে প্রায় সমান। এ বিষয়ে আওনা ইউপি চেয়ারম্যান মো. বেলাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, কাবিখা বিশেষ বরাদ্দের কাজ বিশেষ ব্যক্তিরা করে থাকেন। এই কাজে বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না বা এই কাজের সঙ্গে চেয়ারম্যানদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। জেলা প্রশাসন কাবিখা বিশেষ বরাদ্দ থেকে সরিষাবাড়ি উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের ৪টি প্রকল্পের জন্য ১০০ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে ভাটারা ইউনিয়নে পূর্বভাটার সিরাজের সেমাই মিল থেকে পুকুরিয়া শাহজাহানের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের জন্য ২৫ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হলেও এই রাস্তায় নামে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে সম্পূর্ণ চাল আত্মসাৎ করা হয়েছে এমনি অভিযোগ স্থানীয়দের। একই ইউনিয়নের পাড়পাড়া আসাদের দোকান থেকে বড়বাড়ি মোড় পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের জন্য ২৫ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। এই রাস্তায় ১৫ থেকে ২০ জন শ্রমিক দিয়ে ৫/৬টি গর্ত ভরাট করে নামমাত্র কাজ করেই অর্থ লোপাটের অভিযোগ করেন স্থানীয়রা । একই রাস্তায় কর্মসৃজন প্রকল্পও দেখানো অভিযোগ উঠেছে ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে ইউপি চেয়াম্যান সাথে বার বার মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। কাবিখা বিশেষ প্রকল্প থেকে আওনা ও পোগলদিঘা ইউনিয়নের ২টি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ দেয় হয় ৫০ টন চাল। এই প্রকল্প ২টি কাগজে কলমে বাস্তবায়ন দেখিয়ে বরাদ্দকৃত চাল আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এই প্রকল্প ৪টির সভাপতি যথাক্রমে ভাটারার সবুজ মিয়া ও ফারুখ হোসেন, আওনার বিলকিস সুলতানা ও পোগলদিঘার লিটন মিয়া। তবে এদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ঠিকানা বা মোবাইল নম্বর দিতে পারেনি প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। কাবিখা, কাবিটা ও হতদরিদ্রদের জন্য ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রতিটি প্রকল্প জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রতটি প্রকল্পের দর্শনীয় স্থানে বরাদ্দকৃত অর্থ, শ্রমিকের সংখ্য ও বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করে সাইন বোর্ড ঝুঁলিয়ে রাখার নিয়ম রয়েছে। এসব সাইন বোর্ডের খরচের জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ দেয়া সত্তে¡ও স্থানীয় প্রশাসন তা না করায় প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা সরকারি অর্থ লোপাটের সুযোগ পান বলে মন্তব্য স্থানীয়দের। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচি (কাবিখা-কাবিটা) ও অতিদরিদ্রদের জন্য চল্লিশ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরিষাবাড়ি উপজেলায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে অনেক প্রকল্পের হদিস মিলবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কাবিখা, কাবিটা ও কর্মসৃজন প্রকল্প বাস্তবায়নের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে সরিষাবাড়ি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে, তিনি বলেন, আমি খÐকালীন দায়িত্বে রয়েছি। সব প্রকল্প ঘুরে দেখার সুযোগ হয় না। যদি কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে তদন্তপূর্বক সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের সভাপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App