×

মুক্তচিন্তা

সবা প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি ও হয়রানি শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয় কি?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০১৮, ০৭:২৭ পিএম

পুলিশ, আইনজীবী ও চিকিৎসক হলেন মানুষের পরম ভরসার জায়গা। এই পেশাজীবীর ধর্মঘট বা কর্মবিরতিতে শত শত মানুষ যেমন অসহায় হয়ে পড়েন, তার দ্বিগুণ অসহায় হয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ এই পেশাজীবীর হয়রানির মানসিকতার সংস্কৃতিতে। ব্যতিক্রম ঘটনা বা চিত্র অবশ্যই আছে। আদর্শবান, মানবতাবাদী চিকিৎসক, পুলিশ ও আইনজীবী আছেন আমাদের দেশে। তারা অনেকটাই নিভৃতচারী। নীরবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সম্ভবত সে কারণে এ দেশের মানুষ বেঁচে থাকার কথা ভাবে, নিরাপদ থাকার স্বপ্ন দেখে। আর এই ভাবনা ও স্বপ্নকে সুদূরপ্রসারী করার জন্য সব সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিমুক্ত করা জরুরি।

বাংলাদেশে ধর্মঘটের কারণে যে দুটি সেক্টর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অতীতে এবং আজো হচ্ছে, তা হলো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা। শিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্র ও শিক্ষকদের ধর্মঘটের কারণে একটা সময়ে সেশনজট ছিল মারাত্মক। যথাসময়ে শিক্ষাপর্ব সমাপ্ত করা সম্ভব হয়ে উঠতো না। আর্থিক অসচ্ছল পরিবারের সন্তানদের জন্য এ যেন কঠিন ভাগ্য পরীক্ষা। পরিবারগুলো চেয়ে থাকে, কবে সন্তান লেখাপড়া শেষ করে সংসারের হাল ধরবে সেই আশায়। শিক্ষাব্যবস্থার অনেক দুর্বলতা রয়েছে জাতীয় পর্যায়ে। শিক্ষকদের ন্যায্য মর্যাদা, সুবিধা, পদোন্নতি ইত্যাদি বিষয়ে দীর্ঘদিনের দাবি, দাবি না পূরণ হওয়ার আন্দোলন, পাঠ্যপুস্তকের গুণগত মান রক্ষা না হওয়া, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফিস আদায়, ভ্যাট আদায়ের অসন্তোষ, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় দুর্নীতি, বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, কতিপয় শিক্ষকদের অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাবাণিজ্য এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেপরোয়া স্বেচ্ছাচারিতা, নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের সেই ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সখ্যভাব ইত্যাদি কারণগুলো শিক্ষার গুণগতমান রক্ষা করছে না, শিক্ষার পথকে নিষ্কণ্টক করছে না। শিক্ষার মতন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চরম অবহেলার শিকার হচ্ছে বছরের পর বছর। দুঃখজনক যে, জিপিএ-৫ এর ফিতা দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন পরিমাপ করা হয় কখনো-সখনো। এ ক্ষেত্রে সুচিন্তার অভাব, অবহেলা, উদাসীনতা প্রকট। কেন যে উপযুক্ত ব্যক্তি দ্বারা এই ব্যবস্থাকে কার্যকর করে রাখার কথা সরকার ভাবছে না, ভাবার আগ্রহ বোধ করছে না, ভেবে হতাশ হই। হতাশ চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়েও।

স্বাস্থ্য বা চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে জনসাধারণের রয়েছে অনেক ধরনের মিশ্র অভিজ্ঞতা। সরকার গ্রামগঞ্জে এই সেবাকে পৌঁছানোর পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন করছে ঠিকই, কিন্তু কতটুকু তার গুণগতমান রক্ষা পাচ্ছে, বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে, রোগীই বা কতোটুকু চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন, সেই তথ্য কাগজ-কলমে, প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবচিত্র ভিন্ন। দেখা যায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রায় ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের অনিয়মিত উপস্থিতি, অধিকাংশ সময়ে চিকিৎসকদের শহরে অবস্থান, রোগ নির্ণয় করার অপ্রতুল ব্যবস্থা ইত্যাদি কারণে রোগীরা উন্নত চিকিৎসার আশায় শহরের হাসপাতালে ছুটে আসেন। সরকারি হাসপাতালগুলো প্রায়ই থাকে দালাল দ্বারা আবৃত। সহজে নিজ ক্ষমতায় চিকিৎসাসেবা নেয়া কঠিন হয়। অনেকক্ষেত্রে রোগীদের দালালের আশ্রয় নিতে হয়। হাসপাতালে আবার রয়েছে কর্মচারীদের ইউনিয়ন, যা দেশের কেন্দ্রীয় রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত। রাজনীতির ভালোমন্দ এর ছায়া যেমন পড়ে হাসপাতালের অভ্যন্তরে, তেমন রাজনৈতিক দাপটে চলে এক ধরনের বাণিজ্য। চিকিৎসকরাও রাজনৈতিক বিভাজনে আক্রান্ত এবং তা বেশ দৃশ্যমান। চিকিৎসাসেবার আদর্শ অনেকটা হয়ে পড়ে রাজনৈতিক দলীয় আদর্শ। সহায়সম্বল বিক্রি করে তাই বেঁচে থাকার আকুল তৃষ্ণায় শহরের বেসরকারি হাসপাতালে রোগী আসেন চিকিৎসা নিতে। এসে তারা মরণ কামড় খান। এ ধরনের হাসপাতালে রোগী অসুস্থতা নিয়ে প্রবেশ করেন ঠিকই, কিন্তু রোগীর সঙ্গে আগত স্বজনও এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। রোগ নিরাময়ের আকাক্সক্ষায় হাসপাতালের চিকিৎসা বাণিজ্যের সঙ্গে মানানসই হয়ে ওঠা তাদের জন্য কঠিন মানসিক, সামাজিক পীড়ন হয়ে দাঁড়ায়।

না বলে উপায় নেই যে, শিক্ষার মতন চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবা এখন দেশের অত্যন্ত লাভজনক এক বাণিজ্য। ছাপোষা শিক্ষক খুব কম আছেন। যারা সম্মান, মর্যাদা, আদর্শকে আঁকড়ে বেঁচে আছেন। কিন্তু বিত্তবান শিক্ষক রয়েছেন অসংখ্য। যাদের কাছে আদর্শের চাইতে, মর্যাদার চাইতে বিত্তের মোহ অত্যধিক। ঠিক তেমনি মানবসেবার ব্রত নিয়ে চিকিৎসক হওয়ার কথা প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও, চিকিৎসক হওয়ার পর সেই ব্রত থাকে না। কোনো কোনো অবস্থায় চিকিৎসক হয়ে উঠেন নিদারুণ ব্যবসায়ী। বাণিজ্যের ধারাকে ধারালো করতে রোগীর অসহায়ত্বকে অবলম্বন করে ইদানীং ‘লাইফ সাপোর্ট’ সংস্কৃতির প্রচলন ঘটিয়েছেন কেউ কেউ। ক্লিনিক্যালি ডেথ রোগী দিনের পর দিন লাইফ সাপোর্টে রেখে অবশেষে মৃত ঘোষণা দেয়া কিংবা রোগীর জটিল অবস্থার অজুহাতে দ্রুত তাকে লাইফ সাপোর্টে রেখে দিনের পর দিন চিকিৎসা দেয়ার প্রবণতার পেছনে রয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা কামাই। আবার এমনও দেখা গেছে অপারেশন থিয়েটারে রোগীকে শুইয়ে রেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন রোগীর স্বজনকে, উনার এই সমস্যা ধরা পড়েছে। অপারেশন করতে এত টাকা লাগবে। অপারেশন করাবেন কী না? অসহায় স্বজন তার রোগীকে সুস্থ করতে চান। তাৎক্ষণিকভাবে তার কাছে সেই পরিমাণ টাকা না থাকলেও তিনি বলেন, ডাক্তারকে বলুন অপারেশন করতে। তখন স্বজনকে বলা হয়, ক্যাশ কাউন্টারে টাকা জমা দিন। এ যেন বড় বড় শপিংমলের ক্রেতা আর বিক্রেতার সংলাপ। পার্থক্য যেটুকু তা হলো, ক্রেতা সামর্থ্যরে বাইরে থেকেও কিনতে বাধ্য হন, ফিরে যাওয়ার পথ পান না। জীবন বলে কথা। চিকিৎসা সেক্টরে এ ধরনের ভোগান্তির জরিপ হলে এক ভয়াবহ চিত্র দেখা যাবে নিঃসন্দেহে।

চিকিৎসাসেবা নিয়ে সফল বাণিজ্যের দৃশ্যমান অবস্থা উপলব্ধি করে অনেক ব্যবসায়ী এই সেক্টরে বিনিয়োগ করতে উৎসাহ বোধ করেন। বিনিয়োগ করছেনও। ব্যাঙের ছাতার মতন প্রাইভেট হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক যত্রতত্র তারই ফলশ্রুতি। রোগ তো বারোমাসি মানবজগতের সমস্যা, সুতরাং ক্ষতি নেই, লাভ আছে। আবার কতটা দক্ষ লোকবল, মেধা, যোগ্যতা এবং বৈধতায় এসব চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে, তা দেখার কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা রয়েছে কিনা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই বলতে পারবেন। তবে কোনো দুর্ঘটনা বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে আসল তথ্য বের হয়ে আসে। যাদের অনুমোদন নিয়ে এসব বাস্তবায়ন হয়, তারা কখনো ভুল অনুমোদন দেয়ায় শাস্তির আওতায় এসেছেন কিনা কিংবা যাদের মনিটরিং করার কথা নিয়মিত অথচ মনিটরিং করেননি, তাদের শাস্তির আওতায় আসার ব্যবস্থা আছে কিনা, তাও কিন্তু আমাদের জানা নেই। মোবাইল কোর্ট বলে যে কোর্ট মাঝেসাঝে উঁকিঝুঁকি দেয়, সেসবে হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষের জরিমানা হয়, অনুমোদনকারী বা পরীবিক্ষণকারীর কী হয়, তা আমরা জানতে পারি না। চিকিৎসকদের ধর্মঘট করার মানসিকতার জন্ম কিন্তু এসব অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা থেকেও হয়। ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতা রাষ্ট্রের এক ধরনের অনিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থার ফলশ্রুতি। কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও সত্য। একজন চিকিৎসকের কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে সব চিকিৎসকের কর্মবিরতি পালন, শত শত রোগীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে, এই সত্য অনুধাবন করবার মানসিকতা না থাকাটা হলো, চরম স্বেচ্ছাচারিতা।

পরিশেষে বলি, পুলিশ, আইনজীবী ও চিকিৎসক হলেন মানুষের পরম ভরসার জায়গা। এই পেশাজীবীর ধর্মঘট বা কর্মবিরতিতে শত শত মানুষ যেমন অসহায় হয়ে পড়েন, তার দ্বিগুণ অসহায় হয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ এই পেশাজীবীর হয়রানির মানসিকতার সংস্কৃতিতে। ব্যতিক্রম ঘটনা বা চিত্র অবশ্যই আছে। আদর্শবান, মানবতাবাদী চিকিৎসক, পুলিশ ও আইনজীবী আছেন আমাদের দেশে। তারা অনেকটাই নিভৃতচারী। নীরবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সম্ভবত সে কারণে এ দেশের মানুষ বেঁচে থাকার কথা ভাবে, নিরাপদ থাকার স্বপ্ন দেখে। আর এই ভাবনা ও স্বপ্নকে সুদূরপ্রসারী করার জন্য সব সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিমুক্ত করা জরুরি।

স্বপ্না রেজা : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App