×

মুক্তচিন্তা

ফুটবলে দৈন্যদশা থাকবে আর কতকাল?

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০১৮, ০৭:৩৭ পিএম

এক সময় গ্রামের স্কুলগুলোর মাঠেও পালা করে ফুটবল খেলা হতো। শুকনো মৌসুমে আমন ধান ওঠার পর গ্রামের নাড়াক্ষেতে আকর্ষণীয় ফুটবল খেলা হতো নিয়মিত। প্রাথমিক থেকে উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে নিয়মিত প্রতিযোগিতা হতো। হতো থানা থেকে জেলা পর্যায়ের পর বিভাগীয়। সর্বশেষ জাতীয় পর্যায়ে। সেসব প্রতিযোগিতা আজ আর নেই। উদ্যোগের অভাবে জনপ্রিয় ফুটবল মনে আর মুখে আছে বাস্তবের মাঠে অনুপস্থিত। এটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে খেলোয়াড় তৈরির কারখানা।

ফুটবল মানেই উন্মাদনা, অন্যরকম শিহরণ জাগানিয়া কিছু। হয়তো ক্রিকেট এখন বেশি আলোড়ন তোলে মানুষের মনে, কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে, পরিপূর্ণ আবেগ, ক্ষুরধার মস্তিষ্কে মানুষ ফুটবলটাকেই বেশি উপভোগ করে। আজ যে আমরা খেলায় ‘বহুজাতিক’ আনন্দ দেখতে পাই, তার শুরুটাও কিন্তু ফুটবল দিয়ে।

বাংলাদেশেও সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। তবে মানুষ স্বভাবগত কারণেই সাফল্যের পূজারী। সাফল্য না পেলে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা যায় না। বাংলাদেশেও তাই হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে সার্কভুক্ত দেশগুলো নিয়ে সাফ গেমস শুরু হলে বাংলাদেশের ফুটবলে লক্ষ্য নির্ধারণ হয় সাফ স্বর্ণপদক। অর্জনযোগ্য লক্ষ্য। উপমহাদেশে সেরা ফুটবল শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিদ্ব›দ্বী মনে করা হয় কেবল ভারতকে। অথচ ভারতের অনুপস্থিতিতে প্রথম সাফ গেমসে নেপালের কাছে ফাইনালে হেরে যায় বাংলাদেশ। প্রথমবারই শুধু নয়, সাফ গেমস ফুটবলে ব্যর্থতা নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের জন্য। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। বিশ্বকাপ খেলার হাতছানি থাকায় গত শতাব্দীর নব্বই দশকের শুরুতে ফুটবলের জায়গা দখল করে নেয় ক্রিকেট। ফুটবলে দর্শকপ্রিয়তা কমতে থাকে।

আজ আমরা অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের ভক্ত কিংবা এসব দেশের পতাকা নিয়ে নিজের দেশের মাঠে প্রবেশ করি, আনন্দে উদ্বেলিত হই এসব খুব নিকটঅতীত। কিন্তু ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, হল্যান্ড কিংবা জার্মানি, স্পেনের ভক্ত হয়ে বাড়িতে বাড়িতে প্রিয় দলের পতাকা ওড়ানো, সারারাত জেগে খেলা দেখা, পরদিন আবার সেই খেলা নিয়ে তুমুল আড্ডায় মেতে ওঠা, এসব কোনো খেলায় আছে বলুন? হ্যাঁ, এসব শুধু ফুটবলেই সম্ভব। কাজী সালাউদ্দিন, এমেকা, জাকারিয়া পিন্টু, অমলেশ কিংবা সাব্বির, কায়সার হামিদ, প্রয়াত মোনেম মুন্না- এ নামগুলো বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে অবিস্মরণীয় নাম। যখনই বাংলাদেশের ফুটবলের প্রসঙ্গ উঠে কিংবা উঠবে তখনই এ নামগুলো ঘুরেফিরে আসবেই। কেননা স্বাধীনতা উত্তরকালে আমরা বাংলাদেশে যে ফুটবল জাগরণ দেখতে পাই তাতে এদের অবদান অসামান্য।

এইতো ক’দিন আগেও বাংলদেশের জনপ্রিয় খেলার কথা উঠলে ফুটবলের নাম ডাক শোনা যেত। আর এখন? কারো কারো মতে ফুটবল এখন ‘কোমায়’। মানতেই হবে এ অবনমন একদিনে হয়নি, ধীরে ধীরে হয়েছে। বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন ঘরোয়া ফুটবলের ম্যাচগুলোতে প্রচুর দর্শক সমাগম হতো আর আবাহনী মোহামেডামের ম্যাচ হলেতো কথাই নেই। এখন যেমন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সঙ্গে নিজ দেশে কোনো টেস্ট পেয়িং দেশের সঙ্গে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলে দর্শক উপচে পড়ে, খেলা শুরু হওয়ার ৪/৫ ঘণ্টা আগে থেকে টিকেট নিয়ে দর্শকরা অপেক্ষা করে থাকে, ঠিক তেমনি অবস্থা আমরা দেখেছিলাম বাংলাদেশের এককালীন ঘরোয়া ফুটবলে। আবাহনী-মোহামেডান খেলার দিন তো যার যার সমর্থক গোষ্ঠীর ব্যানারে দূরদূরান্ত থেকে ব্যানার নিয়ে স্টেডিয়ামে আসত দর্শকরা। যা এখন ভাবলে অবিশ্বাস্য মনে হবে।

এক সময় গ্রামের স্কুলগুলোর মাঠেও পালা করে ফুটবল খেলা হতো। শুকনো মৌসুমে আমন ধান ওঠার পর গ্রামের নাড়াক্ষেতে আকর্ষণীয় ফুটবল খেলা হতো নিয়মিত। প্রাথমিক থেকে উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে নিয়মিত প্রতিযোগিতা হতো। হতো থানা থেকে জেলা পর্যায়ের পর বিভাগীয়। সর্বশেষ জাতীয় পর্যায়ে। সেসব প্রতিযোগিতা আজ আর নেই। উদ্যোগের অভাবে জনপ্রিয় ফুটবল মনে আর মুখে আছে বাস্তবের মাঠে অনুপস্থিত। এটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে খেলোয়াড় তৈরির কারখানা।

ফুটবলের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বিশ্বকাপে সাড়া জাগানো শুধু নয়; ফুটবল বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়া রাশিয়া বিশ্বকাপের রানারআপ ক্রোয়েশিয়া এক সময় বাংলাদেশ জাতীয় দলের কাছে হেরেছিল। হেরেছিল জাপানও। আজকের বাস্তবতায় বিশ্বাস করা কঠিন যে আমাদের ছেলেদের কাছে ক্রোয়েশিয়া হেরেছিল।

মূলত ১৯৯৫ সালের পর ফুটবলে কুফা লাগে। যে কুফা আজো কাটেনি। আর ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল এগোবে না কেন, সে দেশের প্রেসিডেন্টের রাশিয়ার মাঠে সদর্প উপস্থিতি এবং নিজের পয়সায় বিমানের সাধারণ আসনে যাওয়া থেকে শুরু করে বৃষ্টিস্নাত মাঠে বিজয়-বিজিত সব খেলোয়াড়ের সঙ্গে একই রকম অভিন্ন আচরণ ফুটবলপ্রেমী বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে।

এক সময় রেংকিংয়ে আমাদের চেয়ে পেছনে থাকা ক্রোয়েশিয়া যদি বিশ্বকাপে রানারআপ হতে পারে, আইসল্যান্ড ও পানামার মতো কম জনগোষ্ঠীর মানুষ যদি বিশ্বকাপে যেতে পারে, আমরা ১৮ কোটি মানুষের দেশ কেন সেটা পারব না। কেন আমরা ১১ জন ফুটবলার তৈরি করতে পারব না। এত দৈন্য আর কতকাল?

আর বে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App