×

আন্তর্জাতিক

আসামে ৪০ লাখ নাগরিকত্ব বাতিল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০১৮, ১১:২৪ এএম

আসামে ৪০ লাখ নাগরিকত্ব বাতিল
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে আদমশুমারির পর খসড়া নাগরিকপঞ্জির সংশোধনী তালিকা প্রকাশ করেছে কর্তৃপক্ষ। এতে জায়গা পায়নি সেখানকার ৪০ লাখ বাসিন্দার নাম, যার অধিকাংশই বাঙালি। তালিকাভুক্ত হতে না পারায় শঙ্কার মধ্যে পড়ে গেছে এদের ভবিষ্যৎ। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে উচ্ছেদ হয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মতো পরিণতির শিকার হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে লাখ লাখ পরিবার। গতকাল সোমবার রাজ্যজোড়া থমথমে পরিস্থিতির মধ্যেই এ তালিকা প্রকাশ করে দেশটির ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস (এনআরসি)। আসাম সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়া অবৈধ বাংলাদেশি উচ্ছেদের ডাক দিয়ে গত বছর সেখানে আদমশুমারি কর্মসূচি শুরু করে রাজ্যের সদ্য গদিনশীন বিজেপি সরকার। এতে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করেছিল মোট ৩ কোটি ২৯ লাখ। এসব আবেদনের তথ্য-উপাত্ত যাচাইয়ের পর সর্বশেষ ২ কোটি ৮৯ লাখ আবেদন মঞ্জুর করেছে কর্তৃপক্ষ। এর আগে চলতি বছর ১ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রথম তালিকায় ঠাঁই পায় এক কোটি ৮০ লাখ মানুষের নাম। নাগরিকত্ব পাওয়ার শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে, যেসব নাগরিক ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকে আসাম রাজ্যে তাদের থাকার সপক্ষে প্রমাণ হাজির করতে পারবেন, কেবল তাদেরই বৈধ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে। কিন্তু সেই প্রমাণ দিতে না পারায় রাজ্য থেকে বহিষ্কার হওয়ার হুমকির মধ্যে পড়ে গেছে এই ৪০ লাখ মানুষ। সে বছর ওই তারিখের একদিন পর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে বাংলাদেশ। যুদ্ধ শুরুর পরবর্তী সময়ে সীমান্ত অতিক্রম করে লাখ লাখ বাঙালি ঠাঁই নেয় আসামে। বিবিসি সাংবাদিকের কাছে হাসিতুননেসা নামে ৪৭ বছর বয়সী এক স্কুলশিক্ষিকা বলেন, আসাম উপত্যকার বাইরে পৃথিবীর সঙ্গে কখনো চেনাজানা হয়নি তার। একাত্তরে আমার পরিবার এখানে আসে, শৈশব কাটিয়েছি এখানে, লেখাপড়া শেষ করেছি, এরপর বিয়ে হলো, চারটি ছেলেমেয়ে হলো, অথচ আমার নাকি নাগরিকত্ব নেই। এবার আমার জমি কেড়ে নেয়া হবে, ভোটের অধিকার, স্বাধীনতা সবকিছু কেড়ে নেয়া হবে, অভিযোগ করেন তিনি। হাসিতুননেসার মতো অনেক বাঙালি তাদের বসতি গড়েছেন বহ্মপুত্রের তীরে। নদীর পানি বেড়ে উঠলে তাদের ঘরসংসার গুটিয়ে সরে যেতে হয় অন্য এলাকায়। এ বাস্তবতায় কারো কাছে যদি কাগজপত্র কিছু কিছু থেকেও থাকে, তার কোনো কার্যকারিতা না থাকাটাই স্বাভাবিক। আসাম সরকার এর আগে বলেছিল, অবৈধ বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করার পর তাদের ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যেই নাগরিকপঞ্জি চূড়ান্ত করা হচ্ছে। তবে গতকালের তালিকা প্রকাশের পর সহিংসতার আশঙ্কায় এনআরসির রেজিস্টার জেনারেল শৈলেশ বলেন, প্রকাশিত এ তালিকাটিও চ‚ড়ান্ত নয়। তালিকায় যাদের নাম নেই তাদের এখনই বের করে দেয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই আমাদের। যাদের নাম ওঠেনি তারা আবারো আপিল করার সুযোগ পাবেন। আপিল করার জন্য ৩০ আগস্ট থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক মাসের সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে খসড়া এ নাগরিক তালিকা ঘিরে গোটা রাজ্যজুড়ে সংঘাত ও সংঘর্ষের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন পর্যবেক্ষকরা। সংখ্যালঘু অভিবাসী বাঙালি বিশেষত মুসলিমরা ‘উইচ-হান্টিংয়ের শিকার’ হতে পারেন বলে মনে করছেন তারা। এদিকে বাঙালি অধিকার আন্দোলনের নেতা নজরুল আলি আহমেদ কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, সহিংসতা উসকে দেয়ার লক্ষ্যেই এসব কাজ করছে এনআরসি। মুসলিমদের রাজ্য থেকে বের করে দেয়া হবে বলে প্রকাশ্যেই হুমকি দিচ্ছে তারা। রোহিঙ্গাদের মতোই পরিণতি হতে পারে আমাদেরও। এ ধরনের আশঙ্কাকে ‘অমূলক’ অভিহিত করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, এনআরসির কাজটি একেবারেই অরাজনৈতিক। দেশের সর্বোচ্চ আদালত রয়েছে এর কাজের দেখভাল করার জন্য। বিজেপি অনেক আগে থেকেই বলে এসেছে, অবৈধ মুসলিমদের বহিষ্কার করা হবে। কিন্তু ‘বহিষ্কৃতদের’ ফিরিয়ে নেয়ার তেমন কোনো সাদর আয়োজন নেই বাংলাদেশের মধ্যেও। ফলে প্রকৃত বিচারে নাগরিক তালিকা প্রণয়নের মধ্য দিয়ে রাজ্যহারা একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্ম দিল ভারত, একটি নতুন সংকটের জন্ম দিল এতদাঞ্চলে। রোহিঙ্গা সংকট সামাল দিতে এমনিতেই বিপুল চাপের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। তার ওপর আসাম থেকে নতুন কোনো শরণার্থী ঢল বাংলাদেশমুখী হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে বিষয়টি সহজে নেবে না তারাও। বাংলাদেশের সঙ্গে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক টানাপড়েনের মধ্যে ঠেলে দেয়ার মতো পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আরো সুবিবেচনার পরিচয় দেয়া প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আসাম রাজ্যে ২৩ হাজার আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তেও। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে প্রতিবেশী অরুণাচল, মণিপুর, মেঘালয় ও নাগাল্যান্ড রাজ্যগুলোতেও কড়া সতর্কতা জারি করা হয়েছে। মুসলিম জনসংখ্যা বিচারে ভারতে দ্বিতীয় অবস্থান আসামের। গত কয়েক দশকে রাজ্যটিতে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। এ পর্যায়ে সেখানে তৈরি হয়েছে আসামের প্রকৃত নাগরিক এবং ‘বহিরাগত’ এই দুটি বিভাজন। তবে ‘বহিরাগত’ বলতে সেখানে মূলত বোঝানো হয় বাংলাদেশ থেকে আসামে যাওয়া অভিবাসী নাগরিক। ভারতের অভিবাসীসংক্রান্ত নতুন আইনে বলা হয়েছে, যাদের নাগরিকত্ব নিয়ে সরকার নিশ্চিত নয়, তাদের দাবির সপক্ষে প্রমাণপত্র তাদের নিজেদেরই হাজির করতে হবে। প্রায় পঞ্চাশ বছর কিংবা তারও আগে সেখানে যাওয়া এ জাতীয় অনেক মানুষের উত্তরপুরুষের প্রতিনিধি, হাসিতুননেসার মতো সবাই বলছেন, বাপ-দাদারা এসব প্রমাণ কিংবা নথি সংরক্ষণ করার কথা ভাবেননি কখনো। এ অবস্থায় আমাদের পক্ষে প্রকৃত নাগরিকত্ব প্রমাণ করা কীভাবে সম্ভব?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App