×

জাতীয়

বছরজুড়েই খোঁড়াখুঁড়ি!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০১৮, ০১:১৪ পিএম

বছরজুড়েই খোঁড়াখুঁড়ি!
রাজধানীর অনেক সড়কে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না কোনো ধরনের নিয়মনীতি। কিছু সড়ক খুঁড়ে পাইপ বসানোর কাজ শেষ হলেও এখনো অরক্ষিতই রয়েছে সেগুলো। কিছু গর্তের চারপাশে উঁচু করে পাকা করে রাখা হয়েছে। অনেক সড়কে ম্যানহোলের ঢাকনা মূল সড়ক থেকে নিচে নেমে গেছে। রাস্তার মাঝখানে কেটে পাইপ বসানোর পর কোনো রকম মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, আইল্যান্ডের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে রাস্তায় চলাচলে প্রতিনিয়ত নানা দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে যানবাহন ও পথচারীদের। বেশ কিছু সংযোগ সড়ক বন্ধ রাখা হয়েছে। খোঁড়াখুঁড়ি করে রাখার ফলে সড়কের আকার কমেছে প্রায় অর্ধেক। এ কারণে রাজধানীজুড়েই যানজটের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সরেজমিন গত রবি ও সোমবার নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি ও সীমাহীন নাগরিক দুর্ভোগের নানা চিত্র। মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ চলায় এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন মিরপুর-পল্লবী থেকে প্রেসক্লাব-মতিঝিলমুখী যাতায়াতকারী মানুষ। গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটিতে কাজ চলায় গণপরিবহন ও ছোট ছোট যানবাহন চলাচলে খুবই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। আগে ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটে মিরপুর থেকে প্রেসক্লাব বা মতিঝিল আসা যেত। আর যানজট থাকলে সময় লাগত ১ থেকে সোয়া ঘণ্টা। এখন সেখানে সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি। এক লেনে চলাচল করায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হচ্ছে যানবাহনগুলোকে। এই অবস্থা প্রায় দুই বছর যাবত। বিশেষ করে অফিস চলাকালীন সময় ও অফিস থেকে ঘরে ফেরার সময় এই পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ত্যক্ত-বিরক্ত যাত্রীদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের ছাত্র আনিসুর রহমান। বাসা মিরপুর কাজীপাড়ায়। পড়াশোনার পাশাপাশি বাংলামোটরে একটি কোম্পানিতে পার্টটাইম কাজ করেন। ক্লাস ও অফিসের জন্য ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বাসেই চলাচল করেন। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে গতকাল সোমবার জানালেন তার বিরক্তির কথা। প্রায় ৭ বছর ধরে কাজীপাড়ায় বসবাস করছেন এই তরুণ। প্রথম দুই থেকে তিন বছর কাজীপাড়া বাসস্ট্যান্ডে গাড়িতে উঠলে মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিটে তিনি ফার্মগেটে পৌঁছতেন। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে কলেজে। এরপর থেকে যানজটের মাত্রা কিছুটা বেড়ে গেলে এ সময় লাগত ৩০ থেকে ৪০ মিনিট। আর গত প্রায় দেড় বছর ধরে কাজীপাড়া থেকে ফার্মগেট পৌঁছতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টার বেশি। আর বাংলামোটরের অফিসে যেতে তা দুই ঘণ্টা ছাড়িয়ে যায়। সকালে দুর্ভোগ কিছুটা কম হলেও মহাবিড়ম্বনা পোহাতে হয় সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাসা ফেরার পথে। বাংলামোটর থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় গাড়িতে উঠলে বাসায় পৌঁছাতে বেজে যায় রাত ৯টা। তিনি জানান, গরমে বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ফলে মাঝেমাঝে হেঁটেই বাসার দিকে রওনা দেন। এক্ষেত্রে ১ থেকে সোয়া ঘণ্টা সময় লাগে তার। রাজধানীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক তোপখানা-পল্টন মোড় থেকে প্রেসক্লাবের সামনের সড়কটির দুই প্রান্তে কয়েক মাস ধরে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে। প্রথমে ওয়াসার স্টর্ম স্যুয়ারেজ লাইনের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি হয়। এরপর শুরু হয়েছে মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ। এখনো তা চলছে। রাস্তার দুই পাশের অর্ধেক করে বন্ধ। হাইকোর্ট থেকে প্রেসক্লাবের সামনের সড়ক দিয়ে পল্টনমুখী সড়কটির অর্ধেকের বেশি খোঁড়া। এর একটি খোঁড়া অংশ ভরাট করে কোনো রকম মাটি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। মাত্র এক লাইনে চলাচল করছে গাড়িগুলো। ফলে দীর্ঘ লাইনে গাড়িগুলোকে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে দেখা গেছে অনেককেই। গতকাল রফিকুল ইসলাম নামের এক পথযাত্রী বিরক্তি প্রকাশ করে এই প্রতিবেদককে জানান, এত যন্ত্রণা কি আর সহ্য হয়? সেই সকাল সাড়ে ৯টায় আশুলিয়া থেকে উঠেছি গাড়িতে, যাব যাত্রাবাড়ী। এখন বাজে আড়াইটা। মাত্র প্রেসক্লাবের সামনে এলাম। এক জায়গায়ই ৩৫ মিনিট ধরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এখনো পল্টন মোড়েই পৌঁছতে পারলাম না। যাত্রাবাড়ী যাব কখন? এই ফাঁকে প্রেসক্লাবের সামনে গাড়ি থেকে নেমে কাছেই ফুটপাতে শরবত, পেঁপে ও আনারস খেয়ে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করতে দেখা গেছে অনেককেই। বর্ষা মৌসুমে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কাজ নিয়ম অনুযায়ী বন্ধ রাখার কথা থাকলেও গত দুই বছরে তা মানা হয়নি। বছরজুড়েই মূল সড়কসহ অলি-গলিতে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলতেই থাকে। সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সংযোগসহ বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠান একের পর এক খোঁড়াখুঁড়ি করেই চলেছে। একটি সংস্থার কাজ শেষ হতে না হতেই চলে আসে আরেকটি সংস্থা। ফলে এক সড়ক একবার নয়, বছরে ৩ থেকে ৫ বারও খনন করা হয়। আর এর ভোগান্তি পোহাতে হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের। শুধু তাই নয়, সড়ক খুঁড়ে রাখার ফলে সৃষ্টি হয় বড় বড় গর্ত। সামান্য বৃষ্টিতে ওই সব গর্ত ভরাট হয়ে পানি জমে যায়, সৃষ্টি হয় কাঁদা। আর প্রচণ্ড রোদে তা শুকিয়ে গিয়ে ধুলোয় পরিণত হয়। বাতাসে মিশে গিয়ে এসব ধুলো মানুষের নাকে-মুখে প্রবেশ করে। ফলে হাঁপানি-অ্যাজমা, এলার্জিসহ নানা বায়ুবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। রাজধানীতে এখন এসব রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর কাদা ও ধুলায় পরনের কাপড়চোপড়সহ বাসার আসবাবপত্রও নোংরা হয়ে যায়। গত কয়েকদিন যাবত রাজধানীর মৌচাক-মগবাজার সড়কের দুই পাশেই রাস্তা খুঁড়ে ওয়াসার পাইপ বসানোর কাজ চলছে। মৌচাক সড়কের একপাশে ফুটপাতসহ সড়ক কেটে রাখা হয়েছে প্রায় ১০ দিন ধরে। কাজেরও খুব একটা অগ্রগতি দেখা দৃশ্যমান নয়। শ্রমিকরা সারাদিন কাজ করলেও গতি খুবই ধীর। ফলে ওই এলাকার বাসিন্দারা পড়েন ভোগান্তিতে। রাজধানীর খিলগাঁও, কমলাপুর, শাহজাহানপুর, আরামবাগ, মতিঝিল, ওয়ারী, রামপুরা, ফকিরাপুল, বাড্ডা, ধানমন্ডি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি, মোহাম্মদপুর এলাকার বেশ কয়েকটি সড়কে কাজ চলায়, সংযোগ সড়ক বন্ধ রয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় খোঁড়া গর্তে কাজ শেষে উঁচু করে মাটি ভরাট করে রাখা হয়েছে। ফলে রিকশা আরোহীরা চলাচলে বারবার ঝাঁকির সম্মুখীন হন। নগরপরিকল্পনাবিদরা নিয়ম মেনে রাস্তা খোঁড়িখুঁড়ি ও সংস্কার কাজ করার জন্য বারবার পরামর্শ দিলেও সংশ্লিষ্টরা এসব বিষয় খুব একটা আমলে নেন না। তারা নিজেদের মতো করেই কাজ চালিয়ে যান বছরজুড়ে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, নগরীর উন্নয়ন কাজগুলো সুষ্ঠু পরিকল্পনার আলোকে কখনোই করা হয় না। এ কারণেই বছরের পর বছর ঢাকার এই সমস্যা রয়েই গেছে। আগে বর্ষা মৌসুমে সড়কের খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ থাকত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে তা মানা হচ্ছে না। আবার সেবাসংস্থাগুলোও সমন্বয় করছে না। তবে কাজ করার সময় যদি সংস্থাগুলো একমত হয়ে সচেতনতার সঙ্গে কাজ করে, তাহলে এ সমস্যা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। তবে এসব খোঁড়াখুঁড়ির দায় নিতে রাজি নয় ঢাকা ওয়াসা। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (যান্ত্রিক) শহীদ উদ্দিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, এই মুহূর্তে ঢাকা শহরের কোথাও ওয়াসার কোনো কাজ চলছে না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, বর্ষা মৌসুমে আমরা সড়কের খনন কাজ করি না। এখন তা চলছেও না। তবে কিছু এলাকায় ড্রেনেজের কাজ চলছে। সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর যখন সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয় তখন আমরা সিদ্ধান্ত নেই কোন সময় কোন কাজ আমরা করব। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের কাজে মানুষ এখন খুব একটা ভোগান্তি পোহাচ্ছেন না। এখন মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ চলমান থাকায় মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App