×

মুক্তচিন্তা

পাহাড় কিংবা সমতলে কোথায় নারীর নিরাপত্তা?

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০১৮, ০৮:০১ পিএম

 
পূর্ণার ঘটনাসহ দেশের সব ধর্ষণ ও হত্যা স্পষ্টত বাংলাদেশের নারীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। এসব ক্ষেত্রে নারী সমাজের মৌলিক অধিকারও লুণ্ঠিত হচ্ছে দুষ্কৃতদের দ্বারা। অপরাধীদের অপতৎপরতায় আমরা নারীরা ক্রমশই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছি। আমরা না পাচ্ছি সুষ্ঠু বিচার, না পাচ্ছি কারো সহযোগিতার মঙ্গলময় হাত। ক্রমাগত মানসিক যন্ত্রণায় কুরে কুরে নিঃশেষ হচ্ছি।
যে সবুজ পাহাড় ও স্নিগ্ধ আলোয় আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সেখানে এখন নরখাদকদের বিচরণ। আমি নিজে যেসব জনপদে নিশ্চিন্তে শৈশবে হেসে খেলে বেরিয়েছি সেখানে এখন নরজন্তুদের অবাধ চলাচল। আমরা কি অপরাধী পরিবেষ্টিত এ রকম পার্বত্যাঞ্চল চেয়েছিলাম? আমরা কি শিশুদের জন্য বীভৎস জগতের স্বপ্ন দেখেছিলাম? প্রকৃতির মায়া আর স্থানীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে যে জীবন তা তো সুখ আর স্বস্তিদায়ক হওয়ারই কথা। অথচ কিছু ঘটনা আমাদের মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে; হতবিহ্বল হয়ে পড়েছি আমরা। ২৮ জুলাইয়ের ঘটনা আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার নয়মাইল এলাকার ত্রিপুরাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৯ বছরের ছাত্রী পূর্ণা ত্রিপুরাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। জন্মের ৫ বছর পর শিশুটির বাবা মারা যায়। পিতৃহীন ছোট্ট শিশুর সেই ক্ষত-বিক্ষত নিথর দেহ আমার বেঁচে থাকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দেশব্যাপী নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। পার্বত্য এলাকায় এর আগেও ঘটেছে দুর্বৃত্তদের দ্বারা এরকম অনেক ঘটনা। কেবল পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া শিশুর জীবনে মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটেনি; পরিসংখ্যান বলছে এই পরিস্থিতি আরো বেশি ভয়াবহ। এখন আমি আতঙ্কিত নিজেকে নিয়ে; আমি শঙ্কিত পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত আমার আত্মীয় পরিজনদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। আমাদের কন্যা শিশুদের আমরা কি নরপশুদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারব? শিশুটি যখন স্কুলে তখন তার মা জুম চাষের কাজে ছিলেন। পাহাড়ের বাস্তবতা হলো খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের বাস্তবতা; প্রতিদিনের কাজের সংগ্রাম। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার লড়াই। সেখানে শহরের মা-বাবার মতো শিশুর জন্য স্কুলের সামনে বসে থাকার অবকাশ নেই। তাকে আনা-নেয়া নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণও নেই। যে এলাকাটিতে শিশুটির জন্ম, যেখানকার সে মৃত্তিকার সন্তান; সেই স্থানীয় অঞ্চলে দুর্বৃত্তের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ারও কারণ নেই। আশ্চর্য হলো সেখানেও অপরাধীদের বিচরণ এখন কদর্যভাবে সত্য হয়ে উঠেছে। ওই শিশুটির মার জুম চাষে যাওয়ার প্রসঙ্গটি আমাকে মনে করিয়ে দিল গত ১৯ মে ২০১৮ সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল মহাদেবপুর পাহাড়ের ত্রিপুরা পাড়ায় আদিবাসী দুই কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনা। সেখানেও জুমচাষের জন্য মা-বাবা কিশোরী সুখলতি ও ছবি রানীকে ঘরে রেখে পাহাড়ে চলে যান। বিকেলে নিজ ঘরে ফেরার পর পুনেল ত্রিপুরার বসতঘরের একটি কক্ষে দুই কিশোরীকে ঝুলন্ত ও মৃত অবস্থায় দেখা যায়। আমাদের নারীদের প্রতি সহিংসতার এ রকম ঘটনা আরো আছে। আদিবাসী নারী ধর্ষণ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো জায়গায় নারীরা আর নিরাপদ নয়। চলতি বছর ১৭ জুন বান্দরবানের লামায় নিজ বাসায় ম্যাহ্লাউ মার্মা নামে এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আদিবাসী জনপদে ধর্ষণকে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি বলে দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই। কেবল খাগড়াছড়িতে গত ৩ মাসে ৫ কিশোরী ও শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ১৬ ফেব্রুয়ারি (২০১৮) রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে উনিশ বছরের এক মারমা তরুণী ধর্ষিত হয়েছেন আর তার কিশোরী বোনটি যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ৩৬৪ আদিবাসী নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। তার মধ্যে ১০৬ জন শারীরিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, ১০০ নারী ধর্ষণের শিকার হন এবং ৬৬ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৮ সালের কেবল জানুয়ারি মাসেই ১০ জন ধর্ষণের শিকার হন তার মধ্যে তিনজনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণের পর মেরে ফেলা হয়েছিল সবিতা চাকমা, সুজাতা চাকমা, ছবি মারমা আর তুমাচিং মারমাকে। আনুবীক্ষণিক দৃষ্টি দিলে দেখা যায় কেবল ২০১৫ সালে পার্বত্য এলাকায় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৮৫ জন নারী ও কন্যাশিশু। তাদের মধ্যে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার ২৬ জন, হত্যা করা হয়েছে ৩ জনকে, ১১ জন শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত, ধর্ষণের চেষ্টা ১৬ জনকে, ৫টি অপহরণ, ৬টি শারীরিক ও যৌন হয়রানি এবং দুটি পাচারের ঘটনা ঘটেছে। আর উচ্ছেদের হুমকিতে দিন কেটেছে অধিকাংশ পরিবারের। আসলে আদিবাসীরা এখন জাতিগত সহিংসতার শিকার। আমরা জানি জাতিগত নির্মূলের অন্যতম ঘৃণ্য কৌশল হলো নারী ধর্ষণ। যুদ্ধকালে সামরিক কৌশল অনুযায়ী পরিকল্পিত ধর্ষণের ঘৃণ্যতম নজির দেখা গেছে বসনিয়ার যুদ্ধে, সিয়েরা লিওনে, লাইবেরিয়াসহ আফ্রিকার দেশগুলোতে। কমবয়সী বাচ্চা মেয়েদের ধর্ষণ আর যৌন হয়রানির জন্য টার্গেট করা হয় যুদ্ধের ময়দানে। আদিবাসী জীবনে এখন তো আর যুদ্ধ নেই; তবু কেন শিশু হত্যা ও ধর্ষণ চলছে? গবেষকরা বলে থাকেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণসহ সব মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটনার বিচার বিশ্লেষণ করতে হলে তা বিশেষ ঐতিহাসিক বাস্তবতার নিরিখেই করতে হবে। এক সময় গণধর্ষণ, বিশেষ করে কমবয়সী মেয়েদের ধর্ষণসহ অঙ্গচ্ছেদ এবং ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা ছিল পার্বত্য এলাকার সহিংসতার অন্যতম ইতিহাস। অনলাইন নিউজের সূত্র মতে, কেবল ১৯৯২ থেকে ১৯৯৩ সালেই পার্বত্য চট্টগ্রামের মাল্যা, লোগাং আর ন্যান্যারচরে তিনটি ম্যাসাকার (গণহত্যা) সংঘটিত হয়। এই ম্যাসাকারের সঙ্গে সংঘটিত ধর্ষণের মধ্যে ৯৪ শতাংশ করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। ধর্ষিতাদের ৪০ শতাংশই ছিল নাবালিকা, শিশু। ধর্ষিতাকে সমাজ আর পরিবার কলঙ্কিত বলে আর গ্রহণ করে না। তাই গণধর্ষণের ফলে শিশুর জন্মরোধ করার চেষ্টা করা হয়। লোকলজ্জা আর ভয়ের দীর্ঘস্থায়ী এক মানসিক আঘাতে (ট্রমা) আক্রান্ত হয় ধর্ষিতা আর তার পরিবার। স্পষ্টতই এই আক্রমণ আমাদের অস্তিত্ব বিপন্নকরণের নীতি হিসেবে চিহ্নিত। রাজনীতিবিদদের বলতে চাই, পাহাড়ের মাটি চাইলেই হবে না পাহাড়ের মানুষদের গুরুত্ব দিতে হবে। পাহাড়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও ত্রাসের সংস্কৃতি বজায় থাকলে আমরা উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবো। বলাবাহুল্য, কোনো সরকারের আমলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা হামলামুক্ত নিরাপদ জীবন পায়নি। পূর্ণার ঘটনা প্রমাণ করে, পার্বত্য এলাকায় ধর্ষণ কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পূর্বে উল্লিখিত ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা পর্যালোচনা করলে তাই একে পরিকল্পিত ধর্ষণ বলতে হয়। পূূর্ণা ত্রিপুরার পরিণতি আমাদের জানান দিচ্ছে যে, আদিবাসী জনপদ যদি অপরাধীদের দখলে চলে যায়, তাহলে আমাদের অবাধ বিচরণ ও নিশ্চিন্ত বসবাসের আর জায়গা থাকবে না। পূর্ণার ঘটনাসহ দেশের সব ধর্ষণ ও হত্যা স্পষ্টত বাংলাদেশের নারীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। এসব ক্ষেত্রে নারী সমাজের মৌলিক অধিকারও লুণ্ঠিত হচ্ছে দুষ্কৃতদের দ্বারা। অপরাধীদের অপতৎপরতায় আমরা নারীরা ক্রমশই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছি। আমরা না পাচ্ছি সুষ্ঠু বিচার, না পাচ্ছি কারো সহযোগিতার মঙ্গলময় হাত। ক্রমাগত মানসিক যন্ত্রণায় কুরে কুরে নিঃশেষ হচ্ছি। আমাদের মানবাধিকার রক্ষার ব্যবস্থা সরকারকেই নিতে হবে। আমরা নারীরা যেখানেই থাকি যেভাবেই থাকি যে মতের থাকি যে দলেরই থাকি আমরা যদি নিরাপদ থাকি তাহলে বুঝব গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নতুবা নয়। সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন যদি আদিবাসী মানুষের হত্যার বিচার করতে না পারে, নারী ধর্ষণের বিচার করতে না পারে, আমাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে না পারে; তাহলে আমাদের বেঁচে থাকার সার্থকতা কোথায় বলতে পারেন? আমরা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধকে এতদিন সুরক্ষিত করে রেখেছি, ঠিক সেখানেই ধর্ষণ হয়েছে আর ধর্ষণ করেছে পাহাড়ে অনুপ্রবেশকারী কিংবা দুর্বৃত্তরা। যৌনহয়রানি, ধর্ষণ করে পুরুষরা। কাজেই এ ব্যাপারে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে পুরুষদেরই; সংশোধিত হতে হবে আগে তাদের। ধর্ষণের মতো বর্বরতা এবং মানবতাবিরোধি অপরাধের বিরুদ্ধে দেশের সব মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের প্রতিবাদ করা দরকার। অপরাধীদের প্রতিরোধ করার জন্য অসহায় মানুষের পাশে সাহস নিয়ে দাঁড়াতে হবে। মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম আমরা চালিয়ে যাব আজীবন। পূর্ণার মতো কন্যাশিশুরা আর কোনোদিন নৃশংসভাবে খুন হবে না- এই প্রত্যাশা আমার। জ্যোৎস্না তঞ্চঙ্গ্যা : কলাম লেখক ও চাকরিজীবী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App