×

মুক্তচিন্তা

অটল বিহারি অস্তাচলে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০১৮, ১০:০৩ পিএম

কলকাতা থেকে

তীব্র বাগ্মী অসাধারণ স্মৃতির অধিকারী ছিলেন কবি ও রাষ্ট্রনায়ক অটল বিহারি। কবিতা লেখায় তার হাতেখড়ি বাবা কৃষ্ণবিহারি বাজপেয়ির কাছে। কলেজস্তরে পড়াশোনাও সাহিত্য নিয়ে। হিন্দি, ইংরেজি সংস্কৃত। তার অসাধারণ বাগ্মিতা অনেক সময় পুষ্ট হতো কবিতার পঙ্ক্তিতে। মানব কল্যাণের শাশ^ত দর্শনকে বিভিন্ন আঙ্গিকে তার কবিতায় তুলে ধরেছেন। তার লেখা কবিতার বেশ কিছু বই রয়েছে। তার মধ্যে ‘কেয়া খোয়া কেয়া পায়া’ ‘নয়ি দিশায়ে’, ‘মেরি ইকাবনা কবিতায়েঁ’, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছিল। তার কবিতাকে গজলে রূপ দিয়ে গেয়েছিলেন গজল শিল্পী জগজিৎ সিংহ। সেই অ্যালবামের নাম ‘সমবেদনা’। ১৯২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর মধ্য প্রদেশের গোয়ালিয়রে মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন অটল বিহারি বাজপেয়ি। বাবা কৃষ্ণবিহারি বাজপেয়ি ছিলেন স্কুল শিক্ষক ও কবি। মা কৃষ্ণা দেবী। ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেও তিনি সব সময়ই ছিলেন উদারমনস্ক। গোয়ালিয়রের সরস্বতী শিশু মন্দিরে জীবনের প্রথম পাঠ নেন তিনি। স্কুল জীবন শেষ করে ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে পাস করেন স্নাতক। তারপর কানপুরের অ্যাংলোবৈদিক কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। আসলে যুব বয়সেই তিনি বুঝেছিলেন দেশকে রক্ষা করতে হলে রাজনীতিই একমাত্র পথ। স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। ১৯৩৯ সালে যোগ দেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে (আরএসএস)। তিনি রাষ্ট্রধর্ম হিন্দি মাসিক পত্রিকায়, পঞ্চজন্য হিন্দি সাপ্তাহিক এবং স্বদেশ ও বীর অর্জুন দৈনিক কাগজে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। সারাজীবন রইলেন অবিবাহিত। কাজ করে গেলেন দেশের জন্য। দত্তক নিয়েছিলেন মেয়ে নমিতাকে।

তরুণ অটলের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় আর্য সমাজের হাত ধরে। সংগঠনের যুব শাখা আর্য কুমার সভায় যোগ দেন তিনি। ১৯৪৪ সালে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হন। এর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল তার। বাবাসাহেব আপ্তের হাত ধরে ১৯৩৯-এ স্বয়ংসেবক হিসেবে যোগ দেন আরএসএস-এ। ১৯৪০-৪৪ সংঘের প্রশিক্ষণ শিবিরে ছিলেন তরুণ অটল বিহারি। ১৯৪৭ সালে পূর্ণ সময়ের কর্মী হিসেবে যোগ দেন আরএসএসে। এর মধ্যেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর হন অটল বিহারি বাজপেয়ি। তখনকার দিনে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর হওয়াই তার মেধার পরিচয়বাহী। বিস্তারক হিসেবে তাকে উত্তর প্রদেশে পাঠায় আরএসএস। দীনদয়াল উপাধ্যায়ের রাষ্ট্রধর্ম পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। একই সঙ্গে লেখালিখি চলতে থাকে পাঞ্চজন্যসহ অন্য পত্রিকাগুলোতেও।

৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮। নাথুরাম গডসের হাতে গান্ধী হত্যার পর দেশ জুড়ে নিষিদ্ধ করা হয় আরএসএসকে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জনসংঘে যোগ দেন বাজপেয়ি। ১৯৫৪ সালে কাশ্মিরে শ্যামাপ্রসাদের কাশ্মির যাত্রার আগে তার সঙ্গে ছিলেন দুই তরুণ অটল বিহারি বাজপেয়ি ও লালকৃষ্ণ আদভানি। লালকৃষ্ণ আদভানি একবার লিখেছিলেন, ‘তাঁরাও কাশ্মিরে যেতে চেয়েছিলেন। তবে শ্যামাপ্রসাদবাবু আটকে দেন। দুই তরুণের মধ্যে ভবিষ্যতের নেতাকে দেখতে পেয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।’ কাশ্মির থেকে ফিরেছিল শ্যামাপ্রসাদের নিথর দেহ। ১৯৫৭ সালে দ্বিতীয় লোকসভা ভোটে বলরামপুরে জয়ী হন বাজপেয়ি।

ভারতীয় রাজনীতিতে উদয় হয় এক নতুন নক্ষত্রের। উপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর জনসংঘের দায়িত্ব নেন অটল বিহারি বাজপেয়ি। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু লালকৃষ্ণ আদভানি। ১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থার সময়ে অন্য বিরোধী নেতাদের সঙ্গে গ্রেপ্তার হন বাজপেয়ি। জয়প্রকাশ নারায়ণের ডাকে সাড়া দিয়ে কংগ্রেসবিরোধী জনতা দলে যোগ দেয় জনসংঘও। ১৯৭৭-এর ভোটে ক্ষমতায় আসে জনতা দল। মোরারজি দেশাইয়ের মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রী হন বাজপেয়ি। সেই সরকার বেশিদিন চলেনি। এরপর জনসংঘ থেকে তৈরি হলো নতুন দল ভারতীয় জনতা পার্টি। তবে সাফল্য তাড়াতাড়ি আসেনি। প্রথমবার মাত্র দুটি আসন জেতে বিজেপি। তবে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ আন্দোলনে ভর করেই ভিত শক্ত হতে শুরু হয়। বাজপেয়িকে মুখ করে ১৯৯৬-এর ভোট লড়ে পদ্ম শিবির। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন অটল বিহারি বাজপেয়ি। তবে আস্থা ভোটে হেরে ১৩ দিনেই ইতি পড়ে সেই সরকারের। এরপর ইউনাটেড ফ্রন্ট সরকারও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৮ সালে বেশ কিছু আঞ্চলিক দল নিয়ে এনডিএ জোট তৈরি করে বিজেপি। তারপর ১৯৯৮ সালের মে মাসে পোখরানে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করে ভারত।

পাকিস্তানের সঙ্গে মৈত্রী বাড়াতে দিল্লি-লাহোর বাসযাত্রাও শুরু করেন বাজপেয়ি। তবে এ সবের মাঝেই ঘরে-বাইরে দানা বাঁধছিল ‘বিদ্রোহ’। ১৯৯৯-এর মে মাসে হঠাৎই জোট ছেড়ে দেন জয়ললিতা। ১৩ মাসের মাথায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় বাজপেয়ি সরকার। অন্যদিকে কাশ্মির সীমান্তে অনুপ্রবেশ। শুরু হয়ে যায় কার্গিলের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে জয়ের পর বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসে এনডিএ। পাঁচ বছরের শাসনকালে একাধিক আর্থিক সংস্কার করেন প্রধানমন্ত্রী। চালু হয় প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা, সর্ব শিক্ষা মিশনের মতো প্রকল্প। সোনালি চতুর্ভুজ প্রকল্পে গোটা দেশকে একসূত্রে বাঁধার কৃতিত্ব বাজপেয়ির। তবে শুধু পদ্মের পাপড়িই নয় কাঁটাও ছিল এই পাঁচ বছরে। তেহলকা দুর্নীতি, গুজরাট হিংসার মতো ঘটনাও ঘটেছে। ২০০৪ সালে বাজপেয়ির ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’কে হারিয়ে ক্ষমতায় আসে ইউপিএ সরকার। শেষ হয় অটল যুগের। আর ফেরেননি বাজপেয়ি। ২০০৫ সালে রাজনীতি থেকে অবসর নেন। ২০০৯ সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তারপর কার্যত গৃহবন্দি। মোদি জমানায় তিনি পেয়েছেন ভারতরত্ন সম্মান। তার জন্মদিনকে সুশাসন দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন নরেন্দ্র মোদি। বাজপেয়ি বলতেন তার কবিতা যুদ্ধের মতো। সেখানে হেরে যাওয়ার কথা নেই। আছে এক যোদ্ধার জয়ের আখ্যান। নিজের জীবনেও সেই কবিতার কথাই বলে গিয়েছেন তিনি। বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়া হয় ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। তার পরবর্তী সময়ে দাঙ্গায় অন্তত ২ হাজার জনের মৃত্যু হয় এবং ভারতের ইতিহাসে এত বড় দাঙ্গা আর কখনো হয়নি। সেই বিতর্ক এতদিন সমানে চলছে। সর্বোচ্চ আদালতে শুনানি চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। ঘটনার পরে বাজপেয়ি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় ক্ষমা চেয়ে নেন। ঘটনাকে দুর্ভাগ্যজনক বলে ব্যাখ্যা করেন। এমন ঘটনা না হলেই বোধহয় ভালো হতো, এমনটাই জানান। বাজপেয়ি বলেন, আমরা কর সেবকদের আটকানোর চেষ্টা করেছিলাম। তবে সফল হইনি। তার জন্য আমরা দুঃখিত। কর সেবকদের একাংশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল এবং বারবার বারণ করা সত্তে¡ও বিতর্কিত অংশে ঢুকে ধ্বংসলীলা চালায়। তবে বাবরি মসজিদ নিয়ে বিজেপির জলঘোলা রাজনীতির সঙ্গে অটল বিহারি বাজপেয়িকে কখনোই মেলানো যায়নি।

১৯৯৯ সালে কার্গিলের যুদ্ধ হয় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে। লাদাখের কার্গিল এলাকায় এই যুদ্ধ হয়। ১৯৯৯ সালে যখন কার্গিল যুদ্ধ হয় তখন ভারতে কেন্দ্রের সরকারে ছিল এনডিএর সরকার। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ি। সরাসরি আক্রমণে না গিয়ে এলাকাভিত্তিক আক্রমণের মাধ্যমে হানাদারদের তাড়ানোর কৌশল নিতে বলেন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি যাতে মৃত্যুর সংখ্যা কম থাকে। ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধের সময় ভারতের বিপক্ষে পরাজয় দেখেছিল পাকিস্তান। সে সময়ই পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল পাকিস্তান এবং হামলার যাবতীয় প্রস্তুতি সেরে ফেলেছিল দেশটি। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এই বিষয়ে সতর্ক করেছিল। এই সময় চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করে দিলেন হোয়াইট হাউসের এক প্রাক্তন শীর্ষ নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রুশ রিডেল। ১৯৯৯ সালের ৪ জুলাই সিআইএর হাতে আসে পাকসেনারা কিছু গোপন নথি যা দেখে মার্কিন গোয়েন্দারা বুঝতে পারেন ভারতের বিরুদ্ধে পরমাণু হামলার প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে পাকিস্তান। তড়িঘড়ি সেই সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নেন ক্লিনটন। তার পরামর্শে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে। এর ফলে নওয়াজকে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয় এবং সৌদি আরবে এক দশক নির্বাসন কাটান।

২০০২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি গোধরা শহরের কাছে বহু হিন্দু তীর্থযাত্রী ও শত শত যাত্রীসহ একটি ট্রেন আগুনে পুড়ে গেলে প্রায় ৬০ জনের মৃত্যু ঘটে। উগ্র মুসলিমদের দ্বারা এই অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, এ রকম খবর ছড়ালে, গুজরাট জুড়ে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। এই দাঙ্গায় ৯০০ থেকে ২০০০ ব্যক্তির মৃত্যু হয় এবং কয়েক হাজার ব্যক্তি আহত হন। মোদি সরকার বড় শহরগুলোতে কার্ফ্যু জারি করে দেখামাত্রই গুলি করার নির্দেশ দেয় এবং দাঙ্গা প্রতিরোধে সেনাবাহিনী ডাকা হয়। এতদসত্তে¡ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো, বিরোধী দল এবং সংবাদপত্রের কিছু অংশ গুজরাট সরকারের দাঙ্গাবিরোধী পদক্ষেপের সমালোচনা করে। দাঙ্গার কারণে রাজ্যের ভেতর ও বাইরে থেকে মোদিকে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার জন্য চাপ বাড়তে থাকে। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির পরাজয়ের পর অটল বিহারি বাজপেয়ি এই হারের জন্য ২০০২ গুজরাট দাঙ্গাকে দায়ী করেন এবং স্বীকার করেন দাঙ্গার ঠিক পরেই মোদিকে সরিয়ে না দেয়া একটি ভুল পদক্ষেপ ছিল। শুধু এই ভুল আজ উপমহাদেশের আকাশে এক অশনি সংকেত বয়ে এনেছে। তা হলো হিন্দুত্ববাদ। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তাকে ভারতীয় রাজনীতির ‘ভীষ্ম’ বলে অভিহিত করেছেন। ২০০৫ সালে রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নেয়ার পরেই তার শরশয্যা নেয়ার সূত্রপাত। ক্রমে মূক হয়ে গেছেন। ভীষ্মের শেষ সময়ে যেভাবে সব শত্রুর আগমন ঘটেছিল তার শয্যাপাশে একইভাবে সব দলের নেতারা এসেছেন তার অন্ত্যেষ্টিতে। সূর্য যাচ্ছে ধীরে ধীরে অস্তাচলে।

অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App