×

মুক্তচিন্তা

সড়কে হত্যাকাণ্ড ছাত্র বিস্ফোরণ এবং শিক্ষা

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০১৮, ০৮:৩৭ পিএম

 
ওরা দেখিয়েছে, সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে অসম্ভব বলে কিছু নেই। যানবাহন চলাচলে যে শৃঙ্খলা আনা যায় তাও ওরা করে দেখিয়েছে। ওরা দেখিয়েছে, আমরা আইনের প্রতি কতটা অশ্রদ্ধাশীল। রাজপথের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে ওরা যা করেছে তা বড়রা কখনো করার সাহস দেখাতে পারেননি। আমাদের দেশটা কতটা দুর্নীতি ও অনিয়মের পক্ষে নিমজ্জিত সেটাও ওরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ আন্দোলনের দেশ, বিক্ষোভের দেশ, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের দেশ। বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে নানা আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়। অতীতে অনেক বড় বড় আন্দোলন হয়েছে। প্রায় সব আন্দোলনেরই পাইওনিয়ার সংগ্রামী ছাত্র সমাজ। ইতিহাস সৃষ্টিকারী কত আন্দোলন ছাত্রদের নেতৃত্বে হয়েছে, সামরিক স্বৈরশাসকদের গদি ছাড়তে হয়েছে। তবে সেসব আন্দোলন বেশির ভাগই ছিল পরিকল্পিত, সংগঠিত, পূর্ব যোগাযোগের ভিত্তিতে, কখনোবা দিন তারিখ ঠিক করে। সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত নয়। কিন্তু গত কয়দিন আমরা রাজধানীতে সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত এক আন্দোলন সংগঠিত হতে দেখলাম স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে। স্কুল-কলেজের ড্রেস পরে ক্লাসরুমে না গিয়ে ওরা রাস্তায় নেমে এসেছে। দাবি সামান্য নিরাপদ সড়ক চাই। সড়কে আর হত্যা নয়। কোনো সংগঠন নেই, নেই কোনো নেতা, কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো নির্দেশনা নেই, কেউ ওদের আন্দোলনে নামার জন্য প্ররোচিতও করেনি। ওরা ওদের নিজের গরজে, জীবনের মায়ায়, বিবেকের তাড়নায় ঘাতক চালকদের শাস্তির দাবি নিয়ে রাস্তায় এসে রাজধানীকে পরপর কয়দিন কার্যত অচল করে দিয়েছে। দুয়েকটা গাড়ি পোড়ানো ও ভাঙচুরের বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও এই আন্দোলন ছিল মূলত শান্তিপূর্ণ। ছাত্র বিক্ষোভ বাংলাদেশ অনেক দেখেছে কিন্তু গত ২৯ জুলাই রবিবার থেকে রাজধানীতে যে ছাত্র বিক্ষোভ চলছে তা এক কথায় ‘ইউনিক’। ২৯ জুলাই ঢাকার শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে কুর্মিটোলা এলাকায় বাসচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। দুই বাসের বেপরোয়া প্রতিযোগিতা দুজনের প্রাণ কেড়ে নেয়, আহত হয় অনেকে। আব্দুল করিম রাজীব এবং দিয়া খানম মিম নামের দুই সহপাঠীকে চোখের সামনে বাসচাপায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখে উপস্থিত ছাত্রছাত্রীরা স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এটাকে তারা নিছক একটি দুর্ঘটনা বলে মেনে নিতে পারেনি। এটা তাদের কাছে হত্যাকাণ্ড বলেই মনে হয়েছে। নিহত দুই শিক্ষার্থী অসতর্ক অবস্থায় রাস্তা পার হচ্ছিলেন না, তারা ভুল করে চলন্ত বাসের সামনে গিয়েও পড়েননি, তারা কলেজ ছুটির পর ঘরে ফেরার জন্য যানবাহনেরই অপেক্ষা করছিলেন। সে সময় দ্রুতগতিতে চলতে থাকা একটি বাস আরেকটি বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের ওপর উঠে যায়। বাস যদি নিয়ম মেনে চলত, চালক যদি অযথা পাল্লাপাল্লি না করত, ওভারটেক করতে না যেত তাহলে দুই কলেজপড়ুয়াদের এভাবে জীবন দিতে হতো না। সঙ্গত কারণেই রাজীব ও দিয়ার মৃত্যু তার সহপাঠীরা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। ঘাতকদের বিচার দাবিতে তাই তারা সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং রাস্তায় নেমে ঘাতক চালকের শাস্তির দাবি জানায়। সড়ক হত্যাকাণ্ড এখন দেশে একটি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত সাড়ে তিন বছরে ২৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গড়ে প্রতিদিন ২০ জন মানুষ মারা যাচ্ছে সড়ক পথে চলাচল করতে গিয়ে। যেহেতু চালকের বেপরোয়া মনোভাবের জন্যই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে বা অধিকসংখ্যক মানুষের প্রাণ যায় তাই এখন এগুলোকে সড়ক দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকাণ্ড বলা হচ্ছে। সড়ক হত্যাকাণ্ড বন্ধের দাবিতে মানুষ সোচ্চার হচ্ছে কিন্তু প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সড়ক হত্যা, সড়ক সন্ত্রাস কিংবা সড়ক দুর্ঘটনা যাই বলা হোক না কেন, এগুলো বন্ধ করার জন্য যে প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাসমূহ রয়েছে তারা তাদের দায়িত্ব পালনে উদাসীন এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা এতটাই দুর্নীতিপরায়ণ যে তারা বলতে গেলে লাগাম ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। কখনো কখনো তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। গত বৃহস্পতিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকার বন্ধ ঘোষণা করা সত্ত্বেও সারাদেশে ছাত্রছাত্রীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে যেভাবে রাস্তায় নেমেছে তা এক কথায় অভাবনীয়। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা যে এভাবে প্রতিবাদ করতে পারে, এমন বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে, এটা ছিল আমাদের অনেকের কাছেই অভাবনীয়। সরকার শুরুতে সম্ভবত বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেনি। উল্টো একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সংবাদ মাধ্যমে হেসে হেসে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। এই মন্ত্রীর নাম শাজাহান খান। তিনি নৌপরিবহনমন্ত্রী। এ ছাড়া তিনি আবার পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা। বলা হয়ে থাকে, তার সমর্থন ও সহযোগিতা একশ্রেণির পরিবহন শ্রমিককে বেপরোয়া করে তুলতে সাহায্য করছে। পরিবহন শ্রমিকদের সংগঠিত শক্তির কাছে অনেক সময় সরকারকেও অসহায় বলে মনে হয়। তারা অপরাধ করে আবার আন্দোলন করে শাস্তি এড়িয়ে চলে। ফলে পরিবহন শ্রমিকদের প্রতি সাধারণ মানুষের খুব একটা সহানুভূতি লক্ষ করা যায় না। পরিবহন শ্রমিকদের নেতা হিসেবে বিভিন্ন সময় শাজাহান খানের দেয়া বক্তব্য মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। মানুষ যখন চালকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষণের দাবি জানিয়েছে, তখন শাজাহান খান বলেছেন, চালকদের গরু-ছাগল চিনলেই হবে, বেশি লেখাপড়া জানার দরকার নেই। তিনি পক্ষপাত মুক্ত হয়ে দেশের সব মানুষের স্বার্থ দেখভাল করার জন্য মন্ত্রী হয়েছেন, অথচ মন্ত্রী হয়ে তিনি সবসময় পরিবহন শ্রমিকদের স্বার্থ ছাড়া আর কারো স্বার্থ দেখেন না। দেশে পরিবহন খাতে যে নৈরাজ্য তার সিংহভাগের জন্য শাজাহান খান দায়ী বলে সাধারণ মানুষের ধারণা। দুজন সহপাঠীর করুণ মৃত্যুর শোক ও বেদনার সঙ্গে শাজাহান খানের অমানবিক হাসি যোগ হয়ে শিক্ষার্থীদের মনে যে রোষের সৃষ্টি হয়েছে তারই বহিঃপ্রকাশ আমরা রাজপথে দেখলাম। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ছাত্রদের নয় দফা দাবিকে যেমন একদিকে যৌক্তিক বলেছেন, অন্যদিকে তেমনি দাবিগুলো পূরণের ঘোষণা দিতে সময়ক্ষেপণ করেছেন। অন্যদিকে দাবি পূরণের ঘোষণা দিলেও তা আদৌ বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে সবার মনেই সংশয় রয়েছে। সরকারের কথায় আশ্বস্ত হতে না পেরে ছাত্ররা রাজপথ দখলে রাখার যে চেষ্টা করেছে তা সরকারকে বিব্রত করেছে। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার সোজা পথে না হেঁটে সরকার ধরেছে আঁকাবাঁকা পথ। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। ছাত্ররা রাস্তায় নেমে অনেক বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে। সড়ক পরিবহন খাতে চরম নৈরাজ্যের কথা কারো অজানা নয়। পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা রাতারাতি দূর করা যাবে না- এটাও অনেকেই বোঝেন। কিন্তু এই বিশৃঙ্খলা দূর করতে সরকার কতটুকু আন্তরিক সেটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। এবার বোধহয় অনেকে বুঝেছেন যে সরকার স্থিতাবস্থার পক্ষে। সে জন্য সংকট তৈরির জন্য দায়ী প্রধান ব্যক্তির ব্যাপারে দেখা যায় সরকারের নমনীয়তা। ছাত্রদের আন্দোলন দমাতে সরকার কঠোরতা দেখাতে চায় কিন্তু যাকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণের কঠোরতা দেখালে শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত হতো তার ব্যাপারে সরকার নীরব। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য স্বার্থান্বেষীরা মাঠে নেমেছে। সে জন্য শিক্ষার্থীদের আর রাজপথে থাকা ঠিক হবে না। তবে ওরা গত কয়দিনে যে ‘ইতিহাস’ তৈরি করে গিয়েছে তা থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে শিক্ষা নিতে হবে। ওরা দেখিয়েছে, সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে অসম্ভব বলে কিছু নেই। যানবাহন চলাচলে যে শৃঙ্খলা আনা যায় তাও ওরা করে দেখিয়েছে। ওরা দেখিয়েছে, আমরা আইনের প্রতি কতটা অশ্রদ্ধাশীল। রাজপথের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে ওরা যা করেছে তা বড়রা কখনো করার সাহস দেখাতে পারেননি। আমাদের দেশটা কতটা দুর্নীতি ও অনিয়মের পক্ষে নিমজ্জিত সেটাও ওরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সরকারের একাধিক মন্ত্রী, সচিব, সংসদ সদস্য, পুলিশ কর্মকর্তা লাইসেন্স ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া গাড়ি চালান- এটা প্রমাণ হয়েছে। এটা আমাদের বড়দের অস্বস্তিতে ফেলেছে, বিব্রত করেছে। কিন্তু সচেতন করতে সাহায্য করবে কি? সরকার কি কিছু শিখল এই ছাত্র বিস্ফোরণ থেকে? সব আন্দোলন কঠোর হাতে দমন করতে নেই। দাবির ন্যায্যতা স্বীকার করে তা মানতে গড়িমসি অথবা চালাকি করতে নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি বিভিন্ন মহলের যে আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসা তা যেন কোনোভাবেই আলগা না হয়। ছাত্রদের নয় দফা দাবি মেনে নেয়ার যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে তার যেন খেলাপ না হয়। গণপরিবহন ব্যবস্থায় নৈরাজ্য দূর না করলে সড়ক নিরাপদ হবে না। চালকের বেপরোয়া প্রতিযোগিতা, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই চালকের আসনে বসা, রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামানো ইত্যাদি অনিয়ম দূর করতে হবে অবিলম্বে, ধারাবাহিকভাবে। বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App