×

জাতীয়

অভিযানের মধ্যেও ৩ কারণে বন্ধ হচ্ছে না মাদক বিক্রি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০১৮, ০২:০৩ পিএম

অভিযানের মধ্যেও ৩ কারণে বন্ধ হচ্ছে না মাদক বিক্রি
মরণনেশা ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য নিমূলে রাজধানীসহ সারাদেশে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের সাড়াশি অভিযানে প্রতিদিনিই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরা পড়ছে মাদক বিক্রি ও সেবনের সঙ্গে জড়িতরা। পাশাপাশি মাদক কারবারীদের সঙ্গে পুলিশের কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মাঝেমধ্যেই প্রাণ হারাচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এতকিছুর পরও বন্ধ হয়নি না মাদকের বিকিকিনি। এখনো হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা। পুলিশ ও র‌্যাব সদর দপ্তরের সূত্র অনুযায়ী, গত ৪ মে থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত মাদক বিরোধী অভিযানে ১৫৩ জন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। এরমধ্যে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৮৪ জন, র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৩৫ জন এবং মাদক ব্যবসায়ীদের দু’পক্ষের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে ৩৫ জন। তবে পত্রপত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, গত ৪ মে থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ১৭৮ জন মারা গেছেন। এছাড়াও চলতি মাসে ৪ জুলাই ১ জন, ৫ জুলাই ২ জন, ৭ জুলাই ১ জন, ৮ জুলাই ৪ জন, ১০ জুলাই ১ জন, ১১ জুলাই ৬ জন এবং ১৩ জুলাই ৩ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন। একই সময়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় ২২ হাজার মাদক ব্যবসায়ীকে। অপরাধ বিশ্লেষক ও মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, চলমান বিশেষ অভিযানের কারণে মাদক কারবারী ও সোর্সরা চাপের মুখে পড়লেও ৩ কারণে তাদের পুরোপুরি তৎপরতা বন্ধ হয়নি। এখনো সীমান্তের ফাঁক গলে বিভিন্ন রুট হয়ে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। মাদক পাচারের রুটগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে চলমান অভিযান চালিয়ে কাঙ্খিত সাফল্য আসবে না। চলমান অভিযানে খুচরা মাদক কারবারীরা ধরা পড়লেও রাঘব বোয়ালরা থেকে গেছে অধরা। আবার ধরা পড়ার ভয়ে দেশান্তরী হয়েছেন অনেক মাদক ব্যবসায়ী। অন্যদিকে যারা মাদক নিমূলে কাজ করছে সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তা মাদকের অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় এই সমস্যা আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। কিছুদিন আগে মাদক কারবারীদের সঙ্গে সখ্যতার কারণে চট্টগ্রামের রেঞ্জের ডিআইজি এসএম মনির-উজ-জামানকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। এছাড়া, মাদক ব্যবসায়ীকে পালাতে সহযোগিতার অভিযোগে ২৯ মে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা মডেল থানার ওসি আকরাম হোসেন এবং ঘুষ নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের ছেড়ে দেয়ার অভিযোগে ৩০ মে ফরিদপুরের চরভদ্রাসন থানার এএসআই জুয়েল হোসেনকে প্রত্যাহারের খবর পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি (ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স) মো. মনিরুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, মাদকের আজকের যে ভয়াবহ সমস্যা সেটা একদিনে হয়নি। যার কারণে এই সমস্যার সমাধানও হঠাৎ করেই করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, মাদক নিমূলে পুলিশের সামর্থের অনুযায়ী অনেকটুকু দিয়েছে। এরপরও নানা কারণে সহজেই মাদক নিমূলে করা যাচ্ছে না। এর সঙ্গে পুলিশের কিছু লোকজন বা সরকারি কিছু লোকজন জড়িয়ে পড়েছে, যার কারণে এই সমস্যাটা বেশি প্রকট হয়ে পড়েছে। পুলিশের মধ্যে যারা মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে কিংবা মাদক কারবারীদের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে তাদেরকে চিহ্নিত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। যাদেরকে চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এদেরকে সাসপেন্ট করা হচ্ছে, মামলা দেয়া হচ্ছে, চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। এরইমধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এটা অব্যাহত থাকবে। যাতে করে সবাই একটা ম্যাসেজটা পায়। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত ডিআইজি মনিরুজ্জামান বলেন, মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার সুবিধার্থের রাজনৈতিক দলের সেল্টার নিয়ে থাকে। রাজনৈতিক ছত্রছায়া থাকলে তারা সহজেই মাদক ব্যবসার প্রসার ঘটাতে পারে। যারা মাদক ব্যবসায়ীদের সেল্টার দিচ্ছে এদেরকেও চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। মাওলানা ভাষানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সাইন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ওমর ফারুক ভোরের কাগজকে বলেন, মাদকের যারা ডিলার, বিক্রেতা আছে তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি সবার আগে দরকার যারা মাদকসেবী তাদের চিকিৎসা দেয়া। মেডিকেল ট্রিটমেন্টের পাশাপাশি তাদের কাউন্সিলিং করাতে হবে। মাদকের সেবন বন্ধ হলে এর সরবারহও কমে যাবে। অধ্যাপক মো. ওমর ফারুক বলেন, মাদক নির্মূলে রাষ্ট্রকে ৩টি পদক্ষেপ নিতে হবেÑ প্রথমত মাদকের উৎপাদন, সরবারহ, পাচার বন্ধে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, যারা মাদক সেবনে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে তাদেরকে সেবন থেকে ফেরাতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে আইনের আওতায় না এনে। তৃতীয়ত, যারা মাদক নির্মূলে কাজ করছে সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য মাদকের সঙ্গে জড়িত। কিছুদিন আগে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্যতার কারণে চট্টগ্রামের ডিআইজিকে প্রত্যহার করা হয়েছে। প্রতিটি থানার পুলিশ কোনো না কোনোভাবে মাদকের সঙ্গে জড়িত। সুনির্দিষ্টভাবে তাদের কাছে তথ্য আছে, কোন এলাকা কারা মাদক ব্যবসা করছে। মাদকের নামে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। অনেক সময় টাকার বিনিময় নিরাপরাধ লোককে ধরে চালান করছে। আবার প্রকৃত অপরাধীকে টাকার বিনিময় ছেড়ে দিচ্ছে। তবে পুলিশে অনেক ভালো লোক রয়েছেন, কিন্তু যারা মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সূতরাং, মাদকের উৎস কোথায়, কারা সরবারহ করছে, কারা সেবন করছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে কারা জড়িত আছে Ñএই বিষয়গুলি নিয়ে রাষ্ট্রকে সোচ্চার হতে হবে, তবেই মাদক বন্ধ করা সম্ভব হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App