×

মুক্তচিন্তা

গুজব নির্মূলে প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০১৮, ০৮:২২ পিএম

প্রচার মাধ্যমকে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দেয়া দরকার সঠিক তথ্য উপস্থাপনে। নির্বিঘ্নে সঠিক তথ্যপ্রবাহ ও উপস্থাপন যেমন সরকারকে আত্মসমালোচনার পথ তৈরি করে উন্নয়নকে সঠিকভাবে বাস্তবায়নে সহায়তা করে, তার চাইতেও বেশি সহায়তা করে সামাজিক পরিবেশকে সরকারের অনুকূলে রাখতে। এটা বুঝতে হবে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলেই গুজব সৃষ্টি হবে না। মনে রাখা দরকার, গুজব সৃষ্টি থেকে সরকার তার দায় অস্বীকার করতে পারে না।

গুজব একটি দ্বিপক্ষীয় বিষয়। অর্থাৎ গুজব তৈরির জন্য দুটো পক্ষের ভ‚মিকা লাগে। সম্প্রতি গুজব সৃষ্টির জন্য সেই সূত্রে ছিল একপক্ষ শাসক, অন্যপক্ষ সুবিধাবাদী জনগোষ্ঠী। সুশাসনের অভাবে সমাজে বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কিত যখন কোনো তথ্য সাধারণের কাছে সহজ, স্বচ্ছভাবে পৌঁছায় না, তখন সুবিধাবাদী গোষ্ঠী তৎপর হয় এবং সেই তথ্য নিজেদের মতো করে বিশ্বাসযোগ্য অবয়বে উপস্থাপন করার সুযোগ পায় তার স্বার্থ উদ্ধারে। সেই অর্থে গুজব এক ধরনের মিথ্যাচার। যা সমাজের শঙ্কিত পরিস্থিতিতে উদ্ভব হয়। যদি রাষ্ট্রে তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ তথ্য উপস্থাপনের সুযোগ থাকে, সহায়তা থাকে এবং স্বচ্ছভাবেই তথ্য উপস্থাপন হয়, তাহলে গুজব উদ্ভবের সম্ভাবনা থাকে না মোটেও। গুজব ছড়ানোর ধৃষ্টতা সুবিধাবাদী মানুষের মনে উদ্রেক হয় না। যেমন- একজন ব্যক্তি যখন কোনো একটি বিষয়ে শঙ্কিত, আতঙ্কিত, হতাশ থাকেন এবং বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক তথ্য না পান, নিজেকে স্বস্তি দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে তার মানসিক দুর্বলতার সুযোগে সুবিধাবাদী জনগোষ্ঠী তার ভেতর বাস্তববহির্ভূত একটি গল্প পৌঁছাতে সক্ষম হয় সহজে। যেটাকে আমরা গুজব বলছি। যার হয়তো কোনো বাস্তবচিত্র নেই। অর্থাৎ যোগাযোগের অস্পষ্টতাই মানুষকে বিভ্রান্ত হতে, মিথ্যাকে সত্য বলতে, বিশ্বাস করতে উদ্বুদ্ধ করে। আর এটি এমন একটি শক্তিশালী সংক্রামক বিষয় যে, যা সহজে অন্যকে আক্রান্ত করতে সমর্থ হয়।

সম্প্রতি দেশে শিশু-কিশোরদের আন্দোলনের সপ্তম দিনের দুর্ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশকিছু উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো ভিডিও ও স্থির সংবাদ প্রচার করা হয়, ভাইরাল হয়। সহপাঠীর মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার সূত্র ধরে একটা সংবেদনশীল সামাজিক আন্দোলনে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। অভিনব এই সামাজিক আন্দোলনে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতর পরিবহন ও সড়ক ব্যবস্থাপনার যে অনিয়ম, ছোট ছোট হাতে তারা সেই চিত্র সবার সামনে তুলে ধরেছে। আমরা তা সাতদিনে অসংখ্য নমুনা পেয়েছি। বিচারপতি থেকে শুরু করে মন্ত্রী, আমলা, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী, সাধারণ যাত্রীর অনেকেই অবৈধপন্থায় সড়কে যাতায়াত করছিলেন। শিশু-কিশোরদের এই অভিনব সামাজিক আন্দোলনে তারা কেউই বিব্রত, বিরক্ত হননি। বরং মেনে নিয়েছেন। জনগণের ভেতর আশার সঞ্চার হয়েছিল যে, অনিয়ম দূর হওয়ার পথ দেখালো আমাদের শিশু-কিশোর। এবার সম্ভবত সড়ক নিরাপদ হবে, সংশ্লিষ্টরা সক্রিয় ও দায়িত্বশীল হয়ে উঠবেন। আমরা দেখেছি যে, এই সামাজিক আন্দোলনের পর বিআরটিএতে পরিবহন চালকদের লাইসেন্স করা ও নবায়নের জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে গেছে। এই লেখা যখন লিখছি একদিনের চার হাজারের ওপর ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন জমা পড়েছে। বিআরটিএ হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে তাদের ওপর চাপ সামলাতে। দেখলাম একজন ড্রাইভার টিভি সাংবাদিককে বলছেন, এতদিন নবায়ন ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়েই গাড়ি চালিয়েছেন। ট্রাফিক পুলিশকে টাকা দিয়ে এটা সম্ভব হয়েছে। এভাবে তিনি বারো তেরো বছর গাড়ি চালিয়েছেন লাইসেন্স নবায়ন ছাড়াই। এখন লাইসেন্স নবায়ন করতে এসেছেন। বাচ্চারা যা করল, তাতে তিনি অবৈধভাবে গাড়ি চালাতে সাহস পাচ্ছেন না। ভয় আর লজ্জা ঢুকেছে তার ভেতর। যাই হোক শিশু-কিশোরদের আন্দোলনকে সরকার, সুশীল সমাজ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবাই যৌক্তিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। ঠিক এমন সময় এই মুহূর্তের সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াত, বাম নড়েচড়ে উঠেছে। সুবিধাবাদী বলছি এ কারণে যে, এই দলগুলো জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়ে আসছিল কিংবা মেধাসম্পন্ন কোনো রাজনৈতিক ভ‚মিকা রাখতে পারছিল না। নেতা ও দলের স্বার্থ সর্বস্ব ভূমিকা রাখছিল। সাধারণ মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। এই দলগুলো শিশু-কিশোরদের সামাজিক আন্দোলনকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগতে উঠেপড়ে লাগে। সমর্থন দেয়, মাঠে নামে। শিশু-কিশোরদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে মিশে যায়। বসে থাকে না ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন। তারাও চড়াও হয়। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে চলে রাজনৈতিক দলগুলোর ঘৃণ্য পাঁয়তারা। এসবে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন সাধারণ মানুষ, অভিভাবক। সরকারের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দেয়া হয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতি। শিক্ষার্থীরা ঘরে না ফিরে গেলে কোনো দুর্ঘটনার দায় সরকারের থাকবে না। এমন এক অবস্থায় সাধারণ মানুষ ও অভিভাবক যখন আতঙ্কিত সন্তানদের নিয়ে, পরিবেশ-পরিস্থিতি যখন জটিল আকার ধারণ করেছে, ঠিক সেই মুহ‚র্তে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায়, যেমন- ঝিগাতলা, ধানমন্ডি এবং অন্যান্য জায়গায় সাংবাদিকদের ওপর আঘাত হানা হয়। সংবাদ সংগ্রহে তাদের প্রতিহত করা হয়। এই সময়ে সাংবাদিকদের টার্গেট করা হয়। ক্যামেরা, মেমোরি কার্ড ছিনিয়ে নেয়া হয়। সে সঙ্গে কোনো টিভিতে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে কোনো তথ্য সম্প্রচার করা হয়নি। অথচ যেখানে টিভি চ্যানেলগুলো যে কোনো ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রচারের ক্ষমতা রাখে এবং প্রচার করে থাকে। হেফাজতের আক্রমণ যেখানে রাতভর লাইভ দেখা গিয়েছিল টিভি চ্যানেলগুলোতে, সেখানে শিশু-কিশোরদের এই আন্দোলনের সপ্তমদিনের দুর্ঘটনার বিন্দুমাত্র খবর সাধারণ মানুষ জানতে পারেনি। উদ্বিগ্ন আর অধীর হয়ে ছিল তারা। তথ্যপ্রবাহের এই স্থবিরতা, বাধা যে কারণেই হোক, রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হয়নি। কার নির্দেশে, কোনো লাভে সাংবাদিকদের এভাবে মারধর করা হলো, ক্যামেরার মেমোরি ছিনিয়ে নেয়া হলো এবং বেসরকারি চ্যানেলগুলো হঠাৎ করে বিটিভির ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো, তা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যে কারণ বা উদ্দেশ্যে সংবাদপ্রবাহে বাধা দেয়া হয়েছে, তা মঙ্গলজনক হয়নি। বেসরকারি চ্যানেলগুলোর সংবাদ পরিবেশন বিটিভির মতো হওয়ায়, সাধারণ মানুষ ভেবে নিয়েছে, হয়তো সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে প্রচার মাধ্যমকে। খুবই স্বাভাবিক এমন ধারণা পোষণ করা। এই সুযোগ নিয়েছে সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দলগুলো। সাধারণ মানুষ এই সত্য জানতে না পারায়, সুবিধাবাদীগোষ্ঠী রাজনৈতিক দল মূল তথ্যের সঙ্গে আরো কিছু সংযোজন করে, কোনো জায়গায় নিজেরাই তথ্য বানিয়ে গুজব আকারে ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পেয়েছে। এই গুজব সংক্রামিত হয়েছে। পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে। কোনটা সত্য কিংবা কোনটা মিথ্যা, তা যদি স্বচ্ছভাবে উপস্থাপিত না হয়, রাষ্ট্র তার দায়বোধ না করে, সুযোগ না দেয় প্রচার মাধ্যমকে, তাহলে গুজব তৈরি হওয়ার পথ সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনেক পরিবেশ-পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার। সুবিধাবাদীদের তৎপর হতে না দেয়ার মেধাদীপ্ত কৌশল, পদক্ষেপ থাকতে হবে। একটি রাষ্ট্রে মিথ্যাচার সংস্কৃতি থাকবে কিনা, রাষ্ট্রই সেটা নির্ধারণ করবে।

পরিশেষে বলি, প্রচার মাধ্যমকে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দেয়া দরকার সঠিক তথ্য উপস্থাপনে। নির্বিঘ্নে সঠিক তথ্যপ্রবাহ ও উপস্থাপন যেমন সরকারকে আত্মসমালোচনার পথ তৈরি করে উন্নয়নকে সঠিকভাবে বাস্তবায়নে সহায়তা করে, তার চাইতেও বেশি সহায়তা করে সামাজিক পরিবেশকে সরকারের অনুকূলে রাখতে। এটা বুঝতে হবে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলেই গুজব সৃষ্টি হবে না। মনে রাখা দরকার, গুজব সৃষ্টি থেকে সরকার তার দায় অস্বীকার করতে পারে না।

স্বপ্না রেজা : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App