×

মুক্তচিন্তা

কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে রাজনীতিকীকরণ কতটা যৌক্তিক

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০১৮, ০৮:১১ পিএম

এখন কথা উঠছে কোটা সংস্কার আন্দোলনে মৌলবাদীরা ঢুকে পড়েছে ঠিক তেমনি ছাত্রলীগের ভিতরও শিবির ঢুকে পড়েছে। নইলে জনগুরুত্বপূর্ণ একটি বৈষম্য নিরোধ বাতিল করার আন্দোলনকে থামাতে তারা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করত না। আর এ হামলার মাধ্যমে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা শিবির চাচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক ছাত্র সংগঠনকে জনবিচ্ছিন্ন করার।

বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ৪ দশকে সার্বিক আর্থ-সামাজিক দিক বিবেচনায় ইতিবাচক উন্নয়নের সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। আর বাংলাদেশের এই ইতিবাচক উন্নয়ন দেশের সর্বত্র সমানভাবে হয়েছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ সরকারের এই উন্নয়নের সুফল সমানভাবেই পাচ্ছেন। দেশের নিয়োগ ব্যবস্থায় যখন কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়, তখন বাংলাদেশ ছিল একটা পশ্চাৎপদ দেশ। সেই সময়কার বিশ্ব আর্থসামাজিক অবস্থার নিরিখে। এই সময়টায় বাংলাদেশের সব অঞ্চলে সমানভাবে উন্নয়ন হয়নি। তাই দেশের সব অঞ্চলকে সমভাবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা দিতে চালু করা হয়েছিল এই নিয়োগ পদ্ধতি কোটা ব্যবস্থা। বর্তমানে বাংলাদেশের এমন কোনো অঞ্চল নেই যেখানকার সামাজিক সূচকে উন্নতি আগের চেয়ে ইতিবাচক হয়নি বা অন্য কোনো এলাকা থেকে অনেক পেছনে পড়ে আছে। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিয়োগে যে কোটা পদ্ধতি রয়েছে তার পরিবর্তন আশু জরুরি।

কোটা সংস্কার আন্দোলটাকে রাজনৈতিক বলা যায়, তবে দলীয়করণ বা সরকারবিরোধী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করাটা উচিত না। কোটা সংস্কার আন্দোলনটা কোনো রাজনৈতিক দলের মস্তিষ্ক থেকে প্রসূত নয়। এটা কোনো রাজনৈতিক দলের ইস্যুও না। যারা আগামী প্রজন্মের মঙ্গল চান তাদের উচিত এই আন্দোলনটাকে দলীয় সীমিত গণ্ডিতে না দেখা। কারণ এ দেশের অনগ্রসর এলাকা হিসেবে এখন আর কোনো অঞ্চল নেই। সরকার সারা দেশকেই বিদ্যুতায়িত করে ফেলেছে সেইসঙ্গে প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা, এখন মানুষ সবকিছুই ঘরে বসেই জ্ঞান বিজ্ঞান, সারা পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সহজেই পেয়ে যায়। সুতরাং জ্ঞান আহরণের ইচ্ছা করলে ঘরে বসেই তা লাভ করা যায়। তাই অঞ্চলভিত্তিক কোটা বাতিলটা জরুরি। এ দিকগুলো যারা বিবেচনায় না নিয়ে অবিবেচকের মতো, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে বিরোধী দলের কারসাজি হিসেবে যারা আখ্যা দিচ্ছেন তারা এ সরকারের মঙ্গল চান না। অপরদিকে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে খ্যাত বিএনপি কি ঘোষণা দিয়েছেন তারা ক্ষমতায় গেলে কোটা প্রথা বাতিল করবেন? সুতরাং ছাত্রদের একটা ন্যায্য দাবিকে এভাবে রাজনীতিকীকরণ করার উদ্দেশ্যটাই হলো উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানো। রাজনৈতিক অঙ্গনকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি.., কোটা সংস্কারকারীদের জঙ্গি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। বাস্তবতাটা কী? যারা কোটা সংস্কার করার বিষয় নিয়ে আন্দোলন করছেন তারা কি জঙ্গি? তিনি কি উদ্দেশ্যে এটা বলেছেন জানি না। বর্তমান সময়কালে দেখা যায়, যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরনের দায়িত্বে থাকেন তারা হয়ে যান সরকারের তল্পিবাহক। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন কাউকে ঢালাওভাবে জঙ্গি বলাটা উচিত না। ভিসি মহোদয়ের কোটা সংস্কার নিয়ে যে মন্তব্যগুলো করছেন তার সঙ্গে এই চলমান আন্দোলনের সাদৃশ্যতা নেই বললেই চলে। এটা সব মহলেই ভালো করে জানে যে, কোটা সংস্কার আন্দোলনটা কোনো রাজনৈতিক দলের সৃষ্ট ইস্যু না তবে চলমানই আন্দোলনের জনপ্রিয়তাটা নিজেরদের পক্ষে নিতে কেউ কেউ মরিয়া হয়ে উঠেছেন। অপরদিকে সরকারের কিছু তোষামোদকারী চলমান আন্দোলনকে স্বাধীনতা বিরোধীদের কারসাজি বলে ছাত্র সমাজের ন্যায্য দাবিটাকে নস্যাৎ করতে চাচ্ছেন। কোটা সংস্কার না হলে বিরাজমান বৈষম্য নিয়ে ভবিষ্যতেও চলবে নানা জটিলতা আর এই জটিলতাকে সরকারের তোষামোদকারীরা কুটিল করে নিজেদের ফায়দা হাসিল করবেন।

আমরা যদি সমগ্র আন্দোলনটাকে লক্ষ করি তাহলে শিক্ষার্থীদের দাবি এবং আন্দোলনের যে কৌশলটা রয়েছে তা অনেকটা সরলতায় দীপ্ত। রাশেদের মা তার ছেলের মুক্তি চেয়ে বলেছেন তার ছেলে আন্দোলন করেছে চাকরি পাওয়ার জন্য ক্ষমতায় বসার জন্য নয়। কথাটা কিন্তু সঠিক। প্রশাসনও এই আন্দোলনটাকে ঘোলা করতে চাচ্ছে।

আন্দোলনকারীদের প্রতি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের এত আক্রোশ কেন। ছাত্রলীগের অতীত ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ রকম প্রতিটি বৈষম্যমূলক প্রথার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ রাজপথে নেমেছে। কোটা বিদ্যমান থাকাটা বৈষম্যকেই জিইয়ে রাখা। এটা খালি চোখেই বোঝা যায়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করায় বিষয়টি আরো ঘোলা করে দিয়েছে। শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলন নয়, নানা সময় নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগ দিন দিন বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। ছাত্রলীগের এ ধরনের কার্যক্রমের ফলে সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্রতি সরকারের আচরণটা ঠিক নয়। সরকারের উচিত ছিল কোটা সংস্কারের বিষয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা। কারণ যারা আন্দোলন করছে তারা এ দেশের সাধারণ মানুষের সন্তান। সরকার এই মানুষেরই প্রতিনিধিত্ব করছে। সুতরাং এই বিমাতাসুলভ আচরণের ফল একদিন এই সরকারি দলকেই বহন করতে হবে।

এখন কথা উঠছে কোটা সংস্কার আন্দোলনে মৌলবাদীরা ঢুকে পড়েছে ঠিক তেমনি ছাত্রলীগের ভিতরও শিবির ঢুকে পড়েছে। নইলে জনগুরুত্বপূর্ণ একটি বৈষম্য নিরোধ বাতিল করার আন্দোলনকে থামাতে তারা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করত না। আর এ হামলার মাধ্যমে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা শিবির চাচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক ছাত্র সংগঠনকে জনবিচ্ছিন্ন করার।

পাকিস্তানের সময় ছাত্র আন্দোলনকে সেই সময়কার পাকিস্তানি সরকারের তল্পিবাহকরা বলত এই ছাত্ররা পূর্ব পাকিস্তানকে ভারত বানাতে চায়। আর বর্তমানে স্বাধীন দেশে সেই তল্পিবাহকের উত্তরসূরির একটি অংশ এখন সরকারের মধ্যে আছে। নইলে কেন তারা এ ধরনের অরাজনৈতিক আন্দোলনের ওপর হামলা করবে। সুতরাং বর্তমান সরকার নিজেকে জনবান্ধব হিসেবে প্রমাণ করার জন্য কোটা সংস্কার জরুরি। আর দ্রুত এই সংক্রান্ত একটি গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশ করাটাও উচিত আর এটা করে ফেললে মূল আন্দোলনটাকে আর কেউ দলীয়করণ করতে পারবে না।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App