×

মুক্তচিন্তা

শিক্ষার্থীদের বিপথগামী করবেন না!

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০১৮, ০৮:০৭ পিএম

 
প্রধানমন্ত্রী এক বাক্যে শিক্ষার্থীদের সব মানবিক ও যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়েছেন। সরকারকে কাজ করার মতো একটু সময় দিতে হবে। আর তাই, শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাক। আর রাস্তায় অবস্থান নয়। পরিবেশ স্বাভাবিক না হলে ষড়যন্ত্রকারীরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করার সুযোগ পেয়ে যাবে। নিরাপদ সড়ক ও নিরপরাধ জীবন রক্ষার এই মানবিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে কেউ যদি অপব্যবহার করার চেষ্টা করে সরকারের উচিত হবে তা কঠোরভাবে দমন করা।
রাজনীতির খেলা কিংবা খেলার রাজনীতির মধ্যে শিক্ষার্থীদের কেউ ব্যবহার করবেন না দয়া করে। এরা রাজনীতি বোঝে না এবং এই বয়সে বোঝার চেষ্টাও করছে না। তাদের দাবি ছিল নিরাপদ সড়কের, যানবাহনের এবং বাড়ি থেকে বের হয়ে আবার নিরাপদে মা-বাবার কোলে বাড়ি ফিরে যাওয়ার। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মানুষ যা দেখেনি, কোমলমতি শিক্ষার্থীরা তা করে দেখিয়েছে। আমরা যা করতে পারিনি, করার চেষ্টা করিনি, যা কল্পনাও করতে পরিনি, কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সেটাই করে দেখিয়েছে যে, নিরাপত্তার অধিকারকে অবজ্ঞা করা যাবে না কোনোভাবেই। শিক্ষার্থীরা যেটা সবচেয়ে বেশি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে সেটা হচ্ছে আইনের যথার্থ প্রয়োগ হলে পরিবহন খাতের নৈরাজ্য এবং যানজট সহনীয় করা সম্ভব। এবার প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলমান অচলাবস্থার নিরসনে সহজ ও সমাধানযোগ্য পথ খুঁজে বের করুন। সময় অনেক চলে গেছে। দৃশ্যমান অনেক উন্নতি দরকার পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থায়। বেশ কিছুদিন ধরে চলমান এই বিক্ষোভ অনেক দিনের পুঞ্জীভ‚ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। অভিভাবক ও শিক্ষকদের এখন উচিত শিক্ষার্থীদের বাড়ি এবং শ্রেণিকক্ষে ফেরানো। আর রাস্তায় নয়। গাড়িতে আগুন দেয়া, ভাঙচুরের ঘটনা এবং কিছু কিছু প্লাকার্ডের ভাষা প্রমাণ করে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে সুযোগ সন্ধানী মানুষের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। খারাপ কোনো আশঙ্কার কথা বলতে বা ভাবতেও চাই না আমরা। গত কিছুদিন ধরে যা ঘটেছে, সংশ্লিষ্ট সবার নিশ্চয় যৌক্তিক বোধোদয় ঘটবে। বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু সামাজিকীকরণে ব্যাঘাত ঘটছে যার পেছনে অনেকের অবদান রয়েছে বলেই এই বহিঃপ্রকাশ। পাবলিক যানবাহনে চলাফেরার অভিজ্ঞতা যার আছে সেই জানে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা এক ধরনের খারাপ ব্যবহারের শিকার হন চলতে-ফিরতে। বড় অবাক করা বিষয় হলো, অফিস শুরু এবং ছুটির সময়ে বেশ কিছু গাড়ি হঠাৎ করেই ‘সিটিং সার্ভিস’ হয়ে যায়। ওই সময় বাদে সারাদিন আবার লোকাল ট্রিপ দেয়। অমানবিকতার এটাও একটি রূপ। শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন। একমাত্র অ্যাম্বুলেন্স বাদে উল্টো পথে যারাই চলাচল করে, পাবলিক মুখে যা আসে তা দিয়ে গালি দিতে দেখা যায়। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায় নীতিনির্ধারণ করা দরকার এসব অগণিত মানুষের দুঃখ, কষ্ট, অসহায়ত্বকে গুরুত্ব দিয়ে। দেশে গণপরিবহনে যাতায়াতকালে ৯৪ ভাগ নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তবে বিস্ময়কর হচ্ছে, ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারাই নারীরা বেশি যৌন হয়রানির শিকার হন। এই হার ৬৬ শতাংশ। দেশে যৌন হয়রানি আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকা, বাসে অতিরিক্ত ভিড়, যানবাহনে পর্যাপ্ত আলো না থাকা, তদারকির অভাব ইত্যাদি বিষয়গুলো নারীদের যৌন হয়রানির মূল কারণ। গত ৫ মার্চ, ২০১৮ জাতীয় প্রেসক্লাবে ব্র্যাক পরিচালিত ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে এ তথ্য তুলে ধরা হয় (৬ মার্চ ২০১৮, দৈনিক ইত্তেফাক)। কিছু বিষয় বিবেচনায় নেয়া দরকার। যেমন- (১) নিরাপদ সড়কের জন্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রশমন করতে সরকার ইতোমধ্যে ১১টি পদক্ষেপ নিয়েছে। এর সাথে আমার কিছু প্রস্তাব রয়েছে। অনেক দুর্নাম নিয়ে পরিচালিত বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিকে (বিআরটিএ) সময়ের প্রয়োজনে গঠনমূলকভাবে পরিবর্তন করা জরুরি; অনেকেই ফুট ওভার ব্রিজ, আন্ডারপাস ব্যবহার করে না। এমনকি বড় রাস্তার ডিভাইডার পার হয়ে বড় বড় রাস্তা অতিক্রম করে। পথচলায় সাবধানতা অবলম্বনসহ সঠিকভাবে পথচলার জন্য কঠোরতা আরোপ করা দরকার; আমাদের দেশে একমাত্র ক্যাণ্টনমেন্টের ভেতরে ছাড়া ট্রাফিক লাইটের ব্যবহার যথাযথভাবে কেউ মান্য করে না। ট্রাফিক লাইট চলে একভাবে, আর গাড়ি চলে আরেকভাবে। এই ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করে উপযুক্ত সমাধানের ব্যবস্থা করা দরকার। আর তাই, সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা ও দ্রুত মামলা শেষ করার বিধান রেখে বিদ্যমান আইন সংশোধন করে কঠোর ট্রাফিক আইন দ্রুত পাশ করার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে; বয়স্ক নাগরিক ও প্রতিবন্ধী জনগণকে সম্পূর্ণ ফ্রি এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সারা বাংলাদেশে অর্ধেক ভাড়া নির্ধারণ করা গেলে মানবিক হবে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জন্য এটি দরকার আজ। তাতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশ পাবে। পারস্পরিক দোষারোপ না করে পরিবহন মালিক-শ্রমিককে এবং যাত্রী হিসেবে জনগণকে নিজেদের ভুল-ক্রটি সম্পর্কে অবগত হতে হবে। কোমলমতি এই শিক্ষার্থীদের রাজনীতি সম্পর্কে শিক্ষাটা ভালো হওয়া দরকার। নয়লে উন্নয়ন ও গঠনমূলক রাজনীতিবিমুখতা প্রজন্ম দেশ ও জনগণের জন্য কল্যাণকর হবে বলে মনে হয় না। জরুরি সমস্যায় যানজট কাটিয়ে অন্য কোনোদিক দিয়ে যাওয়ার বিকল্প কোনো পথ না থাকায় অ্যাম্বুলেন্সে মুমূর্ষু রোগীর সমস্যা হয়। পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর মতো ‘ইমার্জেন্সি লেন’ থাকার ব্যবস্থাসহ ঢালাওভাবে পুলিশকে দোষ না দিয়ে যথোপযুক্ত ‘ট্রাফিক সিগনাল’ মেনে চলার মতো ব্যবস্থা তৈরি করা দরকার। আমরা সাধারণ মানুষ ‘ট্রাফিক সিগনাল’, আইন, গাড়ির হালনাগাদ নির্দিষ্ট কাগজ রাখি না বলেই বিপত্তি ঘটে থাকে। গত বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে মিরপুর-১৩, ১৪ এলাকায় পুলিশ ও কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবককে শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করতে দেখা গেছে। এগুলো সরকারকে বিপাকে ফেলার নামান্তর। আমাদের সহনশীলতার চর্চা করা দরকার। ‘গাছ আমার, আপেল আমার এবং জমিও আমার’ হলে সেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়া কঠিন। পরিবহন খাতে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভ‚ত সমস্যা মোকাবেলায় নেব নেব করে বাস্তবসম্মত কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় আজকের এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এটি সমাধানের জন্য উপযুক্ত শান্তিপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়ার সময় এখন সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের। প্রধানমন্ত্রী এক বাক্যে শিক্ষার্থীদের সব মানবিক ও যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়েছেন। সরকারকে কাজ করার মতো একটু সময় দিতে হবে। আর তাই, শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাক। আর রাস্তায় অবস্থান নয়। পরিবেশ স্বাভাবিক না হলে ষড়যন্ত্রকারীরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করার সুযোগ পেয়ে যাবে। নিরাপদ সড়ক ও নিরপরাধ জীবন রক্ষার এই মানবিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে কেউ যদি অপব্যবহার করার চেষ্টা করে সরকারের উচিত হবে তা কঠোরভাবে দমন করা। শিক্ষার্থীদের বিপথগামী করার কোনো সুযোগ যেন কেউ না পায়। কেননা শিক্ষার্থীরা নিরপরাধ। তারা তার ভাইয়ের, বন্ধুর রক্ত সহ্য করতে পারেনি বলেই রাস্তায় নেমেছে। বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাদের রাস্তা থেকে সরাতে হবে, বল প্রয়োগ করে নয়। মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান : শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App