×

জাতীয়

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০১৮, ১১:১৫ এএম

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি
দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভারি বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় বেশির ভাগ নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে গতকাল বিপদসীমা অতিক্রম করেছে তিস্তার পানি। সিলেটে সুরমাসহ আরো বেশ কয়েকটি নদীর পানি কয়েক দিন আগেই বিপদসীমা ছাড়িয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। সব মিলিয়ে সারা দেশেই বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর : সুনামগঞ্জ : গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় সুরমা নদীর সুনামগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৭৭ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এরই মধ্যে সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার নদী তীরবর্তী তেঘরিয়া, বড়পাড়া, নবীনগর, কুতুবপুরসহ বেশকিছু এলাকার বাসাবাড়ি ও রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়েছে। সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলার বেশির ভাগ সড়কই পানির নিচে নিমজ্জিত। ফলে সড়ক দিয়ে চলাচলকারী জনগণ পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে। এসব উপজেলার বেশ কয়েকটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পানি আসায় শিক্ষার্থীদেরও বিদ্যালয়ে আসতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে বর্ষায় এমনিতেই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এক প্রকার দুর্ভোগ দেখা দেয়। বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ে যেতে তাদের একমাত্র বাহন নৌকা। এর মধ্যে কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের ফলে দুর্ভোগ আরো চরমে পৌঁছেছে। এদিকে, পাহাড়ি ঢলে জেলার দোয়ারাবাজার ও ছাতক উপজেলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ দুই উপজেলার আমন বীজতলা এবং পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ছাতক উপজেলার নিম্নাঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বর্তমানে সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ৫-৬ দিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে উপজেলার সীমান্তবর্তী ইসলামপুর ও নোয়ারাই ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। গ্রামীণ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে বিচ্ছিন্ন। এ ছাড়া ছাতক সদর, কালারুকা, চরমহল্লা, দোলারবাজার, ভাতগাঁও, উত্তর খুরমা, দক্ষিণ খুরমা, সিংচাপইড়, গোবিন্দগঞ্জ-সৈদেরগাঁও ও ছৈলা-আফজলাবাদ ইউনিয়নসহ পৌরসভার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিশ্বম্ভপুর উপজেলা থেকে তাহিরপুর উপজেলা সদরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের একমাত্র সড়কের প্রায় এক কিলোমিটার পানির নিচে নিমজ্জিত থাকায় যান চলাচল বন্ধ আছে। যদিও এখনো ব্যাপকমাত্রায় বন্যা দেখা দেয়নি, তবুও প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম। তিনি জানান, ইতোমধ্যে প্রতি উপজেলায় ১০ টন চাল ও নগদ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যদি আরো প্রয়োজন হয় দেয়া হবে। এছাড়াও প্রতিটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের দুর্যোগ মোকবেলার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বলেন তিনি। সিলেট : গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে সিলেটে। ইতোমধ্যেই বিপদসীমা ছাড়িয়েছে সুরমা। কুশিয়ারার পানিও বাড়ছে। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে টানা বৃষ্টিপাত। সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ সাঈদ চৌধুরী জানান, এই মাসে মোট বৃষ্টিপাত হয়েছে ৭৯২ মিলিমিটার। এটা জুলাই মাসের হিসাবে অতিরিক্ত নয়। কিন্তু ভারতের মেঘালয় ও আসামে অস্বাভাবিক হারে বৃষ্টিপাত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে আরো বৃদ্ধি পাবে সুরমা-কুশিয়ারার পানি। ফলে বন্যার আশঙ্কা আছে। এখনই বন্যার ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বলেই মনে করছেন আবহাওয়া অফিসের এই কর্মকর্তা। এদিকে বৃষ্টিপাত আর উজানের পানিতে বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে সুরমা। সুরমা নদীর তিনটি পয়েন্টেই পানি বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১৩ দশমিক ৩৯, সিলেটে ১০ দশমিক ৪৪ ও জকিগঞ্জের আমলশীদে ১৪ দশমিক ৮৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারার পানি অন্যান্য পয়েন্টে বিপদসীমার নিচে থাকলেও ফেঞ্চুগঞ্জে তা বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা ছাড়িয়ে ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, উজান থেকে নেমে আসা ঢলে দ্রুত ?বৃদ্ধি পাচ্ছে পানি। অন্যদিকে সুরমার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সিলেট ও মৌলভীবাজারের কয়েকটি নিচু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এরমধ্যে গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, সিলেট সদর, গোলাপগঞ্জের অনেক রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়েছে। তাছাড়া গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বিপদসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পিয়াইন ও সারি নদীর পানি। এতে উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে প্রায় অর্ধশত গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। প্রবল বন্যায় রোপায়িত আউশ ও বীজতলাসহ প্রায় সহস্রাধিক হেক্টর ফসল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে বলে জানিয়েছে উপজেলা কৃষি অফিস। বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়ে সারী-গোয়াইনঘাট ও সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়ক তলিয়ে গিয়ে উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি ২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও, যার মধ্যে ১০টি বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে পানি উঠায় সাময়িকভাবে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। গত দিন দশেক আগে সপ্তাহব্যাপী বন্যায় ভাঙনের কবলে পড়া নদীর তীর ও ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর মেরামতের সুযোগ না দিয়ে আবারো আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়ায় মহাদুর্ভোগে পড়েছেন দুর্গত এলাকার মানুষ। এ ছাড়াও বন্যা পরিস্থিতির অবনতিতে জাফলং, আলীরগাঁও, রুস্তমপুর, ডৌবাড়ী, লেঙ্গুড়া, তোয়াকুল ও নন্দীরগাঁও ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ আবারো পানিবন্দি হওয়ার আশঙ্কায় আছেন। ইউপি সদস্য মো. জিলানি মিয়া জানান, আমার এলাকার ৪৩টি পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এ ছাড়াও বেশ কয়টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে জনসাধারণ চরম দুর্ভোগে রয়েছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান জানান, বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে কিছু জমির ফসল ও বীজতলা নিমজ্জিত হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হলে এর পরিমাণ বাড়তে পারে বলেও জানান তিনি। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. মোশাহিদ মিয়া জানান, বন্যার পানি বেড়ে এ পর্যন্ত ২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি উঠায় সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারছে না। যার ফলে ওই বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকায় সাময়িকভাবে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এদিকে বন্যার্তদের সাহায্যার্থে যে পরিমাণ ত্রাণ সরবরাহ করা হচ্ছে। তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম চৌধুরী। তিনি বলেন, বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। উপজেলার নিম্নাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা বরাদ্ধ দিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের আহ্বান জানান তিনি। ডিমলা (নীলফামারী) : উজানের ঢলে ও ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তার পানি বিপদসীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এই পয়েন্টে নতুনভাবে বিপদসীমার পয়েন্ট নির্ধারণ করা হয়েছে ৫২ দশমিক ৬০ মিটার। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় তিস্তার পানি বিপদসীমার ৫২ দশমিক ৫৮ সেন্টিমিটার, বিকেল ৩টায় ৫২ দশমিক ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও সন্ধ্যা ৬টায় তা বেড়ে ৫২ দশমিক ৭১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে বলে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। এদিকে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের প্রায় দুই হাজার বসতবাড়িতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। এদিকে তিস্তা নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার চরবেষ্টিত গ্রামগুলোতে নদীর পানি প্রবেশ করেছে। উজানের ঢলে ও ভারী বর্ষণে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে তিস্তা বেষ্টিত নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের দুই হাজার বাড়িতে বন্যা দেখা দিয়েছে এবং বেশকিছু আবাদি জমি তলিয়ে গেছে। পূর্বছাতনাই ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ খান, টেপাখড়িবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম সাহিন এবং খালিশা চাপানি ইউপি চেয়ারম্যান আতাউড় রহমান সরকার জানান, ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের জলকপাট খুলে দেয়ার ও ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে এলাকার বসতবাড়িতে পানি উঠে বন্যা দেখা দিয়েছে ও আবাদী জমি তলিয়ে গেছে। তিস্তা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তিস্তার চরবেষ্টিত নি¤œাঞ্চলে ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই ইউয়িনের পূর্ব ছাতনাই, ঝাড়শিংহেশ্বর গ্রাম, খালিশা চাপানীর বাইশ পুকুর ও ছোটখাতা গ্রাম, ঝুনাগাছ চাপানীর ছাতুনামা, ভেন্ডাবাড়ি গ্রাম, খগাখড়িবাড়ির কিসামত ছাতনাই, দোহলপাড়া গ্রাম, টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চড়খড়িবাড়ী, পূর্বখড়িবাড়ী ও উত্তরখড়িবাড়ী গ্রামে বানের পানি প্রায় দুই হাজার বসতবাড়িতে প্রবেশ করায় লোকজন উঁচুস্থানে আশ্রয় নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম চৌধুরী জানান, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরবেষ্টিত এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App