×

শিক্ষা

‘বাণিজ্য’ ফাঁদে আটকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০১৮, ০৪:২৫ পিএম

‘বাণিজ্য’ ফাঁদে আটকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন অক্ষুণœ রাখার ঠুনকো যুক্তি, শিক্ষকদের বাড়তি আয়ের লোভ আর কোচিং সেন্টারগুলোর কোটি কোটি টাকার বাণিজ্যের ফাঁদে আটকে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা কার্যক্রমের বাস্তবায়ন। গেল এক দশক ধরে শিক্ষাবিদদের পরামর্শ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) দফায় দফায় উদ্যোগের পরও তা চালু করা যায়নি। চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে এ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হচ্ছে না বলে নিশ্চিত করেছেন মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১৯ জুলাই) দেশের ১০ বোর্ডের ১৩ লাখ ১১ হাজার ৪৫৭ জন পরীক্ষার্থীর উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে স্নাতক প্রথমবর্ষে ভর্তির তারিখও নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ। আগামী অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনমাস ধরে চলবে এই কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির এই তারিখ ঘোষণার পরই লাখ লাখ পরীক্ষার্থী ও অভিভাবক আবারো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। কেননা, ভালোমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাক্সিক্ষত বিষয়ে ভর্তি হতে তাদের আবারো ছুটতে হবে ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’ পর্যন্ত। শিক্ষার্থীদের হয়রানির পাশাপাশি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পর্যায়ের অভিভাবকদের আবারো সামলাতে হবে বিপুল অর্থ খরচের ধাক্কা। মন্ত্রণালয় ও  ইউজিসির কর্মকর্তারা বলছেন, গুটিকয়েক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বাণিজ্যের ফাঁদে গত একদশক ধরে আটকে আছে বহুল আলোচিত সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বাস্তবায়ন। ভর্তিফরম বিক্রি, পরীক্ষা হলে দায়িত্বপালন, খাতা মূল্যায়নসহ নানাবিধ খাত থেকে কয়েক মাসেই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি সংক্রান্ত কমিটির আয় গিয়ে দাঁড়ায় কয়েক কোটি টাকা। মাত্র কয়েকদিনেই কর্তৃপক্ষসহ শিক্ষক এবং কর্মচারীদেরও কয়েকগুণ বাড়তি আয় হয়। ৬০০ আসনের শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এখানে প্রতি আসনের বিপরীতে ভর্তিযুদ্ধে নামেন ৬০ শিক্ষার্থী। এক হাজার টাকা হিসেবে ফরম বিক্রি থেকে তাদের আয় হয় সাড়ে তিন কোটির টাকার উপরে। এরপর ভর্তিকালীন বহুমুখী ফি বাবদ আয়ও কোটির অংক ছাড়িয়ে যায়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো খ্যাতিমান উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুধু ভর্তিফরম বিক্রি বাবদ আয় করে ৮-১০ কোটি টাকার বেশি। পাশাপাশি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোরও ফরম বিক্রি থেকে আয় হয় ৫-৭ কোটি টাকার কাছাকাছি। প্রচলিত ভর্তি পদ্ধতিতে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, কোচিং সেন্টারগুলোও হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। তবে পরীক্ষা পদ্ধতির বদল হলে কোচিং বাণিজ্য যেমন বন্ধ হয়ে যাবে তেমনি আসনপ্রতি প্রতিযোগীর সংখ্যাও আসবে কমে। সেইসঙ্গে অভিভাবকদের হয়রানি ও অর্থ খরচও কমে যাবে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক ভোগান্তি এবং অভিভাবকদের আর্থিক ক্ষতি লাঘব করতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে প্রথম আলোচনা শুরু হয় ২০০৭ সালে। এরপর ভর্তি প্রক্রিয়ার সংস্কার করতে ২০০৮ সালে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে (ভিসি) নিয়ে বৈঠক করেন তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। বৈঠকে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তির প্রস্তাবে অধিকাংশ ভিসিই একমত পোষণ করেন। তবে বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্বের আশঙ্কার কথাও বলেন। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে ভিসিদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বুয়েট) বেশ কয়েকটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এরপর পর্যায়ক্রমে ২০১০, ২০১১ এবং ২০১২ সালেও ভিসিদের নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ধারাবাহিক বৈঠকেও কোনো সফলতা আসেনি। ইউজিসির একটি সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের নভেম্বরে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য মো. আবদুল হামিদের কাছে ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন দেয়ার সময় রাষ্ট্রপতি শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার কথা বলেন। পরে ইউজিসি চেয়ারম্যান এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ভিসিদের নিয়ে ফের বৈঠকে বসেন শিক্ষামন্ত্রী। সেখানে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বিত পদ্ধতির পক্ষে সম্মতি দিলেও বৃহৎ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় বিরোধিতা করে বসে। সে সময় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) অভিন্ন পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণাও দেয়। তবে স্থানীয়দের বাধার কারণে শাবিপ্রবিতে সে উদ্যোগ ভেস্তে যায়। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইনের সভাপতিত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় সমন্বিত বা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা বাস্তবায়নে কার্যপত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ জন্য ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানকে প্রধান করে সাত সদস্যের একটি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদকে আহŸায়ক করে নয় সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়। দুই কমিটিকে সমন্বয় করে ভর্তি পরীক্ষার নীতিমালা তৈরির নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রয়োজনে ভিসিদের সঙ্গে পরামর্শ করারও নির্দেশনা দেয়া হয়। নীতিমালা সংক্রান্ত ধারণাপত্র শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়ার জন্য সেই দুটো কমিটিকে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। এরই মধ্যে ১ ফেব্রæয়ারি রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং ভর্তিচ্ছু, বিশেষ করে ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের ভর্তিকালীন দুর্ভোগ কমাতে সমন্বিত সহজ ভর্তি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার তাগিদ দেন রাষ্ট্রপতি। সমন্বিত বা গুচ্ছপদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা বাস্তবায়নে কার্যপত্র ও নীতিমালা তৈরির অগ্রগতি জানার জন্য দুই কমিটির প্রধান ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদকে গতকাল কয়েক দফায় ফোন দেয়া হলেও তারা ফোন ধরেননি।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা বাস্তবায়নে রাষ্ট্রপতি তাগিদ দিয়েছেন। সব পক্ষকে সমন্বিত করেই কার্যপত্র ও নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। যেহেতু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা রয়েছে তাই এখানে কারো অনাগ্রহ দেখানোর সুযোগ নেই। ইউজিসির অতিরিক্ত পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. কামাল হোসেন বলেন, চলতি বছরেই পাইলট প্রকল্প হিসেবে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হতে পারে। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যও এ কার্যক্রম দ্রæত বাস্তবায়ন করা হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App