×

মুক্তচিন্তা

অপরিকল্পিত-অশিক্ষিত জনসংখ্যা সম্পদ নয়, অভিশাপ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০১৮, ০৭:৩২ পিএম

যে জনসংখ্যাকে আশীর্বাদ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে তার বিশাল অশিক্ষিত অংশ বিদেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে, সৌদি আরবে নারী শ্রমিক ও নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে কী দুর্বিষহ দৈহিক-মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে দেশে ফিরছে বা ফিরতে পারছে না সে করুণ ইতিহাস প্রকাশ পাচ্ছে সংবাদপত্রে। বিপুল জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক দায় সামাল দিতে গিয়ে সমাজ ও শাসকশ্রেণিকে সচেতনভাবে দেশের অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত নারীদের ইজ্জত বিকিয়ে দিতে হচ্ছে কিছু বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে। তাতে আর যাই হোক দেশের ইজ্জতও নষ্ট হচ্ছে। সমস্যার হয়তো কিছুটা লাঘব হচ্ছে।

বেশ কিছুকাল থেকেই আমাদের রাজধানীকেন্দ্রিক নাগরিক সমাজের দিন কাটে অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক সাময়িক উপভোগ্যতায়। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে দিবস সংস্কৃতির অনুষ্ঠান। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক পরিসরে স্বাস্থ্য দিবস থেকে শুরু করে ‘মা দিবস’, ‘বাবা দিবস’-এর মতো দিবস থেকে দিবস পালন, মার ভালোবাসা দিবস।

আমরা বুঝতে নারাজ যে এসব দিবস পালন সামাজিকভাবে আমাদের চেতনার কোনো পরিবর্তন ঘটায় না, একমাত্র দিনটিকে স্মরণ করিয়ে দেয়া ছাড়া। এ সব দিবস পালন অন্তত আমাদের সমাজে ফ্যাশন বৈ আর কিছু নয়, ক্ষেত্রবিশেষে আবেগের প্রকাশ মাত্র। জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থা যা কিছু ভেবে এ দিবসগুলোকে নির্ধারণ করুক না কেন।

এ সব দিবস পালনের পেছনে একটি বড় যুক্তি যে তা এর ভালোমন্দ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে, বিশেষ করে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালকদের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। মুক্ত দৃষ্টিতে বিচার করে দেখলে অস্বীকার করা যাবে না যে, এর কোনোটাই বাংলাদেশের জন্য সত্য হয়ে ওঠে না, সুফল বয়ে আনা তো দূরের কথা।

একটি উদাহরণ নেয়া যাক। এই যে ‘বিশ^ জনসংখ্যা দিবস’ বলে একটি বিশেষভাবে চিহ্নিত দিন পার হয়ে গেল, দুয়েকটি লেখাও এ উপলক্ষে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো, এর কতটা ফলাফল আমরা লক্ষ করেছি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ক্ষেত্রে বা সচেতন নাগরিক সমাজে। না, কিছুই না। এ সম্পর্কে দুচারজন চিন্তাবিদের মস্তিষ্ক চর্চার বাইরে অন্য কিছুই বাস্তবে ঘটেনি।

দুই. প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যা তথা জনঘনত্ব নিয়ে আমরা ভাবিত-তাড়িত বা উদ্বিগ্ন নই। এত ছোটখাটো একটি ভূখণ্ড, এর আয়তনিক বিচারে জনসংখ্যার ঘনত্ব নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক যদি কেউ এর সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি মনস্তাত্তি¡ক দিক নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করেন। আমরা তা করছি না।

যুক্তবঙ্গের সাত কোটি বাঙালি সন্তান কবে যে বিভাজিত এই বঙ্গে সাত/সাড়ে সাত কোটিতে পরিণত হলো, কেন হলো, কীভাবে হলো, কী তার আর্থসামাজিক তাৎপর্য অভিঘাত এসব নিয়ে শাসনযন্ত্রের ও সামাজিক সংস্থাগুলোর চিন্তা-ভাবনার কোনো অবকাশ আছে বলে মনে হয় না।

তাই সে সংখ্যা দিব্যি খেয়ে-পরে, হেলেদুলে আমাদের ঘুমন্ত চেতনাকে ফাঁকি দিয়ে বিনা বাধা বা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই সম্প্রতি ষোলো/সতেরো কোটিতে পরিণত। আমরা নিশ্চিন্ত, আমরা নিরুদ্বেগ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, অর্থাৎ জন্মহার বিবেচক পরিসংখ্যানবিদরা মনে করছেন এ সংখ্যা অনতিকাল পরই পঁচিশ কোটিতে পৌঁছে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেবে, ‘গিনিস বুকে’ নাম উঠবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হার বৃদ্ধির আচানক সাফল্যে।

সঙ্গত একটি কথা বলি, ইতোপূর্বে বছর কয়েক বারকয়েক উল্লেখ করেছি যে, গত শতাব্দীর ষাটের দশকে কী কারণে, জানা নেই, পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণের এক হিসাবে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, বেহিসাবি জন্মহার হ্রাস করার উদ্দেশ্যে। গ্রামপর্যায়ে পর্যন্ত পরিবার-পরিকল্পনা কর্মীদের যাতায়াত ছিল গ্রামীণ গৃহবধূদের অপরিকল্পিত পরিবারের নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে, এর সামাজিক ক্ষতির দিকগুলো বুঝিয়ে দিতে, সর্বোপরি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে। তাদের নির্ধারিত শ্লোগান ছিল, এক পরিবারে সর্বোচ্চ দুটি সন্তাই যথেষ্ট।

প্রসঙ্গক্রমে আমরা সে সময় এবং এখনকার চীন ও ভারতের ঘন জনসংখ্যার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে দেখা যাবে তাদের চিন্তাভাবনা ও জনসংখ্যা বিষয়ক দূরদর্শী হিসাব-নিকাশের কথা। চীন এদিক থেকে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিল ‘দুটি নয়, এক পরিবারে একটি সন্তানই যথেষ্ট’, এই শ্লোগান বাস্তবায়িত করে।

চীনের জনঘনত্ব ছিল কিংবদন্তিতুল্য। লক্ষ্য অর্জনের কঠোরতা তাদের সাফল্য এতটা নিশ্চিত করেছিল যে, এক পর্যায়ে সে নীতি কিছুটা শিথিল করতে তাদের অসুবিধা হয়নি। সর্বোপরি কর্মসংস্থানের কারণে জনসংখ্যা তাদের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়নি, বরং তা কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছে। তুলনায় ভারত ততটা সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও তাদের দেশের জন্মহার বাংলাদেশের মতো অপরিকল্পিত নয়।

বাংলাদেশ ষাটের দশকের পূর্বোক্ত পরিবার পরিকল্পনার সাফল্য যথাযথ কঠোরতায় অনুসরণ করেনি। পরিবার-পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাজেট যেমনই হোক, স্বাধীনতা-উত্তরকালে তারা এর সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। তাই দেখা যায়, শহরে-গ্রামে পরিবার-পরিকল্পনার মাঠকর্মীদের কর্মতৎপরতার অভাব, সেখানকার গৃহবধূদের জন্মনিয়ন্ত্রণমূলক সচেতনতা ও ব্যবস্থা গ্রহণে উদাসীনতা। পরিণামে অপরিকল্পিত জন্মহার বৃদ্ধি নানামাত্রিক সামাজিক সংকট তৈরি করে চলেছে।

তিন. আমরা স্বীকার করি আর না-ই করি আমাদের সামাজিক পরিস্থিতি জনসংখ্যার ভারে সমস্যার ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে। আমরা সেসব পরিস্থিতি, পরিসংখ্যান ও হিসাব-নিকাশ নিয়ে উদ্বিগ্ন বা উৎকণ্ঠ নই। লক্ষ করে দেখছি না যে, পরিস্থিতি সামাজিক ভাঙনের কাজটি নীরবে করে চলেছে, এর বহিঃপ্রকাশটিই আমরা দেখছি, এর নিহিত কারণের দিকে ফিরে তাকাচ্ছি না, প্রতিরক্ষা, প্রতিকার বা প্রতিষেধকমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দূরে থাক।

আগেই বলেছি, বাংলাদেশ ভ‚মি বিচারে ছোট ভূখণ্ড ভিত্তিক দেশ। মূলত কৃষিপ্রধান এ দেশে জনসংখ্যার তুলনায় ভ‚মির পরিমাণ তুলনামূলক হিসাবে কম। প্রধান খাদ্য উপকরণের উৎপাদন এখনো সংকট তৈরি না করলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ অচিরেই তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।

একটি পরিবার যখন সন্তান উৎপাদনের আধিক্যে নিদেনপক্ষে চারটি পরিবারে পরিণত হয় তখন তাদের এক-চতুর্থাংশ জমি থেকেই নতুন বাস্তুভিটা তৈরি করতে হয়। খাদ্য উৎপাদনের প্রয়োজন বাড়ে। বিভক্ত জমির উৎপাদনশক্তি বর্ধিত জনসংখ্যার সহায়ক হয়ে ওঠে না। হালচাষের গরুর জন্য ঘাস জমিরও ঘাটতি দেখা দেয়।

গ্রামে কুটিরশিল্পের যথাযথ বিকাশ না ঘটায় উপার্জনের উৎসেও ঘাটতি, তাই বেকারত্বের হার বৃদ্ধি। পরিসংখ্যান বলে ভ‚মিহীন কৃষক তথা ক্ষেতমজুরের সংখ্যা বৃদ্ধি (৬০ শতাংশ) আর্থসামাজিক সমস্যা তৈরি করে চলেছে। তদুপরি নতুন উপদ্রব ভ‚মিদস্যুদের জমির ওপর আগ্রাসন, আবাসন শিল্প ও আধুনিকতার টানে নতুন নতুন প্রকল্প কৃষিযোগ্য ভূমির পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস করে চলেছে।

এসবের আনুষঙ্গিক নেতিবাচক দিকগুলো কম গুরুত্ব বহন করে না। ইটভাটার সংখ্যা বৃদ্ধি, তার জন্য জমি দখল যেমন একদিকে সর্বনাশ ডেকে আনছে, তার উত্তপ্ত কালো ধোঁয়া শুধু বায়ু দূষণ ও মানব স্বাস্থ্য নষ্ট করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, পরিবেশ ও জলবায়ু দূষণ, ওজন স্তর নষ্ট ইত্যাদি নানা পথে পৃথিবীকে পরিবেশ বাসের অযোগ্য করে তুলেছে।

কয়লাভিত্তিক ব্যাপক শিল্পকারখানা থেকে কার্বন নিঃসরণ নিঃসন্দেহে সুস্থ জীবনযাত্রার পক্ষে সর্বনাশের ইঙ্গিত বহন করছে। কিছুকাল আগে একটি সংবাদে দেখা গেছে, চীন তার কয়লাভিত্তিক শিল্পকারখানার সংখ্যা তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় কমিয়ে আনতে শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সর্বনাশের গুরুত্ব স্বীকার করেও চীনের উদাহরণ অনুসরণ করছে না। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর অধিকাংশ একই পথের যাত্রী। বাংলাদেশ একইরকম ভুল পথে হাঁটছে। তার শিল্পায়ন একই ধারায়। ‘হাইওয়ে’ তথা জনপথে বের হলে দুপাশে কেবলই দেখা যায় ইটভাটার কালো ধোঁয়া আর একদা ফসলি জমিতে মাটি ভরাট করে নতুন নতুন কাঁচাপাকা ঘরবাড়ি। নতুন প্রজন্মের জন্য আশ্রয় ঘর নির্মাণের প্রতিযোগিতা।

একদিকে কথিত অর্থনৈতিক উন্নতি, রাজধানী ও প্রধান নগরগুলোর আধুনিক চাকচিক্য, শপিংমল, বাণিজ্যিক বিস্তারের পাশাপাশি বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি সমাজকে দুদিকে কাটছে। প্রথমত, জীবন-মৃত্যুকে তুচ্ছ করে উপার্জনের আশায় অবৈধ অভিবাসী যাত্রী, দালালচক্রের হাতে পড়ে শরণার্থীদের চরম দুরবস্থা ও করুণ মৃত্যুর ঘটনা কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে বড় হরফে লাল কালির শিরোনাম এবং তা বিশ্বজুড়ে সংবাদপত্র মহলে। অবিশ্বাস্য সব করুণ দৃশ্য! তার মধ্যে বাংলাদেশও উপস্থিত।

দ্বিতীয়ত, যে জনসংখ্যাকে আশীর্বাদ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে তার বিশাল অশিক্ষিত অংশ বিদেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে, সৌদি আরবে নারী শ্রমিক ও নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে কী দুর্বিষহ দৈহিক-মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে দেশে ফিরছে বা ফিরতে পারছে না সে করুণ ইতিহাস প্রকাশ পাচ্ছে সংবাদপত্রে।

এ অবস্থার প্রতিকার ছিল দেশের নারী-পুরুষ জনশ্রেণিকে শিক্ষিত করে তোলা- সাধারণ ও কারিগরি দিক থেকে। বিপুল জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক দায় সামাল দিতে গিয়ে সমাজ ও শাসকশ্রেণিকে সচেতনভাবে দেশের অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত নারীদের ইজ্জত বিকিয়ে দিতে হচ্ছে কিছু বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে। তাতে আর যাই হোক দেশের ইজ্জতও নষ্ট হচ্ছে। সমস্যার হয়তো কিছুটা লাঘব হচ্ছে।

এক কথায় ক্রমবর্ধমান বিপুল জনসংখ্যা দেশের জন্য যে সংকট তৈরি করছে নানা খাতে, নষ্ট করছে কৃষিজমির পরিমাণ, সাফ করছে বনজঙ্গল এবং হাত বাড়াচ্ছে সুন্দরবন সংহারের মতো একাধিক সর্বনাশে, সর্বোপরি যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন গ্রাস করতে থাকবে। এ সমস্যা নিরসনের উপায় শিক্ষা বিস্তার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ। আর সে জন্য দরকার পূর্বোক্ত জন্মনিয়ন্ত্রণ ও পরিবার-পরিকল্পনার দ্রুত ও ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ, ষাটের দশকের মতো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। না হলে সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপদ বাংলাদেশকে ক্রমশ গ্রাস করবে, তার সব উন্নয়ন অর্থহীন করে তুলবে।

আহমদ রফিক : ভাষাসংগ্রামী, লেখক ও গবেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App