×

মুক্তচিন্তা

বর্ষীয়ান সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেন

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০১৮, ০৮:০৫ পিএম

 
আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত কিছু মৌলিক শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তাই খুব সহজেই এটি ভাঙবেও না বা নড়বড়েও হবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে কিছু যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারলে খুব সহজেই আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতকে আধুনিক ব্যাংকিংয়ের রূপ দেয়া যেতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার এমন ধারণার সঙ্গে শতভাগ একমত এবং এ বিষয়গুলো আমি আমার অনেক লেখায় যথার্থই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
বর্ষীয়ান সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেন গত বুধবার সন্ধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে বড় ক্ষতি হয়ে গেল। কেননা তিনি সারাজীবন আদর্শ সাংবাদিকতা অনুসরণ করেছেন। চটকদার বা নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন থেকে তিনি নিজেকে যথেষ্ট দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যাংক এবং আর্থিক খাতের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। এই পত্রিকাটি দেশের ব্যাংক এবং আর্থিক খাতের বিষয়গুলো সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে থাকে। মোয়াজ্জেম হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে সাংবাদিকতা পেশা বেছে নিয়েছিলেন। যে সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন তখন তিনি ইচ্ছে করলে অন্য পেশার আকর্ষণীয় চাকরি নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটি না করে ইংরেজি অবজারভার পত্রিকায় যোগদান করে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। তার কর্মজীবনে প্রথম সারির সব কয়টি ইংরেজি পত্রিকায় কাজ করেছেন। অবজারভার ছাড়াও তিনি নিউ ন্যাশন, ইউএনবি, ঢাকা কুরিয়ার এবং ডেইলি স্টার পত্রিকার বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। সবশেষে তিনি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রতিটা পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের একটা লক্ষ্য থাকে সেই পেশার শীর্ষ পদটি অর্জন করার। একজন শিক্ষক চান অধ্যক্ষ বা অধ্যাপকের পদটি লাভ করে কর্মজীবন শেষ করা। একজন আমলা সচিব হয়েই অবসরে যাওয়ার স্বপ্ন লালন করে থাকেন। একজন ব্যাংকার এমডি হয়েই অবসরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে থাকেন। তেমনি একজন পেশাদার সাংবাদিকও চান সম্পাদক হয়েই পেশার যবনিকাপাত ঘটাতে। এই চাওয়ায় কেউ সফল হতে পারেন, আবার নাও হতে পারেন। সেই বিবেচনায় মোয়াজ্জেম হোসেন একজন সফল সাংবাদিক যিনি এই পেশার শীর্ষ পদটি অর্জন করেই শুধু পেশায় নয়, জীবনেরও ইতি টানলেন। বাংলাদেশ ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মোয়াজ্জেম হোসেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। তিনি এই ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে আমার পরিচয় লেখালেখির সূত্র ধরে। দেশের গরিব মানুষের ট্যাক্সের টাকায় লেখাপড়া শিখে এই উন্নত দেশে এসে তাদের সেবা করার কারণে সবসময়ই একটা অপরাধ বোধ কাজ করে। সেই বোধ থেকেই এই উন্নত দেশের দক্ষতা অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু উন্নত ব্যাংকিং ব্যাবস্থা আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের উন্নতিকল্পে তুলে ধরার অভিপ্রায় নিয়ে আমি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসসহ অন্য দুয়েকটি পত্রিকায় অর্থ ও ব্যাংকিংয়ের সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কলাম লিখতে শুরু করি। আমার মতো অতি সাধারণের লেখা কলাম তিনি পাঠ করেছেন কিনা বলতে পারব না। তবে একবার যখন তার সঙ্গে সরাসরি দেখা হয় তখন তিনি আমার লেখার বেশ প্রশংসা করেছিলেন। এতে নিজেকে ধন্য মনে করেছিলাম, কেননা মোয়াজ্জেম হোসেনের মতো বর্ষীয়ান সাংবাদিক যখন কারো লেখার প্রশংসা করেন তখন এর থেকে বড় স্বীকৃতি আর কি হতে পারে। ২০১৬ সালে যখন বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছিলাম তখন তিনি তার শত ব্যস্ততার মাঝেও আমাকে যথেষ্ট সময় দিয়েছিলেন। দেশের অর্থনীতি এবং ব্যাংকিংয়ের সমসাময়িক অনেক বিষয় নিয়ে তিনি খোলামেলা আলোচনা করেছেন। আলাপকালে তিনি অতিমাত্রায় আমানতের ওপর সুদের হার কমিয়ে দেয়ায় আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন যে দেশ এখন ঋণাত্মক (নেগেটিভ) সুদের হারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাতের ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ নিয়ে তার মারাত্মক শঙ্কা ছিল। এ দুটি বিষয় নিয়ে তিনি আমাকে লিখতেও বলেছিলেন। আমি তার কথা রাখতে পেরেছি এমন দাবি করতে না পারলেও এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আমি অনেক কলাম ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসসহ একাধিক পত্রিকায় লিখেছি। তখন আলোচনার সময় তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে আমাকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন যা আমার কাছে এক আমূল্য সম্পদ এবং প্রতিটা কলাম লেখার সময় আমি তা মেলে চলতে চেষ্টা করি। এ জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। একপর্যায়ে তিনি আমাকে জানালেন যে বাংলাদেশে ব্যাংকের প্রায়োগিক দিক নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কলাম লেখকের সংখ্যা খুব। তাই আমি যেহেতু বিগত কয়েক বছর ধরে একটানা ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের কলাম লিখে আসছি তাই ভবিষ্যতেও যেন এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি। ব্যক্তিগত নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সেই প্রচেষ্টা আমি অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে চলছি। মোয়াজ্জেম হোসেন একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন। এ কারণে ব্যাংকিং খাত নিয়ে তার একটি বিশেষ আগ্রহের জায়গা ছিল। আমার সঙ্গে আলোচনার দীর্ঘ একটা সময় জুড়ে ছিল দেশের ব্যাংকিং খাত। এ খাতের নানান অনিয়ম নিয়ে তার যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে পুরোটা আলোচনাজুড়েই। তবে তিনি অন্য সবার মতো এ খাত একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে এমন দাবি করতে নারাজ। এ খাত নিয়ে তিনি তার আশাবাদও ব্যক্ত করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত কিছু মৌলিক শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তাই খুব সহজেই এটি ভাঙবেও না বা নড়বড়েও হবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে কিছু যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারলে খুব সহজেই আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতকে আধুনিক ব্যাংকিংয়ের রূপ দেয়া যেতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার এমন ধারণার সঙ্গে শতভাগ একমত এবং এ বিষয়গুলো আমি আমার অনেক লেখায় যথার্থই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। মোয়াজ্জেম হোসেন টেলিভিশনের টকশোতেও অংশ নিয়ে দেশের ব্যাংক ও অর্থনীতির সমসাময়িক বিষয় নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা করেছেন। আমি সুদূর কানাডা থেকে যে কয়েকজন আলোচকের টকশোর আলোচনা মনোযোগ দিয়ে শুনি তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন। শেষের দিকে তিনি টেলিভিশনের টকশোতে আশা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিলেন। এ বিষয়েও কথা উঠলে তিনি সাবলীলভাবে বলেছিলেন যে এখন টকশোগুলো যেভাবে সঞ্চালন করা হয় তাতে তিনি আর সেখানে কথা বলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তাই এই আলোচনায় অংশ নেয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছিলেন। নিজে টকশোতে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকলেও কখনই অনেকের মতো এই অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা বলে ঝড় তোলার মতো মানুষ মোয়াজ্জেম হোসেন কখনোই ছিলেন না। লেখালেখি মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যমে যা মানুষের মাঝে এক নিবিড় বন্ধন গড়ে তোলে এবং অতি পরকেও আপনের থেকে আপন করে তোলে। অফিসে কাজ করার মাঝে অনলাইনে দেশের পত্রিকাগুলোতে চোখ বোলাতে গিয়ে তার মৃত্যু সংবাদটি দেখামাত্র মনটি ভয়ানক বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। আমি তার আত্মীয়ও নই বা পেশায় সাংবাদিকও নই। তবুও তার মৃত্যুতে বারবার মনে হচ্ছিল যে অতি আপন কেউ যেন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। সাংবাদিকতা দিয়ে মোয়াজ্জেম হোসেন জীবন শুরু করেছিলেন, সেই সাংবাদিকতা দিয়েই জীবন শেষ করলেন। ৭০ বছর বয়সে বর্ণাঢ্য এক সাংবাদিকতা জীবনের ইতি টেনে মোয়াজ্জেম হোসেন চলে গেলেন না ফেরার দেশে সেখানে তিনি ভালোই থাকবেন, শান্তিতেই থাকবেন। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করি। টরনটো, কানাডা নিরঞ্জন রায় : ব্যাংকার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App