×

মুক্তচিন্তা

নারী শ্রমিকের হাহাকার থামবে কবে?

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০১৮, ০৭:৫৮ পিএম

কোনো রকমে যারা দেশে ফিরতে পারছে তাদের জন্য হয়েছে উভয় সংকট। নির্যাতনের শিকার নারী শ্রমিকগুলো দেশে ফিরেও শান্তিতে নেই। পরিবার তাদের ভালোভাবে ফিরিয়ে নিতে চাইছে না। অনেকের কপালে জুটে গেছে তালাক। বিদেশে যৌন নির্যাতনের শিকার, অত্যাচারিত হওয়ায় স্বামীর সংসারের, পিতার বাড়ির দরজা তার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছে। সমাজের মানুষগুলো অন্য চোখে দেখছে তাদের, যা সহ্য করা অসহনীয় হয়ে পড়ছে। কোথায় যাবে এই অসহায় মানুষগুলো!

সংসারে নিদারুণ কষ্ট আর অভাব না থাকলে কোনো মা-বাবা তার আদরের সন্তানকে, স্বামী তার স্ত্রীকে, সন্তান তার মাকে চায় না অন্যের বাড়িতে কাজ করতে দিতে কিংবা প্রবাসের অচেনা-অজানা স্থানে পাঠাতে। ভাতের কষ্ট, কাপড়ের কষ্ট, সাবানের কষ্ট, টাকার কষ্ট! সে কষ্টের কি আর শেষ আছে! ক্ষুদ্র ঋণ মানুষের সুখই শুধু কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছে বেঁচে থাকার অবলম্বন। দেশের নারী গৃহ শ্রমিককে আমরা আজো সম্মান ও সুরক্ষা দিতে পারিনি।

নারীর অসহায়ত্ব, অভাব, পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্যের মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, একটু সচ্ছলতার আশায় ভাগ্য বদলাতে দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি ও কর্মসংস্থানের আশায় নারীরা ঘরছাড়া হয়ে চুক্তি ও শ্রমের মূল্য অনুযায়ী মজুরি না পেয়ে উল্টো যৌন, শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। যারা বেতন যৎসামান্য দেয় তাও নির্ভর করে মালিকের সন্তুষ্টির ওপর। গৃহকর্তার স্ত্রী নিশ্চুপ। কেননা তার মনে সারাক্ষণ ভয় স্বামী নতুন করে বিয়ে করার চেয়ে যা করছে করুক। বিদেশে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে পাসপোর্ট, ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে নেয়া, চলাফেরায় স্বাধীনতা না থাকায় বন্দি জীবনযাপনে বাধ্য করা, প্রতি মাসে বেতন না দেয়া, পর্যাপ্ত খাবার, বিশ্রামের সুযোগ এবং উপযুক্ত আবাসন সুবিধা না দেয়া, দীর্ঘ সময় কাজ করতে বাধ্য করা, মানসিক, শারীরিক নির্যাতন করা, দেশে ফিরতে চাইলে পরিবারের সদস্যদের কাছে রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালদের মুক্তিপণ দাবি করা ইত্যাদি অন্তহীন সমস্যা জুটেছে আমাদের প্রবাসী নারী শ্রমিকদের কপালে। নির্যাতনের ধরন ও প্রকৃতি মধ্যযুগীয় বর্বতাকে হার মানিয়েছে।

উন্নত জীবন, আকর্ষণীয় বেতন-ভাতার লোভ দেখিয়ে বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়া হলেও তাদের মূলত যৌন দাসিবৃত্তিতে বাধ্য করা হচ্ছে। দালাল, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এবং ক্রেতা গৃহকর্তার খপ্পরে সর্বস্বান্ত হওয়া, নরক যন্ত্রণা সহ্য করা নারী শ্রমিকদের পাশে কে দাঁড়াবে আজ! এক দেশের কথা বলে অন্য দেশে নেয়া, এক কাজের কথা বলে, অন্য কাজ দেয়া- এগুলো নিত্যনৈমিত্তিক দৃশ্যপট। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দায়ী দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মানবিকতা বলতে কিছু নেই। আর্থিকভাবে লাভবান হওয়াটাই এদের মূলকথা। শারীরিক ও মানসিকভাবে নিগৃহীত পেশাগত দক্ষতাহীন প্রবাসী শ্রমিক মা-বোনরা জানে না ওই দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট, ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর কৌশল। জেনে-বুঝে ওঠার আগেই নেমে আসে নিদারুণ নির্যাতন ও হয়রানি।

ওমান, লেবানন, সিঙ্গাপুর, জর্ডান, মরিশাস, হংকং, সিরিয়া, দুবাই, আবুধাবিসহ সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যান্য এলাকা, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে মাত্র ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ করলেই ওরা বিশ্বাস করে গরিব দেশগুলো নারী শ্রমিক না পাঠিয়ে পারবে না। সিরিয়াতে শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ভারত, নেপাল, পাকিস্তান নারীদের সঙ্গে বাংলাদেশি নারীদের জোরপূর্বক যৌনকর্মী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মানুষ বলেই গণ্য করা হয় না নারী শ্রমিকদের। নির্যাতন ও যৌনতা ওদের কাছে অপরাধ বলে মনে হয় না। দাস সমাজের মতো বৈধ মনে করে তারা। আর তাই, এক রাতেই অসহায় এই নারীগুলোকে গৃহকর্তার স্ত্রী স্বামী, দেবরদের, পুত্র সন্তানদের হাত ও কক্ষ বদলে নিশ্চিত নিরাপত্তা দেয় যেন স্বামী অন্তত অন্য মেয়েকে বিয়ে না করে, সতীনের মুখ দেখতে না হয়, দেবর ও পুত্ররা বাইরে যৌনকর্ম করে গর্দান না যায়, সম্পত্তি ও সম্পদ যেন হাতছাড়া না হয় ইত্যাদি কারণে।

নানা ঘাত-প্রতিঘাত, প্রতিক‚লতা সহ্য করতে না পেরে যারা পালাতে সক্ষম হচ্ছে, তাদের কাছে আবার নেই বিমান ভাড়া দেয়ার মতো পর্যাপ্ত অর্থ। পালিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। তারা না জানে বা কাছে না আছে বাংলাদেশের দূতাবাসের ঠিকানা, না পারে ইংলিশ, আরবি বা ওই সব দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষায় লেখা রাস্তার সাইন বোর্ড পড়তে। কোনো রকমে যারা দেশে ফিরতে পারছে তাদের জন্য হয়েছে উভয় সংকট। নির্যাতনের শিকার নারী শ্রমিকগুলো দেশে ফিরেও শান্তিতে নেই। পরিবার তাদের ভালোভাবে ফিরিয়ে নিতে চায়ছে না। অনেকের কপালে জুটে গেছে তালাক। বিদেশে যৌন নির্যাতনের শিকার, অত্যাচারিত হওয়ায় স্বামীর সংসারের, পিতার বাড়ির দরজা তার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছে। সমাজের মানুষগুলো অন্য চোখে দেখছে তাদের, যা সহ্য করা অসহনীয় হয়ে পড়ছে। কোথায় যাবে এই অসহায় মানুষগুলো! আমরা তো আর গরিব দেশ নই। অত্যন্ত গভীরভাবে ভাবনার বিষয় হলো আমরা আমাদের মা-বোনকে নির্যাতনের জন্য আর কোনোদিন প্রবাসে পাঠাব কিনা! পুরুষের শ্রম বাজার পাওয়ার জন্য আমরা আমাদের দেশের নারীদের নির্যাতনের উপঢৌকন বানাব কিনা! রীতিমতো টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে নিশ্চয় তারা আদর যত্নে রাখবে না। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, নেপাল প্রতিবাদ জানিয়েছে। শ্রম বাজার হারানোর ভয় করেনি তারা। প্রবাসে নারী শ্রমিক প্রেরণ সংক্রান্ত বাংলাদেশ সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও লোভী, অসৎ ও অসাধু ট্রাভেল এজেন্সি এবং তাদের দালালদের মিথ্যা স্বপ্ন দেখানো সচ্ছল জীবন ও অনেক রোজগারের মিথ্যা প্রলোভনের কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে সব নীতিমালা না মেনে ঢালাওভাবে নারী শ্রমিকদের প্রবাসে পাচার করাই আজকের এই পরিণতি। তারপরও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে এরা। উচিত শিক্ষা না পেলে সরকারের ভাবমূর্তি যেমন একদিকে ক্ষু্ণ্ণ হচ্ছে, তেমনি কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হওয়ার কারণে দিন দিন অসাধু ট্রাভেল এজেন্সি ও তাদের দালালরা আরো বেপোরয়া হচ্ছে। কেউ যেন বলতে না পারে, নারী শ্রমিকদের বিদেশে অবস্থান কেমন তা নজরদারি করার জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের তেমন কোনো উদ্যোগই নেই। সরকারকে উপযুক্তভাবে ‘মনিটরিং’-এর ব্যবস্থা করতে হবে। বিচারের মুখোমুখি করতে হবে দায়ী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ও তাদের দালালদের। কোনোভাবে দায় এড়াতে পারে না এরা। বাংলাদেশের আদালতের পাশাপাশি, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) বিচারের মুখোমুখি করতে হবে গণধর্ষণকারী নরপিশাচদের। বিক্ষিপ্ত ঘটনা বলে উড়িয়ে দেয়ার মতো বিষয় না এটা।

পৃথিবীর আর কোথাও এমন নারীবান্ধব দেশ, সরকার আর দ্বিতীয়টি নেই বলে প্রবাসী নারী শ্রমিকদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে দেশের সহানুভ‚তিশীল, সংবেদনশীল ও মানবতাবাদী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সংসদের স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেত্রী, সংসদ উপনেতা, কৃষিমন্ত্রী, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, তথ্য প্রতিমন্ত্রী, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকারের ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ড, সেফহোম, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে বাংলাদেশের দূতাবাস, আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা (আইওএম), বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক এসোসিয়েশনসহ (বিওএমএসএ) সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিবর্তিত ভালো কিছু একটা হবে সেই প্রত্যাশা আমাদের হতেই পারে।

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান : শিক্ষক, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App