×

মুক্তচিন্তা

শিক্ষা ও সাক্ষরতা এক নয়

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০১৮, ০৭:৪২ পিএম

সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে। এর বেশিরভাগই সাম্প্রতিক কালের অর্জন। সরকারের কতগুলো ভালো পদক্ষেপ ও কৌশলের কারণে এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিস্টিকসের (ইউআইএস) তথ্য অনুসারে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ৭২.৭৬% সাক্ষরতা অর্জন করেছে। যা ২০০৭ সাল থেকে ২৬.১% বেশি যখন এটি ছিল ৪৬.৬৬%। ২০১৬ সালে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারী-পুরুষের সাক্ষরতার হার ছিল ৯২.২৪%, যা ২০০৭ সালে ৬১.৮৭% ছিল। অল্প সময়ে সাক্ষরতা হারের এই বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতার পেছনে এ সাফল্য একটি কারণ বলে বিবেচিত হয়েছে।

কিন্তু মানুষ কেন উদ্বিগ্ন যে শিক্ষার মান নিচে নেমে যাচ্ছে? একদিকে পরিসংখ্যান বলছে সাক্ষরতার হার দ্রুতগতিতে বাড়ছে, অন্যদিকে মানুষ পথে-ঘাটে-স্টেশনে বলাবলি করছে শিক্ষা শেষ হয়ে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সাক্ষরতা বৃদ্ধির হার শিক্ষা বৃদ্ধির হার তো বোঝায়ই না, বরং কখনো কখনো দুয়ের সম্পর্ক উল্টাও হতে পারে। পরিসংখ্যান মতে সাক্ষরতা ও মানুষের বিবেচনায় শিক্ষার বেলায় এই তফাত কেন, গলদটা কোথায়? এর কারণ শিক্ষা ও সাক্ষরতা সমার্থক ও কাছের মনে হলেও, তারা এক নয়, ভিন্ন।

চলতি কথাবার্তায় আমরা প্রায়ই শিক্ষা ও সাক্ষরতাকে এক করে ফেলি। সাক্ষরতার হারকে অনেকেই শিক্ষার হার বলেন। অনেকে সাক্ষর ব্যক্তির হারকে শিক্ষিতের হার ও নিরক্ষরের হারকে অশিক্ষিতের হার বলেন। কথাবার্তায় শিক্ষা ও সাক্ষরতায় এ রকম গুলিয়ে ফেলাটা হয়তো তেমন কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা হয় যদি এ দুটি বিষয়ের পার্থক্য সম্পর্কেও মানুষ সচেতন না থাকে। প্রকৃতপক্ষেই বেশিরভাগ মানুষ এ দুয়ের পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন নয়। আসলে শিক্ষা ও সাক্ষরতায় রয়েছে মৌলিক ব্যবধান।

মাতৃভাষার অক্ষরের সঙ্গে যার পরিচয় আছে অর্থাৎ যে পড়তে ও লিখতে পারে সেই সাক্ষর। সামান্য বাড়িয়ে বলা যায়, সাক্ষরতা হচ্ছে পড়তে, লিখতে ও গুনতে পারা। বিভিন্ন গণনায় সাক্ষরতার এই ন্যূনতম যোগ্যতা নিয়ে পার্থক্য আছে। তবে সাক্ষরতা মোটামুটি এরচেয়ে বেশি কিছু নয়। এ যোগ্যতা যার থাকে সে সাক্ষর। আর যার অক্ষরজ্ঞান নেই সে নিরক্ষর। সাক্ষর মানুষের মধ্যে সবার পড়ালেখা যে সমান হবে তা নয়, কারো কম আবার কারো অনেক অনেক ডিগ্রি থাকে। তবে পড়ালেখার দৌড়ে কেউ যতদূরই গিয়ে থাকুক না কেন, সবাই ওই সাক্ষরতার কাতারে বসবে। বাকি সবাই নিরক্ষরতার কাতারে।

সাক্ষরতা চিহ্নিত করা বা সাক্ষরতা ও নিরক্ষরতা বাছাই করা তাই বেশ সহজ। কিন্তু শিক্ষা ব্যাপারটা একটু জটিল। সাক্ষর লোকের কাতারে থাকা সবাই আসলে শিক্ষিত নাও হতে পারে, আবার শিক্ষিত মানুষ এর বাইরে মানে নিরক্ষর লোকের কাতারেও থাকতে পারে। থাকতে পারে কি, সব সময়ই থাকে। আবার সাক্ষরতা একমাত্র দক্ষতা নয়, যা একাই সমাজে বিরাট মর্যাদা লাভ করতে পারে। আরো অনেক যোগ্যতা আছে যেগুলো এর সমান বা এরচেয়ে বেশি মর্যাদা পেতে পারে।

সাক্ষর ব্যক্তির বাইরে অন্য সবাইকে অশিক্ষিত ভাবার ক্ষেত্রে বড় রকমের গলদ রয়েছে। যে নিরক্ষর কৃষক জীবনে কোনোদিন স্কুলের বারান্দায় যায়নি ও কোনো অক্ষর চেনে না, সে হয়তো তার কৃষি কাজে অনেক কৃষি-বিশেষজ্ঞের চেয়েও দক্ষ। মাঝি, রাঁধুনি, কুমার, কর্মকার ইত্যাদি হতে বিশেষ শিক্ষা ও শৈল্পিক বোধের দরকার যা সাধারণত পরিবার থেকে অর্জিত হয়। এ সব শিক্ষাকে হেলার বস্তু বা সাক্ষরতার চেয়ে কম দামি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। বরং সমাজের জন্য এ সব মূল্যবান ও অপরিহার্য। যদি কৃষক, মাঝি, রাঁধুনি, কুমার, কর্মকার প্রমুখ তাদের দায়িত্বটি দক্ষতার সঙ্গে ও যথাযথভাবে পালন করেন তবে তারা প্রত্যেকে নিঃসন্দেহে শিক্ষিত। আবার যদি কোনো সাক্ষর ও অনেক ডিগ্রিধারী কোনো ব্যক্তি তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করে, তাকে শিক্ষিত ভাবার কোনো কারণ নেই। দায়িত্বের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মাঝির দায়িত্ব তার নৌকার যাত্রীকে নিরাপদে নদীর অপর পাড়ে পৌঁছে দেয়া। যে কোনো পেশার লোকের এমন সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব আছে। শিক্ষিত হলে তাকে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে একটি নৈতিকতা সম্পর্কিত প্রশ্ন।

দেখা যাচ্ছে শিক্ষার সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক ওতপ্রোত। উল্লেখযোগ্য যে, কৃষক, মাঝি, কামার, কুমার প্রমুখ শ্রেণির মানুষের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সামাজিক মঙ্গলের উদ্দেশ্য বিদ্যমান। যাতে দায়িত্বশীলতা ও সমাজের কাছে জবাবদিহির প্রশ্ন জড়িত। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণি যে সব পেশায় জড়িত তা নগ্ন রকমে লাভ ও লোভ-কেন্দ্রিক। সামাজিক উচ্চ মর্যাদায় ভূষিত এ সব পেশায় দায়িত্বশীলতা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার, সুতরাং থাকা না থাকা সমান। এ সব আধুনিক লাভজনক বড় বড় পেশার লোকজন তাই পেশাটিকে কেবল নিজের স্বার্থ হাসিল ও অঢেল টাকা কামাইয়ের উপায় হিসেবে দেখে থাকে। এর ফলে দেখা দেয় নানা রকম অনৈতিকতা। এ শ্রেণির মানুষ যতই তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত মনে হোক না কেন, তারা প্রকৃতপক্ষে সাক্ষর মাত্র, মোটেও শিক্ষিত নয়।

অন্যদিকে যে সব মানুষ সামাজিক মঙ্গল সাধনে নিয়োজিত, যাদের নিজ স্বার্থের চরিতার্থতা কেবল অন্যের স্বার্থরক্ষার ও কল্যাণের সঙ্গে একই সুতোয় গাঁথা ও যারা যথাযথভাবে তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন, তারা নিরক্ষর হলেও শিক্ষিত, তারা নিঃসন্দেহে জ্ঞানী। নিরক্ষর মানুষ মাত্রই অশিক্ষিত নন। একইভাবে সাক্ষর ব্যক্তি মাত্র শিক্ষিত নন। নৈতিক জ্ঞান অর্থাৎ ভালো-মন্দের বিচারবোধ থাকা ও সে অনুসারে জীবনযাপন করা শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ। এ জন্য সাক্ষর-নিরক্ষরের ভাগকে শিক্ষিত-অশিক্ষিতের ভাগ হিসেবে গুলিয়ে ফেলা সমীচীন নয়।

আমাদের সাক্ষরতার বৃদ্ধির হার কেন শিক্ষার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে না, তার মূল কারণ সাক্ষরতা একটি দক্ষতা অর্জন মাত্র যার সঙ্গে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নটি কোনোমতে অতি কষ্টে ঝুলে আছে। অথচ শিক্ষার গোড়ার কথা এই নীতিনৈতিকতা ও সমাজের মানুষের কল্যাণে কর্মকাণ্ড। এ বিষয়ে ধারণাটি স্পষ্ট না থাকলে আমরা অন্ধকারেই ঘুরপাক খাব, সাক্ষরতার হার বাড়লেও শিক্ষার ছোঁয়া পাওয়া যাবে না। অথচ আমাদের এখন প্রকৃত শিক্ষা অনেক বেশি প্রয়োজন।

সাক্ষরতা ও শিক্ষার মধ্যে এই মৌলিক পার্থক্যটি স্পষ্ট থাকলে আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তায়ও তার প্রতিফলন দেখা দিবে যার ইতিবাচক প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই সমাজে পড়বে। সাক্ষরতার চেয়ে শিক্ষা অর্জন কঠিন, যা আমাদের এখন বেশি জরুরি। এখন প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ চাই।

আলমগীর খান : নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App