×

মুক্তচিন্তা

বিশ্বকাপ ফুটবল কেবলই উত্তেজনা নাকি প্রেরণাও?

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০১৮, ০৮:৪৮ পিএম

ক্রোয়েশিয়া দেশটি যুদ্ধবিধ্বস্ত, বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় সমান হলেও লোকসংখ্যা খুবই কম, মাত্র ৪৫ লাখ। সেই দেশের ফুটবল দল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলে বেড়াচ্ছে, এবার তো বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেরা দলের পরিচয় নিয়ে দেশে ফিরেছে। বেলাজিয়াম দল তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়ার যে ক’টি দেশের খেলা আমরা দেখেছি তাদের খেলা কী শুধুই উপভোগ করার জন্যই দেখা, নাকি এসব দেখে নিজেরাও ভালো খেলতে আগ্রহী হবো- সেই শিক্ষা নেয়া কী জরুরি না?

অবশেষে বিশ^কাপ ফুটবল শিরোপার লড়াই ২০১৮ শেষ হলো। দ্বিতীয়বার ফরাসিরা সোনার আকর্ষণীয় মহামূল্যবান পুরস্কারটি নিজেদের ঘরে তুলে নিলেন। ক্রোয়েটরা শিরোপা নিতে না পারলেও দুর্দান্ত খেলা দেখিয়ে বিশে^র কোটি কোটি দর্শকের হৃদয় জয় করিয়ে নিলেন। মস্কো বিশ^কাপ নানা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিল। অনেকের ধারণা তাই শেষ বিস্ময়টা হয়তো ক্রোয়াটরাই ঘটাবে। কিন্তু তা না ঘটলেও ক্রোয়েশিয়া মল্লযুদ্ধে বিজয়ী এক ফুটবল দলের জাতি রাষ্ট্র হিসেবে মস্কো থেকে সুনাম বয়ে নিয়ে গেছে এ কথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবে। ফরাসি দল নিঃসন্দেহে সেরা খেলা খেলেই মানুষের ভালোবাসা কুড়িয়েছে। তারা যে শীর্ষ প্রতিযোগিতায় আসার লড়াইতে থাকবে তা মস্কো বিশ্বকাপ শুরু থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু ক্রোয়েটদের কথা এতখানি ভাবতে পারেনি দর্শকরা শুরুতে। কিন্তু যত খেলার মাঠে ক্রোয়েটদের খেলার নৈপুণ্য দেখেছে দর্শকরা, যত এক একটি নামিদামি দলকে এ দলটি হারিয়ে উপরে উঠে আসছিল তত বেশি ইউরোপের যুদ্ধপীড়িত ছোট দেশ, ছোট জাতি ক্রোয়েটদের প্রতি বিশ্বের মানুষ আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। সে কারণেই শিরোপা জেতার শেষ লড়াইয়ে ফ্রান্সের খেলার সমঝদার হওয়া সত্ত্বেও অনেক দর্শকই ক্রোয়েটদের হাতে শিরোপার সোনার পুরস্কারটি দেখতে আগ্রহী ছিল। মস্কো বিশ্বকাপ তাতে নতুন বিস্ময়ের ইতিহাস সৃষ্টির অপর নাম হয়ে হয়তো দীর্ঘদিন আলোচিত হয়ে থাকতো। তারপরও মস্কো বিশ্বকাপ এ যাবৎ অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা বিশ্বকাপ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

গত ১৪ জুন থেকে গত পরশু ১৫ জুলাই টানা এক মাস এই বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিল। মিডিয়ার কল্যাণে ঘরে বসে পৃথিবীর ফুটবল প্রেমীরা ৩২টি প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে অনুষ্ঠিত সবক’টি খেলাই উপভোগ করতে পেরেছেন। একই সঙ্গে মস্কো বিশ্বকাপের আয়োজন বিশালতার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। যে রাশিয়া অনেকের কাছেই তেমন চেনা জানা দেশ ছিল না, সেই রাশিয়াকে তাদের দেখার অপার সুযোগ ঘটেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন এই বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসেবে নিজের দেশকে বিশ্বব্যাপী যেভাবে ব্র্যান্ডিং করার চিন্তা ও পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন তা বোধহয় পুরোপুরি সফল হয়েছে। রাশিয়া এই বিশ্বকাপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক বেশি দৃষ্টি আকর্ষণের জায়গায় চলে আসতে পেরেছে। রাশিয়া অনেকেরই আগ্রহ এবং কৌত‚হলের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। বিশ্বকাপ উপলক্ষে কয়েক লাখ দর্শক মস্কোয় এসেছিল। তাদের কাছ থেকে শুনে এখন লাখ লাখ পর্যটক রাশিয়া সফর করতে বের হবে। রাশিয়া সেভাবেই হয়তো নিজের দুয়ার খুলে দেবে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সোভিয়েত বিমান এরোফ্লত ঢাকা-মস্কো রুটে সপ্তাহে দুদিন যাতায়াত করত। পরে বন্ধ হয়ে গেছে। এখন যদি নতুন করে ঢাকা-মস্কো সার্ভিস চালু হয় তাহলে বাংলাদেশ থেকেও হাজার হাজার পর্যটক মস্কো সফর করতে পারে, রাশিয়ার ঐতিহাসিক স্থানসমূহ ঘুরে দেখতে পারে।

এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। বিশ্বকাপ শুরুর আগ থেকেই বাংলাদেশে সর্বস্তরের দর্শকদের মধ্যে ফুটবল খেলা দেখার জন্য সাজ সাজ রব পড়ে যায়। বিভিন্ন টিভি স্মার্ট ব্যবসায়ীরা নানা আকর্ষণীয় মূল্যে নানা মানের টিভি বিক্রির বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে, বিক্রিও হয়েছে প্রচুর। বেশ ভালোই অর্থ কামিয়েছে বিভিন্ন কোম্পানি। আমাদের দেশে বেশির ভাগ দর্শকই ব্র্রাজিল, আর্জেন্টিনার সমর্থক ছিল। এ নিয়ে বেশ উত্তেজনাও দেখা গেছে। কেউ কেউ বাড়িঘরে ব্রাজিলের জাতীয় পতাকার রং করে অন্যদের দৃষ্টি কাড়ার চেষ্টা করেছেন। পথেঘাটেই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকা ও দলের জার্সির জামা-গেঞ্জি পরে বেড়িয়েছেন, বাড়ি বাড়ি এ দুটো দেশের পতাকা উড়িয়ে তাদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের এমন ‘ভালোবাসা’ দেখতে সেই সব দেশের দূতাবাস থেকে অনেকেই ছুটে গেছেন, সাংবাদিকদেরও কেউ কেউ বাংলাদেশে দৃশ্য ধারণ করতে এসেছেন। বাংলাদেশে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা দলের ফুটবল সমর্থকের সংখ্যা বেশি এটি ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছি না। তবে ওই সব দেশের পতাকা ওড়ানোর অতিউৎসাহ খুব একটা যৌক্তিক বলে মনে হয় না। অথচ ভিনদেশি পতাকা কিনে, বাড়ি বাড়ি উড়িয়ে যারা এতখানি তাদের ভালোবাসা ওই দুটো দেশের প্রতি দেখান তাদের কতজন নিজ দেশের পতাকা কিনে এভাবে বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে বাড়ি বাড়ি ওড়ান তা একটি বড় ধরনের প্রশ্ন আকারে উত্থাপিত হতে পারে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ভিন দেশের পতাকা উড়িয়ে এ সব সমর্থক সাজা বা ভালোবাসা প্রকাশ করার নজির খুব একটা নেই। ওই সব দলের জার্সির প্রতি আকর্ষণ দেখানো যেতে পারে, কিন্তু পতাকা উড়িয়ে ফ্যান সাজার দৃশ্য মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ বাংলাদেশে এমন দৃশ্য আমাদের দেখতে হচ্ছে। কোনো বিদেশি ফুটবল, ক্রিকেট বা অন্য কোনো খেলার মুগ্ধ দর্শক হতে কোনো আপত্তি নেই, দোষেরও কিছু নেই। কিন্তু ক্রীড়ার সমঝদার হওয়ার মানে কিন্তু অন্য দেশের জাতীয় পতাকা নিজের দেশে ব্যবসা করার সুযোগ করে দেয়া, একই সঙ্গে ভূখণ্ডে উত্তোলন করা মোটেও এক কথা নয়, শোভনীয়ও নয়। আমার দেশের মাটিতে আমার দেশের পতাকাই প্রতিষ্ঠান কিংবা বাড়ি ঘরে বিশেষ বিশেষ দিবসে শোভা পেতে পারে, অন্য দেশের নয় কিছুতেই। এটি সেই দেশের মাটি নয়। অথচ আমাদের দেশে যা ঘটতে দেখি তা আমাকে হতবাক করে, বিস্মিত করে, দুঃখও দেয়। আমাদের জাতীয় পতাকার প্রতি যদি এমন আকর্ষণ দেখা যেত- তাহলে বোঝা যেত আমরা দেশের প্রতি কতটা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে পারি।

আমার মনে হয়, আমরা অনেক কিছুরই নিয়ম-কানুন না জেনে ভক্ত সাজার চেষ্টা করি। ফুটবল বিশ্বকাপের খেলা দেখার প্রতি উৎসাহী বা আগ্রহী হওয়া খুবই ইতিবাচক। কেননা, ফুটবল অত্যন্ত উচ্চমানের খেলা যা আমাদের নানাভাবে আনন্দ দিতে পারে, বিনোদনের শান্তি ও মজা দিতে পারে। আমরা বিশ্বকাপ খেলার প্রতিযোগিতা উপভোগকালে খেলার নান্দনিক দিকগুলো দেখে পুলকিত হয়েছি, উত্তেজিত হয়েছি, উপভোগ করেছি। যে কোনো খেলার মূল আকর্ষণ তো সেখানেই বিশেষভাবে নিহিত রয়েছে। বিরাট সংখ্যক দর্শক তাই করে থাকেন, এবারো করেছেন, রাত জেগে তারা দল বেঁধে খেলা দেখেছেন, উপভোগ করেছেন, কোনো না কোনো দলের সমর্থক হয়ে সেই দলের সাফল্য কামনা করেছেন। তবে বাড়াবাড়ির বিষয়ও অনেক ঘটেছে। দুঃখজনক ও তিক্ত অভিজ্ঞতাও অনেক ঘটেছে। অথচ আমাদের দেশের কোনো ফুটবল দলের জন্য এমন দুঃখজনক ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশের ফুটবল সেই মানে ওঠার কোনো সম্ভাবনা আমরা দেখছি না। অথচ বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা বিদেশি দলের এমন অন্ধ সমর্থক ও ভক্ত হন- সেটি বেশ বিস্ময়কর। ক্রোয়েশিয়া দেশটি যুদ্ধবিধ্বস্ত, বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় সমান হলেও লোকসংখ্যা খুবই কম, মাত্র ৪৫ লাখ। সেই দেশের ফুটবল দল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলে বেড়াচ্ছে, এবার তো বিশ^কাপের দ্বিতীয় সেরা দলের পরিচয় নিয়ে দেশে ফিরেছে। বেলাজিয়াম দল তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়ার যে ক’টি দেশের খেলা আমরা দেখেছি তাদের খেলা কী শুধুই উপভোগ করার জন্যই দেখা, নাকি এসব দেখে নিজেরাও ভালো খেলতে আগ্রহী হবো- সেই শিক্ষা নেয়া কী জরুরি না? যে সব দলের খেলা আমরা দেখেছি তাদের নিরন্তর চর্চা, ভালো করার জন্য প্রাণপণ লড়াই করার দৃশ্য আমাদের তো উদ্বুদ্ধ করার কথা। যে ৩২টি টিম মস্কোয় এবার খেলেছে, তাতে প্রত্যেকের খেলাই মানের বিচারে বেশ উচ্চতায় ছিল। এই মান একদিনে অর্জিত হয়নি, আকাশ থেকেও অবতীর্ণ হয়নি। সাধনা, কেবলমাত্র সাধনা দ্বারাই এমন খেলোয়াড় হওয়া যায়।

আমরা যদি কেবলই সমর্থক হয়ে নানা উত্তেজনার প্রকাশ ঘটানোর মধ্যে বসে থাকি, তাহলে আমরা কোনো দিনই খেলোয়াড় তৈরি করতে পারব না, একটা ভালো টিম নিয়ে দেশের দর্শকদেরও পরিতৃপ্ত করার কথা ভাবতে পারব না, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাওয়ার কথা ভাবা তো দূরের কথা। এমন অন্ধ বা উন্মাদ সমর্থকগোষ্ঠীর বোধ ও বিশ্বাস থেকে সফল ফুটবল দল গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা থাকে না। অথচ আমাদের দেশে অসংখ্য শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণী রয়েছে যারা খেলার মাঠ প্রকৃত আয়োজন এবং সংগঠক পেলে নিজেরাও ভালো খেলোয়াড় হতে পারে, বিশ্বমানের খেলা থেকে প্রতিনিয়ত জ্ঞান আহরণ করে এরাও নিজ দেশকে বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের পরিচয়ে নেতৃত্ব দিতে পারে, পরিচিতি এনে দিতে পারে। এখন মূল সংকট হচ্ছে, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাঠ নেই, খেলাও নেই। এক সময় গ্রামগঞ্জে ফুটবল খেলার প্রতিযোগিতা হতো। এখন সে সব বন্ধ হয়ে গেছে। খেলার পরিবেশই নষ্ট হয়ে গেছে। নানা স্থানীয় অপশক্তির দাপটে সব কিছুই তছনছ হয়ে গেছে। দলাদলি, জোরজবরদস্তি সর্বত্র নির্বিঘ্নে প্রদর্শন করে পার পাওয়া যায়। ফলে গ্রামগঞ্জে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বলতে গেলে নিষিদ্ধই হয়ে গেছে। ফলে অসংখ্য তরুণ সফল মানুষ হয়ে ওঠার সাধনা ও চর্চা থেকে দূরে সরে গেছে, এদের বেশির ভাগই এখন বখাটে বা এলাকার সন্ত্রাসী হয়ে উঠছে। যদি এসব তরুণ খেলাধুলাই ব্যস্ত থাকার সুযোগ ও পরিবেশ পেত তাহলে এদের মধ্য থেকেই আমরা অনেক দক্ষ, সৃজনশীল খেলোয়াড় বের হয়ে আসার বাস্তবতা দেখতে পেতাম। শহরগুলোতে এখন আর ক্রীড়াচর্চা সেভাবে হচ্ছে না। অথচ ক্রীড়ার সমর্থক, ফ্যান তো কম দেখছি না, বাংলাদেশের সমর্থকদের, ফ্যানদের আবেগ, উচ্ছ্বাস কতটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেছে সেটিতো স্বীকার করতেই হবে। প্রয়োজন হচ্ছে, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর খেলাধুলা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষাগুলো নেয়া, সেগুলোর প্রয়োগ ঘটানো, তরুণ প্রজন্মকে লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চিন্তায় গড়ে তোলা, বেড়ে উঠতে সুযোগ করে দেয়া। তাহলেই আমাদের জাতি গঠন সফল হতে পারে, বাংলাদেশ উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হতে পারে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App