×

মুক্তচিন্তা

কোটা আন্দোলন ও ছাত্রলীগের ভূমিকা

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০১৮, ০৮:৪০ পিএম

কোটা সংস্কারের আন্দোলনে মানুষের আবেগে নাড়া দিতে শুধু শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। অথচ বিষয়টা শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা নয়। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বাধীনতার চেতনায় অবিশ্বাসী গ্রুপ মুক্তিযোদ্ধা কোটাটাকে সামনে নিয়ে এসে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে বিতর্কিত করে তুলছে। এ ব্যাপারটা সতর্কতার সঙ্গেই মোকাবেলা করতে হবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের।

দেশে কোটাবিরোধী আন্দোলন এ সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় আন্দোলন হিসেবেই মনে করা হচ্ছে। কিন্তু আদৌ কি তাই। আন্দোলন করতে হলে মিছিল দিতেই হয়। বিরোধিতা দেখাতেই হয়। জনসাধারণের সামনে নিজস্ব দাবি-দাওয়া তুলে ধরতে হয়। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশেই এ ধারাটা আছে। ব্রিটেনে মাত্র এই সপ্তাহে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ডোনাল্ড ট্রাম্প। যেদিন রানীর সঙ্গে তার দেখা হয়, সেদিন সারা লন্ডন শহর যেন প্রতিবাদের নগরী হয়ে উঠেছিল। লাখ লাখ মানুষ সংগঠিতভাবে প্রতিবাদ দেখিয়েছে। বিশ্বের অন্যতম প্রধান ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়ক ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্রিটেন ভ্রমণকে এ দেশের বিপুলসংখ্যক নাগরিক মেনে নিতে পারেনি। তাই সরকারের একগুঁয়েমির প্রতিবাদ করেছে, দেখিয়েছে ট্রাম্পের প্রতি ঘৃণা। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পুলিশি নির্যাতন হয়নি, বিরোধীদলীয় নেতা জেরেমি করবিন পর্যন্ত বক্তৃতা দিয়ে গেছেন। এমনকি ব্রিটেনের ব্রেক্সিট নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলাকালীন দেশটির সংকটময় সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক আরো দৃঢ় করতে প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে’র একগুঁয়েমিকে থোড়াই কেয়ার করে লন্ডন-ম্যানচেস্টারসহ সারা ব্রিটেনে লাখ লাখ মানুষ জমায়েত হয়েছে। ট্রাম্পের ব্যক্তিজীবনের অসংখ্য অসঙ্গতি তুলে ধরা হয়েছে এ সব প্রতিবাদে। তুলে ধরা হয়েছে অভিবাসীদের প্রতি, মুসলমানদের প্রতি তার নিপীড়নমূলক আচরণের প্রতিবাদ। এত গুরুত্বপূর্ণ অতিথি, যার নিরাপত্তা দিতে ৫ মিলিয়ন পাউন্ড রাষ্ট্রের গচ্চা গেছে, অথচ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই লাখ লাখ মানুষের আবেগ কিংবা প্রতিবাদকে গ্রহণ করছে রাষ্ট্র। ব্যঙ্গ করে বেবি ট্রাম্পের ব্লিম্প (ফানুশ) বানিয়ে আকাশে উড়িয়ে দিয়েছে মানুষ। ট্রাম্পের পাশাপাশি মে’র কার্টুনও তৈরি করেছে বিভিন্ন গণমাধ্যম। কোনো আইনেই এ সব প্রতিবাদের কারণে জুলুম সইতে হয়নি কাউকে গোটা দেশটাতে। পিকেটিংয়ে ছিল না কোনো পুলিশি বাধা। গণতন্ত্রের চিত্র তো এটাই।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসতেই পারে কোটা সংস্কার আন্দোলন কি বিএনপি কিংবা জামায়াতের কোনো আন্দোলন? উত্তরটা একবাক্যে দেয়া যায়। এটা তাদের নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটাকে প্রথমে এভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালালেও কোনো নাগরিকই এটাকে সে চোখে দেখেনি। যেহেতু এটা আপামর ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন, সে হিসেবে এতে যেমন বামপন্থি ছাত্ররা আছে, ঠিক তেমনি আমরা দেখছি ছাত্রলীগের সমর্থক সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাও আছে। এতে বিএনপি কিংবা জামায়াত সমর্থিত ছাত্রছাত্রীরা যে নেই কিংবা থাকতে পারে না সে কথাটা তো আমরা বলতে পারি না। কারণ এটা ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন। বলতেই হয় এ আন্দোলন বাংলাদেশের একটা ঝাঁকুনি দিয়েছিল, সে জন্যেই প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগী হয়েই ঘোষণা দিয়েছিলেন, কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে দিয়েছিলেন কোটা তিনি বিলুপ্ত করবেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি চেয়েছিলেন এবং সেজন্য কোটা পদ্ধতিই বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন, কিন্তু হাইকোর্টের রায়ের কারণে এগুনো যাচ্ছে না। কোটা সংস্কারের আন্দোলনে মানুষের আবেগে নাড়া দিতে শুধু শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। অথচ বিষয়টা শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা নয়। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বাধীনতার চেতনায় অবিশ্বাসী গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধ কোটাটাকে সামনে নিয়ে এসে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে বিতর্কিত করে তুলছে। এ ব্যাপারটা সতর্কতার সঙ্গেই মোকাবেলা করতে হবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের।

ছাত্রদের ৩৮ টাকার খাবার আর ১৫ টাকার বাসস্থানকে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে তার নিজের দ্বারা সৃষ্ট হিসেবে ঘোষণা করেছেন, তাতে মনে হচ্ছে এ রাষ্ট্র জনগণের ট্যাক্সে চলে না, চলে না লাখো-কোটি কৃষক-শ্রমিকের লাঙল আর সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শ্রম সংশ্লিষ্ট অর্জিত হাজার হাজার কোটি টাকার ট্যাক্সে কিংবা প্রবাস থেকে প্রতি মাসে শত শত কোটি টাকা রেমিটেন্স প্রভৃতির কারণে। ঘোষণায় মনে হয়, এটা তার ব্যক্তিগত অনুদান কিংবা তাদের কয়েকজনের অর্থেই তৈরি হচ্ছে এসব ফান্ড। তাদের তৈরি করা এ ফান্ড দিয়েই কৃষকের ছেলেমেয়েদের তারা করুণা করছেন। তা ছাড়া তিনি যেভাবে বলেছেন, এ আন্দোলনে যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের মুক্তি দেয়া হবে না। এখানেও কি প্রধানমন্ত্রী তার আইনের জায়গার বাইরে গিয়ে কিছু বললেন না? কারণ তারাই তো আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেন, আইন প্রধানমন্ত্রী কিংবা সরকারের কথায় চলে না। তাহলে কি তিনি তার কথা দিয়েই বুঝিয়ে দিলেন না, আইন তাদের কথারই প্রতিধ্বনি করে!

কোটা আন্দোলনেই অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। অহেতুক সাত লাখ টাকার ব্যাংক হিসাব নিয়ে কথা উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা প্রশ্ন করতে পারি, ঢাকায় একটা জনসভার আয়োজন করতে কত টাকা লাগে? আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে যাদের মোটামুটি সংযোগ আছে, তারা জানে ক্ষমতার বলয় আঁকড়ে ধরা কিংবা সাবেক ক্ষমতাসীনদের বিশাল বিশাল জনসভার ব্যয় হয় কত কোটি টাকা। আমার এলাকার অর্থাৎ একটা উপজেলায় একটা দলের একটা মাত্র ইফতার মাহফিলে খরচ হয়েছে কয়েক লাখ টাকা গত রমজান মাসে। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হওয়া লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর কোটা সংস্কারের আন্দোলন দেশব্যাপী চলমান রাখতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দেয়া ১শ, ২শ, ১ হাজার টাকা মিলে সাত লাখ টাকার ব্যাংক লেনদেনের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড লাগে?

মজার ব্যাপার হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি গন্ধ পেয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে জঙ্গি প্রচারণার। তিনি বলেছেন, জঙ্গিরা যেভাবে ভিডিও বার্তায় তাদের বার্তা পৌঁছায়, সেভাবেই তিনি দেখেছেন ছাত্রদের ডিজিটাল বার্তাগুলো। আধুনিক যুগের এরকম আহ্বান শুধুই কি জঙ্গিদের? জঙ্গিরাও এটাকে হয়তো ব্যবহার করেছে। সেজন্য কি ডিজিটাল পৃথিবীর সঙ্গে চলতে পারবে না বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। তিনি বলেছেন, আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গনের আহ্বান আছে, এখানেই তিনি জঙ্গিত্বের গন্ধ শুঁকেছেন। ভিসি-প্রক্টররা যখন কোটা আন্দোলন দেখেন, তখন তারা জঙ্গি দেখেন। তারা দেখেন না ছাত্রলীগ, শুধু দেখেন না তার ছাত্রীদের নিগ্রহ, দেখেন না তারা হাতুড়ি পেটার লোম খাড়া হওয়া ভাইরাল হওয়া ছবিগুলো।

ছাত্রলীগের ওপর স্ট্যাটাস দিচ্ছে হাজারো মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এগুলো মানুষের মতামত। যেমন বিএনপি-জামায়াত-কমিউনিস্ট প্রভৃতি পার্টির ওপরও বিভিন্নভাবে তীর্যক মন্তব্য করা হচ্ছে, করছে সেই একইভাবে হাজার হাজার লীগ সমর্থিত নেতাকর্মীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমতো নিজস্ব মতামত রাখার জায়গা, অন্য অর্থে এক ধরনের ক্যাম্পেইন।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App