×

মুক্তচিন্তা

তিন সিটিতে ভোটের হাওয়া

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০১৮, ০৮:০০ পিএম

খুলনা এবং গাজীপুরের পর সরকার এবং সরকারি দলের ওপর চাপ কমেছে। বরিশাল, সিলেট এবং রাজশাহী বিএনপির জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নির্বাচনে জেতার জন্য দলের ভেতরের ঐক্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। খুলনা এবং গাজীপুরে দলের ভেতরের অনৈক্য দূর করতে পারার সুফল আওয়ামী লীগ পেয়েছে। পরের তিন সিটিতেও আওয়ামী লীগের ভেতরে বড় সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে না।

বরিশাল, সিলেট এবং রাজশাহী সিটিতে এখন চলছে জমজমাট নির্বাচনী প্রচারণা। মেয়র এবং কাউন্সিলর পদের প্রার্থীরা নিজ নিজ প্রতীক নিয়ে প্রচারণায় নেমে পড়েছেন। চলছে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের পালা। নির্বাচনে মেয়র পদেও অনেক প্রার্থী। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অর্থাৎ নৌকা ও ধানের শীষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে সেটা আগাম বলে দেয়া যায়। মেয়র পদে দলীয় মনোনয়নে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন হলেও কাউন্সিলর পদে সেটা হচ্ছে না। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও এখন আর অরাজনৈতিক নেই। আগে প্রার্থীদের প্রতি রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছিল গোপনে, এখন তা প্রকাশ্য। ফলে সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়েও এখন রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও এখন স্থানীয় সমস্যার চেয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে রাজনৈতিক ইস্যু। এক বা একাধিক সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী জয়লাভ করলেও দেশে সরকার পরিবর্তন হবে না। কিংবা বিএনপি প্রার্থী মেয়র হলে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তির কোনো সম্ভাবনা তৈরি হবে না। তারপরও সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে বিএনপি জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যু, গণতন্ত্রের সমস্যা, খালেদা জিয়ার মুক্তি ইত্যাদি বিষয়গুলো সামনে এনেছে। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। খুলনা এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছে। আগামী ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও জয়ের ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আওয়ামী লীগ আশা করছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকরাও ভিন্ন কিছু ভাবছেন বলে মনে হচ্ছে না।

বিশেষ করে খুলনা এবং গাজীপুর সিটির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বিএনপি তার জনপ্রিয়তাকে ভোটে রূপান্তর করার ক্ষমতা হারিয়েছে। ওই দুই সিটির নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে বিএনপি যত অভিযোগই করুক না কেন, বাস্তব হচ্ছে আওয়ামী লীগ জিতেছে। এই জয় হয়েছে মানুষের ভোটেই। শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন না হলেও খুলনা এবং গাজীপুরে ‘দখলবাজি’র নির্বাচন হয়েছে বলে যারা মনে করেন তারা কিছুটা স্বপ্নলোকে বিচরণ করছেন। যারা কারচুপির অভিযোগ করছেন, তারা যে বিপুলসংখ্যক ভোটার কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়েছেন, তাদের প্রতি অবিচার করছেন। যারা দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন, তাদের অসম্মানিত করার অধিকার কারো নেই।

ভোটে যদি ব্যাপক অনিয়ম হতো তাহলে বিএনপির প্রার্থীর ভোট আরো কম হতো। ইসলামী আন্দোলন নামের একটি ধর্মভিত্তিক দলের প্রাপ্ত ভোট এত বেশি হতো না। নির্বাচনে বিএনপি না জেতার অনেক কারণ আছে। দলটি এখন অসংগঠিত। তাদের সমর্থক আছে। কিন্তু তারা বিএনপির জন্য জীবন দেয়ার মানসিক অবস্থায় নেই। এই বাস্তবতা বিবেচনায় না নেয়ায় বিএনপি এখন রাজনৈতিকভাবে হাবুডুবু খাচ্ছে। এমন একটি ভঙ্গুর দল নিয়ে যেমন আন্দোলন করা অসম্ভব, তেমনি নির্বাচনে জেতাও সম্ভব নয়। খুলনা এবং গাজীপুরের পর সরকার এবং সরকারি দলের ওপর চাপ কমেছে। বরিশাল, সিলেট এবং রাজশাহী বিএনপির জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

নির্বাচনে জেতার জন্য দলের ভেতরের ঐক্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। খুলনা এবং গাজীপুরে দলের ভেতরের অনৈক্য দূর করতে পারার সুফল আওয়ামী লীগ পেয়েছে। পরের তিন সিটিতেও আওয়ামী লীগের ভেতরে বড় সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে না। বরং যে সিটিতে যে প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে, তাকে জিতিয়ে আনার জন্য সবাইকে এক হয়ে কাজ করার নির্দেশনা কেন্দ্র থেকে কঠোরভাবেই দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিএনপি কোনো জায়গাতেই দলের ভেতরের সমস্যা সমাধান করতে পারছে না। কেন্দ্রে যেমন দলের নেতৃত্বে বিশ্বাসের সংকট আছে, দ্বন্দ্ব-বিরোধ আছে, তেমনি সিটি পর্যায়েও আছে।

বিএনপির দলীয় এবং জোটের অভ্যন্তরীণ সংকটের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সিলেটে। সিলেটে বিএনপি থেকে দলীয়ভাবে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে সদ্য বিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে। কিন্তু দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হয়েছেন মো. বদরুজ্জামান সেলিম। তিনি সিলেটের একজন প্রভাবশালী নেতা। বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে বশে আনা যায়নি। তাকে দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সেলিমের একটি সমর্থক গোষ্ঠী আছে, তিনি হয়তো জিততে পারবেন না, তবে আরিফুল হকের পথে কাঁটা বিছাতে পারবেন ঠিকই।

সিলেটে বিএনপির জন্য বেশি চাপ তৈরি করেছে জোট সঙ্গী জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতের সিলেট মহানগর আমির এহসানুল মাহবুব জুবায়ের মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছেন। সব সিটিতে বিএনপিকে সমর্থনের বিনিময়ে জামায়াত অন্তত একটি সিটিতে তাদের প্রার্থীর প্রতি বিএনপির সমর্থন আশা করেছিল এবং তাদের পছন্দের সিটি ছিল সিলেট। কিন্তু বিএনপি শেষ পর্যন্ত ছাড় না দেয়ায় জামায়াতও তাদের প্রার্থিতা বজায় রেখেছে। ঘরের মধ্যে এই অসন্তোষ বিএনপির জন্য বিপদ সংকেত হয়ে বাজতে শুরু করেছে। আর আওয়ামী লীগকে করেছে নির্ভার। সিলেটে বিএনপি এবং জোটের ভেতরে যে সংকট তা অন্য সিটিতেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।

বরিশালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। তিনি আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর ছেলে। বরিশালের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন হাসনাত আব্দুল্লাহ। তার পরিবাবের সদস্য প্রার্থী হওয়ায় ভোটের সমীকরণ বদলে গেছে বলে অনেকেই মনে করেন। সাদিক আব্দুল্লাহ নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি। তরুণদের মধ্যে তিনি জনপ্রিয়। কিছুদিন থেকে তিনি মেয়র হওয়ার লক্ষ্যে কাজও করছেন। বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে সিনিয়র নেতা মজিবর রহমান সরোয়ারকে। তিনি ঘর গোছাতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তার বিরুদ্ধ পক্ষ আছে। সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালের অবস্থান কি হবে সে প্রশ্ন আছে। সিলেটের বিরোধ জামায়াতকে যদি বরিশালেও বিএনপিবিমুখ করে তাহলে সেটা বিএনপির জন্য কাল হবে। বরিশালে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী ওবায়দুর রহমানও বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সাধারণত যে কোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট এক হয়ে যাওয়ায় বিএনপি একটি বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে। ইসলামী আন্দোলনের ভোট বিএনপির পাওয়ার কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, বাইরে খুব হৈচৈ না থাকলেও সিটি নির্বাচনগুলোতে ইসলামী আন্দোলন সম্মানজনক ভোট পাচ্ছে, বিশেষ করে বাম দলগুলোর তুলনায়। বরিশালে যদি জামায়াত নিষ্ক্রিয় থাকে এবং ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী ভালো ভোট পায় তাহলে তাতে সুবিধা হওয়ার কথা আওয়ামী লীগের। যারা নির্বাচনী অনিয়ম নিয়ে অতি তৎপর, তারা ভোটের রাজনীতির ভেতর-বাহির সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন কি?

রাজশাহী সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। বিএনপির প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। বুলবুল বিদায়ী মেয়র। আর লিটন ছিলেন তার আগে মেয়র। লিটনের সময় রাজশাহীতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছিল। বুলবুল মেয়র হওয়ায় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি। নগরবাসীর কাছে প্রার্থক্যটা স্পষ্ট। লিটনের দল ক্ষমতায়। পরের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগেরই ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা বেশি। বিএনপি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দিলে তাও বিএনপির ভোটে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সব মিলিয়ে আসন্ন তিন সিটি করপোরেশের নির্বাচনে ভোটের হাওয়া শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের অনুকূলে বলেই মনে হচ্ছে। তারপরও ৩০ জুলাই নির্ধারিত হবে কারা হবেন তিন সিটির নগর পিতা।

বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App