×

জাতীয়

খোলনলচে পাল্টাতে হবে বিআরটিএর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০১৮, ১১:২১ এএম

খোলনলচে পাল্টাতে হবে বিআরটিএর
দালাল, অসাধু কর্মকর্তা, সুবিধাভোগী সিন্ডিকেট আর রাজনৈতিক প্রভাব জেঁকে বসেছে সড়ক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ঘাড়ে। এর সঙ্গে রয়েছে যুগোপযোগী পদ্ধতি প্রয়োগ ও পরিকল্পনার অভাব। নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠায় যে প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা রাখার কথা সব চেয়ে বেশি, এখন ব্যর্থতার দায়ে অভিযোগের আঙুুল সে প্রতিষ্ঠানের দিকেই। এ অবস্থায় বিআরটিএকে নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে বলে মনে করছেন পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, প্রয়োজনে খোলনলচে পাল্টাতে হবে সংস্থাটির। মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ (সংশোধিত ১৯৮৭)-এর ধারা ২ অনুযায়ী ১৯৮৭ সালের ২০ ডিসেম্বর বিআরটিএ গঠন করা হয়। পরের বছর জানুয়ারি মাস থেকে সংস্থাটি কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে বিআরটিএর মোট ৭টি বিভাগীয় অফিস ও ৬২টি সার্কেল অফিস রয়েছে। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ সার্কেল অফিস ৫৭টি ও মেট্রো সার্কেল রয়েছে ৫টি। গঠনের উদ্দেশ্য অনুযায়ী, সুষ্ঠু সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনা, এখাতে শৃঙ্খলা এবং সড়ক নিরাপত্তা বিধান করাই বিআরটিএর মূল কাজ। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারেনি সংস্থাটি। বরাবরই এ জন্য লোকবলের অভাব, অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটসহ নানা বিষয়কে দায়ী করে থাকে কর্তৃপক্ষ। এদিকে বিআরটিএর প্রায় প্রতিটি বিভাগীয় ও সার্কেল অফিসে রয়েছে দুর্নীতি ও অনিয়মের শক্ত সিন্ডিকেট। ফলে দক্ষ চালক তৈরি ও যানবাহনের ফিটনেস দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সব উদ্যোগই ভেস্তে যেতে দেখা যায়। চলাচলের অনুপযুক্ত যানবাহনকে ফিটনেস দেয়া বিআরটিএর কাছে একটি নৈমিত্তিক বিষয়। এ কারণে ফিটনেস পরীক্ষার আধুনিক যন্ত্রপাতিগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে অকার্যকর করে রাখা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। কনজুমারস এসোসিয়েশনের এক জরিপে দেখা গেছে, অবৈধ লেনদেন বা ঘুষ ছাড়া নিয়ম মেনে বিআরটিএ অফিস থেকে সেবা পেয়েছেন এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। সড়ক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় এ বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে মনে করে সংগঠনটি। এদিকে যে প্রক্রিয়ায় বিআরটিএ চালকদের লাইসেন্স দেয়, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্ন রয়েছে যানবাহনের ফিটনেস যাচাই প্রক্রিয়া নিয়েও। ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে প্রথমে শিক্ষানবীশ লাইসেন্স নিতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী লাইসেন্স পেতে আগ্রহী ব্যক্তিকে একজন প্রশিক্ষকের অধীনে প্রথমে যানবাহন চালনা শিখতে হয়। তাকে হাতে কলমে গাড়ি চালনার পাশাপাশি ট্রাফিক আইন ও চিহ্ন সম্পর্কে শিখতে হয়। জানতে হয় গাড়ি মেরামতের প্রাথমিক কিছু কারিগরি কৌশলও। কিন্তু বর্তমানে দেশে গাড়ি চালনা প্রশিক্ষণের জন্য মাত্র ১৭৯ জন লাইসেন্সধারী প্রশিক্ষক রয়েছেন। আর প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে মাত্র ১২৩টি। অন্যদিকে ৩০ জুন পর্যন্ত নিবন্ধিত ৩৪ লাখ ৯৮ হাজার ৬২০টি যানবাহনের বিপরীতে লাইসেন্সধারী চালক আছেন ১৮ লাখ ৬৯ হাজার ৮১৬ জন। যার অর্থ দাঁড়ায় দেশের ১৬ লাখেরও বেশি চালকের কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্সই নেই। ফলে উপযুক্ত কোনো প্রশিক্ষকের হাতে গাড়ি চালনা শেখার সুযোগ খুব কম মানুষের ভাগ্যেই জোটার কথা। আর আগে যারা লাইসেন্স পেয়েছেন তাদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। বর্তমান পদ্ধতিতে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য একজন শিক্ষানবীশকে বিআরটিএ অফিসের মাঠে গাড়ি চালিয়ে দেখাতে হয়। এ পদ্ধতিকে হাস্যকর বলে মন্তব্য করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সরোয়ার আলম বলেন, মাঠের মধ্যে কিছু সীমানা পতাকার ভেতর দিয়ে আঁকাবাকা করে গাড়ি চালানো আর সড়কে গাড়ি চালানো এক কথা নয়। উন্নত বিশ্বে পরীক্ষককে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ সড়কে যান চালিয়ে দেখাতে হয় একজন লাইসেন্স প্রত্যাশীকে। ওই সময় পরীক্ষক দেখেন, লাইসেন্স প্রত্যাশী সঠিকভাবে লেন, সিগনাল, গতিসীমা ইত্যাদি মানছেন কিনা। সঠিক নিয়মে পার্কিং, ইন্ডিকেটর বাতি জ্বালানো বা ব্রেক করার বিষয়টিও তার নজর এড়ায় না। সামান্য ভুল করলেই আবারো পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে হয় ওই চালককে। এ ছাড়া চালকের চোখ, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার পরীক্ষা ছাড়া কাউকে গাড়ি চালানোর অনুমতি দেয়া হয় না উন্নত বিশ্বে। সড়কে প্রকৃত চালক তৈরি করতে হলে এ দেশেও এ পদ্ধতি প্রয়োগের বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি। যানবাহনের ফিটনেস দেয়ার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. শাহীন খান বলেন, আমাদের সড়কগুলোতে ভাঙাচোরা, রংচটা অনেক যানবাহনেরই দেখা যায় ফিটনেস সনদ রয়েছে। এটি কেবল বিআরটিএর দুর্নীতির কারণেই সম্ভব। বিআরটিএ অফিসে টাকা দিলে যানবাহন হাজির না করেই ফিটনেস সনদ পাওয়া যায় বলে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এ বিষয়কে স্পর্শকাতর হিসেবে দেখা হয়। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রপাতি দিয়ে গাড়ির ব্রেক, ইঞ্জিন এমনকি পরিবেশ দূষণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরই ফিটনেস সনদ দেয়া হয়। আমাদের দেশে জাপানের অর্থ সহায়তায় কিছু আধুনিক পরীক্ষাযন্ত্র বসানো হলেও রহস্যজনক কারণে তা কাজে লাগানো হয় না বলে অভিযোগ করেন তিনি। বিআরটিএ-র কার্যক্রম নিয়ে সন্তুষ্ট নন খোদ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও। বিভিন্ন সময় বিআরটিএ অফিসে গিয়ে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সর্তক করেন তিনি। বেশ কিছু দিন আগে বিয়াম মিলনায়তনে বিআরটিএর কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যালোচনাসংক্রান্ত এক সভায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিআরটিএ নানা অগ্রগতির কথা শোনাচ্ছে। কিন্তু জনগণ তো এসব অগ্রগতি থেকে লাভবান হচ্ছে না। মানুষ সেবা নিতে এসে চরম হয়রানির শিকার হচ্ছে। আমরা অভিযানে গেলে বিআরটিএ অফিস দালালমুক্ত হচ্ছে। কিন্তু অভিযান থেকে চলে এলেই আবার দালালদের খপ্পরে পড়ছেন গ্রাহকরা। দালালরা বিআরটিএ-এর চেয়ার-টেবিল পর্যন্ত ব্যবহার করছে। কর্মকর্তাদের যোগসাজশ না থাকলে এমন হতে পারে না বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী। তবে পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে দাবি করে বিআরটিএর পরিচালক (অপারেশন) সিতাংশু এস বিশ্বাস জানান, এখন বিআরটিএর অনেক সুবিধা অনলাইনভিত্তিক করা হয়েছে। তাই দালালের কাছে না গিয়ে সাধারণ মানুষ অনেক সেবা নিতে পারে। ফিটনেস পরীক্ষার যন্ত্রগুলো আবারো সচল করতে বিআরটিএ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানান তিনি। কাঠামো প্রকৌশলী ও ভ‚মিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. মো. আলী আকবর মল্লিক বিআরটিএকে ঢেলে সাজাতে সম্প্রতি একটি সুপারিশ তুলে ধরেছেন গণমাধ্যমে। এতে তিনি বলেন, বাংলাদেশে দক্ষ চালক তৈরির সঠিক পদ্ধতি, ক্ষেত্র ও শৃঙ্খলা কোনোটিই নেই। ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে বিআরটিএর আধুনিক ক্যাম্পাস থাকা প্রয়োজন। মেইন ক্যাম্পাসটি অন্তত ১০০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা দরকার। যেখানে থাকবে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ, পরীক্ষা ও লাইসেন্স কেন্দ্র, থিয়েটার হল, মোটরযান নিরীক্ষাকেন্দ্র, গবেষণাগার ও প্রশাসনিক কেন্দ্র প্রভৃতি। অন্য বিভাগীয় শহরের ক্যাম্পাসে গবেষণাগার ছাড়া আর সবই থাকবে। লাইসেন্স কেন্দ্র : চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মানবিক গুণাবলি থাকতে হবে। একটি পূর্ণাঙ্গ কোর্স সম্পন্ন করার প্রশিক্ষণ থাকবে। এর ফলে ‘ওস্তাদের’ কাছ থেকে শেখার প্রবণতায় ভাটা পড়বে। কেন্দ্রে শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে প্রশক্ষণ দেয়ার সিমুলেটর থাকতে হবে। থিয়েটার হল : লাইসেন্স দেয়ার আগে থিয়েটার হলে একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র দেখাতে হবে। যেখানে শহরের ভেতরে বা মহাসড়কে চলতে কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটে, দুর্ঘটনার পরিণতি, কোন বিষয়ে সচেতন হলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব ইত্যাদি দেখানো হবে। মোটরযান নিরীক্ষাকেন্দ্র : সব ধরনের মোটরযানের ফিটনেস নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। নিরীক্ষা হতে হবে ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর। গবেষণাগার : সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয় ও কমিয়ে আনা প্রভৃতি নিয়ে গবেষণার জন্য এ জাতীয় একটি কেন্দ্রীয় গবেষণা কেন্দ্র থাকা দরকার বলে মনে করেন আলী আকবর মল্লিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App