×

মুক্তচিন্তা

চালের দাম চড়া পেছনে ‘রাজনীতি’ নেই তো?

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০১৮, ০৭:৫০ পিএম

আমাদের দেশের নির্বাচনে চালের মূল্য সব সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। সেজন্য নির্বাচনের আগে কোনোভাবেই চালের বাজারে অস্থিরতা কাম্য নয়। চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার সবই করতে হবে। স্বল্প আয়, নির্দিষ্ট আয়ের ভোক্তাদের ওপর চালের দাম যাতে বাড়তি চাপ হয়ে না দেখা দেয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ওএমএসের মাধ্যমে শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষের কাছে কম দামে চাল ও আটা বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে।

কারণ ছাড়া নাকি কিছুই ঘটে না। বাজারে জিনিসপত্রের দাম ও অকারণ বাড়ার কথা নয়। চাহিদা বেশি হওয়া, উৎপাদন কম হওয়া অর্থাৎ ঘাটতি দেখা দিলেই সাধারণত কোনো জিনিসের দাম বাড়ে। আমাদের দেশে অবশ্য দাম বাড়ার কারণ লাগে না। ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভেও জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে থাকেন। ব্যবসায়ীরা সংগঠিত। তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। মানুষকে জিম্মি করতে পারেন। তারা তাদের মুনাফার কিছু অংশ এদিক ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি দলের নেতা-পাতি নেতাসহ অনেককেই নিজেদের অনুক‚লে রাখতে পারেন। কিন্তু যারা ক্রেতা, ভোক্তা, সাধারণ মানুষ তাদের অসংগঠিত, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই। তারা কাউকে জিম্মি করতে পারেন না। তাই অকারণ মূল্যবৃদ্ধির খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকেই।

দাম বাড়িয়ে মুনাফা করে একশ্রেণির ব্যবসায়ী আর বদনাম হয় সরকারের। ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর’- এর মতো আমাদের দেশে যাই কিছু হোক না কেন মানুষ সব কিছুর জন্য সরকারকেই দায়ী করে থাকে। তাই সাধারণ মানুষের কষ্ট হয়, দুর্ভোগ বাড়ে এমন কিছু যাতে দেশে না ঘটে সেটা দেখার দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়। বর্তমান সরকার নিজেদের জনকল্যাণকামী সরকার বলে দাবি করে থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রায় সব বক্তৃতায়ই বলে থাকেন যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশের মানুষ কিছু পায় আর অন্যরা ক্ষমতায় থেকে নিজেরাই খায়। তবে আওয়ামী লীগেও এখন ‘খাই’ পার্টি আছে। মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা সরকার ও দলের সব পর্যায়ে সবাই একভাবে ভাবেন বলে মনে হয় না। সবদিকেই প্রায় একক নজরদারি রাখতে হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই।

বর্তমান সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বেশি। কারণ সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। মানুষ ভোট দিয়ে যাদের ক্ষমতায় বসায় তাদের কাছে শুধু খবরদারি প্রত্যাশা করে না, নজরদারিও আশা করে। নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকারের একটি অন্যতম দায়িত্ব হওয়া উচিত। সরকার ব্যবসায়ী নয়, সরকার ব্যবসা করবে না, কিন্তু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা, তাদের নিয়মনীতির মধ্য দিয়ে চালানোর দায়িত্ব সরকারের। কারণ বাজারে আগুন লাগলে অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়লে মানুষের গায়ে সরাসরি আঁচ লাগে, আয়-ব্যয়ের মধ্যে সঙ্গতি রাখতে না পারলে মেজাজ তিরিক্ষি হয়। সব ক্ষোভ গিয়ে আছড়ে পড়ে সরকারের ওপর, সরকারের বিরুদ্ধে। অস্থিতিশীল বাজার সরকারকে অজনপ্রিয় করে তোলে। বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়লে তার প্রত্যক্ষ আঘাত লাগে সাধারণ মানুষের ওপর। ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। ফলে চালের দাম বাড়লে তার প্রতিক্রিয়া হয় ত্বরিত। সম্প্রতি হঠাৎ করেই চালের দাম কেজিপ্রতি দুই/তিন টাকা বেড়েছে। এ নিয়ে সংবাদপত্রে কিছু খবরও বেরিয়েছে।

উৎপাদন ভালো হয়েছে, পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে, তা সত্ত্বেও চালের দাম কেন বাড়ছে তার কোনো যুক্তিসঙ্গত জবাব কারো কাছে নেই। চাল ব্যবসায়ী এবং আমদানিকারকরা হয়তো বলবেন আমদানি শুল্ক শতকরা ২ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ২৮ ভাগ করায় চালের বাজারে তার বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয় এ কারণে যে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্ধিত শুল্ক পরিশোধ করে এখন পর্যন্ত কোনো চাল আমদানি করা হয়নি। ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভের আশায়ই যে চালের দাম বাড়িয়েছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এ ধরনের অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা ঠিক যে লাভের জন্যই ব্যবসা। কিন্তু খাদ্যপণ্যে অতি মুনাফা এক ধরনের অপরাধ। যা খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকে তাতে ভেজাল দেয়া যেমন মারাত্মক অপরাধ, তেমনি অকারণ দাম বাড়িয়ে মানুষের পকেট কেটে নেয়াও অপরাধ। এই অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনার ক্ষমতা একমাত্র সরকারেরই আছে। অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী এবং অসৎ রাজনীতিবিদদের সিন্ডিকেট গড়ে ওঠার কথা শোনা যায়। এরা পরস্পরের যোগসাজশে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়িয়ে নিজেরা লাভবান হয়, ক্ষতি হয় সরকারের।

আমাদের দেশে চালের চাহিদা বার্ষিক ৩ কোটি ১০ লাখ টন। গত বছর দেশে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত মোট চালের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৫৭ লাখ টন। বর্তমানে চালের সরকারি মজুদের পরিমাণ ১৩ লাখ ২১ হাজার টন। চালের বাজারে যাতে কোনো কৃত্রিম সংকট তৈরি না হয় সে জন্য গত বছর বিদেশ থেকে সাড়ে ৪২ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছে। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, এ বছর বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান উৎপাদন হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারেও চালের দাম এখন নিম্নমুখী। সামগ্রিক বিবেচনায় তাই চালের দাম বাড়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণই নেই।

আমরা জানি, আর মাত্র পাঁচ মাস পর দেশে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আগামী নির্বাচন বর্তমান সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার স্বার্থে শেখ হাসিনার সরকারকে পুনর্নির্বাচিত করার কথা বলা হচ্ছে। শেখ হাসিনা টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় আছেন। আরো এক মেয়াদ থাকতে চান। কাজটি সহজ নয়। আমাদের দেশের মানুষের একাংশের মধ্যে ক্ষমতার পরিবর্তন দেখার আগ্রহ প্রবল। তাছাড়া দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শক্তি নিজ নিজ ভূরাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় নানাভাবে আগামী নির্বাচনের আগে সক্রিয় হবে, বর্তমান সরকারকে চাপে রাখতে চাইবে, বিব্রত করতে চাইবে, যার কিছু কিছু লক্ষণ এর মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশের অভ্যন্তীরণ বিষয়ে বিদেশি দূতাবাসগুলো এবং তাদের কূটনীতিকরা নাক গলাতে শুরু করেছেন।

দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার জন্য নানা রকম উসকানি, অপচেষ্টা চলবে বলেই ধরে নেয়া যায়। সেজন্য সরকার এবং সরকার সংশ্লিষ্ট সব মহলকেই সতর্ক থাকতে হবে।

আমাদের দেশের নির্বাচনে চালের মূল্য সব সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। সেজন্য নির্বাচনের আগে কোনোভাবেই চালের বাজারে অস্থিরতা কাম্য নয়। চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার সবই করতে হবে। স্বল্প আয়, নির্দিষ্ট আয়ের ভোক্তাদের ওপর চালের দাম যাতে বাড়তি চাপ হয়ে না দেখা দেয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ওএমএসের মাধ্যমে শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষের কাছে কম দামে চাল ও আটা বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। খোলা বাজারে ওএমএসের মাধ্যমে প্রতি কেজি চাল ৩০ টাকা এবং প্রতি কেজি আটা ১৮ টাকা দরে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিক্রির ব্যবস্থা করা হলে বাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

চালের বাজার যেন কোনোভাবেই কোনো সিন্ডিকেটের হাতে চলে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। চাল আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী এবং চালকল মালিকদের মধ্যে সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করতে হবে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে। চালের বাজারে সরকার বা মন্ত্রণালয়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই- এমন ধারণা তৈরি হতে দেয়া যাবে না। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কেউ চালের বাজার চড়া করতে চাইলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্বাচনের আগে মানুষের কাছে কোনোভাবেই যেন এই বার্তা না যায় যে, সরকার তাদের সঙ্গে নেই। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনকে সহায়তার জন্য নাগরিক সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। কড়া নজরদারি ও পর্যবেক্ষণ থাকলে কোনো মহল পানি ঘোলা করার সুযোগ পাবে না। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের পাশে থাকতে হবে। কোনো দুর্নীতিবাজ মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর সহযোগী হিসেবে সরকারি দলের কাউকে দেখা গেলে তা আগামী নির্বাচনে দলের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে অনেক জায়গায় সাধারণ মানুষের দূরত্ব তৈরি হওয়ার অভিযোগ শোনা যায়। চাল নিয়ে মানুষের পক্ষ থেকে সে অভিযোগ খণ্ডানোর সুযোগ এসেছে। দেখা যাক, সুযোগের সদ্ব্যবহার করা হয় কিনা।

বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App