×

মুক্তচিন্তা

সংসদে সংরক্ষিত আসন ও নারীর ক্ষমতায়ন

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০১৮, ০৭:৪৩ পিএম

জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে কতজন প্রতিনিধি রয়েছে তারচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত পুরুষ সদস্যদের সমান অধিকার কিংবা সুযোগ ভোগ করছে কিনা। রাজনৈতিক দল বিধি অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরের কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ পদে নারীদের জন্য সংরক্ষণ বাধ্যতামূূলক রয়েছে। কিন্তু সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী কিংবা সংসদের বাইরে থাকা কোনো দলই সেসব শর্তের কাছাকাছিও আসতে পারেনি।

এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ (এএসবি) ৩০ জুন তাদের পঞ্চম মাসিক সভা উপলক্ষে গণতান্ত্রিক সমাজে নারীর সমতা ও রাজনীতি বিষয়ক একটি বক্তৃতার আয়োজন করেছিল এবং এই আয়োজনে প্রবন্ধ উপস্থাপক ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতির বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নাসরিন আখতার হোসেন। এই প্রবন্ধে উল্লিখিত হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন বাদ দিলে ৩০০ আসনে সরাসরি নির্বাচিত নারীর আসন সংখ্যা ২০ যা শতকরা হার ৬.৭। এর সঙ্গে যদি সংরক্ষিত ৫০ নারী আসন যোগ হয় তাহলে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৭০ যা মোট ৩৫০টি আসনের মাত্র শতকরা হারে ২০ যা ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ১৪তম জাতীয় নির্বাচনের আসন চিত্র। এই সংখ্যাটি নবম সংসদে ছিল ১৮.৬ শতাংশ এবং প্রথম জাতীয় সংসদে (১৯৭৩-৭৫) ছিল ৪.৮ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নব্বইয়ের দশক থেকে নারী প্রধানমন্ত্রীরাই দেশ শাসন করে চলছেন। তারপরও নারীর ক্ষমতায়ন কিংবা নারী নেতৃত্ব দেশের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠার গতি এত মন্থর কেন যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেত্রী, সংসদ উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা, কৃষিমন্ত্রী এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার মহিলা।

তুলনামূলক বিচারে এই জায়গাটিতে আমরা পিছিয়ে সত্যি কিন্তু সেটার উন্নতিকল্পে বাংলাদেশ সংসদে সূচনালগ্ন থেকেই সংরক্ষিত নারী আসন প্রবর্তন হয় যা প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (১৯৭৩-৭৫) সময় ছিল ১৫টি যা বর্তমানে দশম সংসদ নিবাচনে (২০১৪-২০১৮) রয়েছে ৫০টি। এই সংরক্ষিত আসন নিয়ে পক্ষের-বিপক্ষের অনেক যুক্তি রয়েছে এবং বর্তমানে উদার অর্থনীতির যুগে কোনো মানুষ সে নারী কিংবা পুরুষই হোক সংরক্ষিত হয়ে থাকতে চায় না আর নারীরা তো নয়ই। তারা নিজের যোগ্যতার বিচারে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ সদস্য হতে চায় সংরক্ষিত কোঠায় নয়। এটা মনে করা হয় একটি বৈষম্যমূলক আচরণ বিশেষত যারা সরাসরি নির্বাচিত জনগণের ভোট দ্বারা। আবার সংসদে আইন প্রণয়নের কথা বাদই দিলাম স্থানীয় পর্যায়ে সংরক্ষিত মহিলারা যে জেলার প্রতিনিধি সেখানে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তাদের কোনো প্রকার প্রাধান্য কিংবা ক্ষমতার প্রয়োগের সুযোগ খুবই সীমিত বিশেষত সরাসরি ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের চেয়ে। সংসদে বসে তারা কোনো ফলদায়ক আলোচনা কিংবা মাসব্যাপী বাজেট সেশনের আলোচনায় অংশ নেবে এমন তাদের অনেকেরই সক্ষমতা নেই। নারীর সংরক্ষিত আসন সংখ্যা নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক দলের আকারের ওপর অর্থাৎ যে দলের প্রতিনিধিত্ব সংসদে যত বেশি তাদের সংরক্ষিত আসন সংখ্যা তুলনামূলক অনেক বেশি এবং এই আসনগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে আসে যেমন বাবা, চাচা কিংবা মামা সংসদ সদস্য ছিল এমন একজনকে সেই পরিবার থেকে নির্বাচিত করা হয়। আবার যারা জেলা কিংবা মাঠ পর্যায়ের জাতীয় রাজনৈতিক দলের মহিলা শাখার নেতৃত্বে থাকে তাদের মধ্য থেকে সংরক্ষিত সে জেলার আসনে নির্বাচিত করে থাকে যাদের সংসদীয় কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই বলে চলে। কেবল প্রতিনিধিত্ব করাই মূল বিষয় যা সমাজ, রাজনীতি ও সুশীল সাংবাদিকরা অনেকটাই সমালোচনার চোখেই মূল্যায়ন করে যার ফলে অনেকেই অস্বস্তিবোধ করে।

আশির দশকের হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির শাসনামলে বাংলাদেশের ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারীর আসন ছিল ৩০টি এবং এটিকে কেন্দ্র করে তৎকালীন সাংবাদিক শফিক রেহমান তার সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকার যায়যায়দিনে প্রকাশিত ফিচার সংসদের শোভা ৩০ সেট অলঙ্কার বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল যা কেবল রুচি বিবর্জিতই নয়, মানহানিকরও বটে। বর্তমান সংসদে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যদের নিয়ে যে এরকম হাস্যরস উপহাসমূলক সংবাদ যে প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তা একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। নারীবাদী সংগঠনগুলো এসব সংরক্ষিত আসনের বিলুপ্তি চেয়ে প্রতিযোগিতামূলক ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্যদের প্রতিনিধিত্ব চায়। এ ধরনের যখন একটি সেন্টিমেন্ট রাজনীতির অঙ্গনে বিরাজমান তখনই গত ৮ জুলাই সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদের সপ্তদশ সংশোধনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ আর ২৫ বছর বাড়ানো হয়েছে সত্যি কিন্তু অনেকে প্রশ্ন তুলছেন যে দেশের রাজনীতির কিংবা সমাজনীতিতে নারী সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার ভোগ করছে বা করবে তা জোর দিয়ে যেমন বলা যায় না একইভাবে বিষয়টিকে উপেক্ষাও করা যায় না।

তবে যে পদ্ধতিতে সংরক্ষিত নারী আসনের প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয় তাতে নারীর ক্ষমতায়ন কতটুকু সংঘটিত হচ্ছে সে প্রশ্ন রয়েই যায়। বর্তমান ব্যবস্থায় সাধারণ সদস্যদের প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে রাজনৈতিক দলগুলো সংরক্ষিত আসনের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে অথচ আগের ব্যবস্থা ছিল সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এককভাবে সংরক্ষিত আসনের সদস্যদের বেছে নিত। কিন্তু সংরক্ষিত আসনে নারী সংসদের প্রধান সমস্যাগুলো হলো তাদের জেলাওয়ারি দায়িত্ব দেয়া হয় কোনো নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক নয়। ফলে সংসদীয় আসনের বিপরীতে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা তাদের কোনোরূপ গুরুত্ব দেয় না বিশেষত উন্নয়ন বাজেট বিতরণে কিংবা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে যা অনেকটা গলগ্রহের শামিল বলে প্রতীয়মান। আবার স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরাও তাদের মানতে চায় না।

জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে কতজন প্রতিনিধি রয়েছে তারচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত পুরুষ সদস্যদের সমান অধিকার কিংবা সুযোগ ভোগ করছে কিনা। রাজনৈতিক দল বিধি অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরের কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ পদে নারীদের জন্য সংরক্ষণ বাধ্যতামূূলক রয়েছে। কিন্তু সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী কিংবা সংসদের বাইরে থাকা কোনো দলই সেসব শর্তের কাছাকাছিও আসতে পারেনি।

একটি দেশের উন্নয়নে অনেকগুলো মানদণ্ডের মধ্যে একটি হলো সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের আনুপাতিক হার বৃদ্ধি। সেই ক্ষেত্রে আগের তুলনায় অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বিশেষত শিক্ষার কিংবা উচ্চ শিক্ষার হারে সরকারি; দ্বিতীয়ত, চাকরিতে সংসদীয় কিংবা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে কিন্তু আশঙ্কার কারণ হলো যে গতিতে ও যে পদ্ধতিতে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে তা খুবই মন্থর বা নির্ভুল নয়। এখন রাতারাতি নারী উন্নয়ন সম্ভব নয় তার সঙ্গে সমাজ কাঠামো তথা পরিবার কাঠামো জড়িত যা বৈধ ধরে অপেক্ষা করতে হবে সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর জন্য সংরক্ষিত আসনকে বেছে নেয়া হয়েছে যা বিশ্বের কিংবা প্রতিবেশী দেশগুলোতে বলবৎ রয়েছে বিশেষত সমাজের পশ্চাৎপদে শ্রেণির জন্য যেমন হরিজন, দলিত শ্রেণি, সাঁওতাল ইত্যাদি। উপজাতি শ্রেণির জন্য বাংলাদেশ নৃতাত্ত্বিক শ্রেণি-গোষ্ঠী তেমন নেই। আবার থাকলেও তারা এত বেশি পশ্চাৎপদ যে জাতীয় উন্নয়নে কিংবা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার মতো অবস্থায় নয় তবে সরকার এই ক্ষেত্রে বিশেষত শিক্ষায় ও চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বহাল রেখেছে যার সুফল দেশ ধীরগতিতে পাচ্ছে।

এখন নারীর সংরক্ষিত আসনে যে কায়দায় সংসদ সদস্য পদে দেয়া হচ্ছে তা না করে সেই আসনগুলোতে নারী প্রার্থীদের মাঝে সরাসরি ভোটের আয়োজন করা হয় না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দেখা যাবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলে সংখ্যা ৪৩টি যার মধ্যে গোনাকয়েক দল ছাড়া বাকি দলগুলোর সাংগঠনিক কাঠামোতে সারাদেশের জেলা-উপজেলা, ইউনিয়নে-মৌজায় তাদের কোট নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে না। আবার বড় দলগুলোর জাতীয়, জেলা- উপজেলা ইউনিয়ন পর্যায়ে মহিলা দলের যে কমিটিগুলো রয়েছে সেখানে ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দল কিংবা বিএনপি ছাড়া তেমন কোনো শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। আর যারা কমিটিতে আছে তারা অনেকটা পরিবারতান্ত্রিক যেমন মন্ত্রী, এমপি ও পারিবারিক সদস্য, নিকটতম আত্মীয় ইত্যাদি। আমার মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রমের প্রক্রিয়া তৃণমূল থেকে শুরু হওয়া উচিত যা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে রয়েছে বাংলাদেশে অনুপস্থিত। সেই প্রক্রিয়ায় সব স্তরে যদি এই অনুশীলনগুলো করা হয় তাহলে আমাদের দেশের নারী কিংবা পুরুষ নেতৃত্বের অভাব হবে না এবং তখন নারীর জন্য সংরক্ষিত অমর্যাদাকর আসনগুলোর প্রয়োজন পড়বে না- যা নিয়ে সমাজের অনেকই হাসি-মশকরা করে থাকে; তৃতীয়ত, আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের জন্য নিজেদের সাংগঠনিক কাঠামোতে প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই কিংবা নির্বাচন কমিশন কর্তৃক তার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে। এর বাইরেও তেমন কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে রাজনৈতিক ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ হতে পারে। তাই দেশের সার্বিক কল্যাণে ও নারীর ক্ষমতায়নে সংরক্ষিত আসনের বিষয়টির রূপান্তর ঘটানো উচিত।

ড. মিহির কুমার রায় : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App