×

জাতীয়

হাল ছাড়েনি জঙ্গিবাদীরা!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০১৮, ১১:৫৮ এএম

হাল ছাড়েনি জঙ্গিবাদীরা!
দেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের পর নানা কায়দায় বারবার নিজেদের অবস্থান জানান দেয়ার চেষ্টা করেছে জঙ্গিরা। প্রথম প্রথম ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালালেও পর্যায়ক্রমে গ্রেনেড ও শক্তিশালী বোমা ব্যবহারের পাশাপাশি আধুনিক অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত হয়েছে তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হলেও থেমে থাকেনি তাদের তৎপরতা। নিত্যনতুন কৌশলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘হিট লিস্ট’ বাস্তবায়নের পাশাপাশি সদস্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। আদালতের রায়ে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রসফায়ারে কয়েক ডজন শীর্ষ নেতার মৃত্যুতে নেটওয়ার্ক ভেঙে গেলেও অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে কখনোই হাল ছাড়েনি জঙ্গিরা। নতুন নতুন নামে সংগঠিত হয়ে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করছে তারা। চুরি, ডাকাতির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের পাশাপাশি অস্ত্রের মজুত বাড়াতে বিদেশি জঙ্গিদের সঙ্গেও রাখছে যোগাযোগ। সেইসঙ্গে ধনীর দুলাল, উচ্চ শিক্ষিত ও বেসরকারি বিশ্ববিদালয়ে শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে অনলাইনেও সরব রয়েছে তারা। এদিকে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি) ও জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নামে তৎপরতা চালানোর পর গত কয়েক বছর ধরে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ও নব্য জেএমবির ব্যানারে তৎপরতা চালাচ্ছে জঙ্গিরা। জাতীয় নির্বাচনের আগে এই দুটি জঙ্গি সংগঠন নাশকতার পরিকল্পনা করছে এমন খবরও রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। এরই মধ্যে পুরনো জিএমবি সদস্যরাও নতুন করে তৎপরতা শুরু করেছে বলে প্রমাণ মিলেছে। এ পরিস্থিতিতে পুলিশ, র‌্যাব ও কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিট (সিটিটিসি) সদস্যরা জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদার করেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি (গোপনীয়) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, জঙ্গিরা বারবার সুযোগ খুঁজছে। আইনশৃঙখলা বাহিনীর নিয়মিত অভিযান ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের কারণে তাদের পরিকল্পনা ভন্ডুল হচ্ছে। এরই মধ্যে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজন আটকের পর জানা গেছে তারা জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত। সবদিকে নজর রেখেই কাজ করছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবকটি ইউনিট। ১৯৮৯ সালে যশোরের মনিরামপুরের মাওলানা আবদুর রহমান ফারুকীর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় হুজিবি (হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ)। আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্তের খোস্ত রণাঙ্গনে হুজির জন্ম। বাংলাদেশে সংগঠনটির শাখা খোলা হয় মিয়ানমারের আরাকানে স্বাধীনতাকামী রোহিঙ্গা মুসলমানদের পক্ষে লড়াই করতে। ওই বছরই আফগানিস্তানের খোস্তে মাইন অপসারণের সময় ফারুকী নিহত হয়। এরপর ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল মুফতি হান্নানের নেতৃত্বে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে হুজিবি। ২০০০ সালের ২২ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলে ৭৬ কেজি ওজনের একটি বোমা পুঁতে রাখার পাশাপাশি আরো বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলা চালিয়েছে এই সংগঠনটি। এদিকে ১৯৯৮ সালে শায়খ আবদুর রহমান জেএমবি প্রতিষ্ঠা করার পর ২০০১ সালে সংগঠনটি প্রথম হামলা চালায়। ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের রক্সি সিনেমা হল ও সার্কাস মাঠে বোমা হামলা চালায় তারা। এরপর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে একযোগে সিরিজ বোমা হামলা ছাড়াও রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, পল্টনে সিপিবি ও যশোর এবং নেত্রকোনায় উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলা চালায় জেএমবি। এ ছাড়া বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের একজন মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় এবং পুলিশের সহযোগিতায় ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে রাজশাহীর বাগমারায় জেএমবির জঙ্গিরা প্রকাশ্যে মাঠে নামে। তখনই নওগাঁর রানীনগর, আত্রাই এবং নাটোরের নলডাঙ্গা থেকে লোক ধরে এনে বর্বর নির্যাতন চালানো শুরু হয়। জঙ্গি নির্যাতনে অন্তত ২৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৩ সাল পর্যন্ত অন্তত ৪০টি হামলায় জড়িত ছিল জেএমবি। এসব হামলায় শতাধিক ব্যক্তি নিহত হন। এ ছাড়া ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রæয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে দুই জঙ্গি নেতাকে ছিনতাই করে জেএমবির সদস্যরা। জেএমবির সঙ্গে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক উগ্রপন্থি সংগঠন আল মুহাজেরুনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ২০০৬ সালে জেএমবির তৎকালীন প্রধান শায়খ আবদুর রহমানকে সিলেটের সূর্ঘদীঘল বাড়ি থেকে সপরিবারে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর জেএমবি নেতা আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইসহ ছয় শীর্ষ নেতার ফাঁসির দন্ড কার্যকর হয়। এরপর ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে জেএমবি। তবে ২০১৩ সালে তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে পুরনো জেএমবির কয়েক সদস্য ও নতুনভাবে আরো কিছু লোকজন নিয়ে নব্য জেএমবির জন্ম হয়। এর আগে ২০০৮ সালে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) আত্মপ্রকাশ ঘটে। যার আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি জসীমুদ্দীন রাহমানি আর সামরিক শাখার প্রধান মেজর (বরখাস্ত) জিয়া। এদিকে ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে বর্বর হামলা চালিয়ে বিদেশি নাগরিক, পুলিশ ও সাধারণ মানুষসহ ২২ জনকে হত্যা করে নব্য জেএমবি। এর সপ্তাহ খানেক পরই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতে হামলার ঘটনায়ও আলোচিত হয় এই জঙ্গি সংগঠনের নাম। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় একের পর এক প্রগতিশীল লেখক, প্রকাশক হত্যা করে জঙ্গিরা আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এদিকে গত ১১ জুন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে প্রকাশক ও লেখক শাহজাহান বাচ্চু হত্যার সঙ্গে পুরনো জেএমবির সদস্যদের জড়িত থাকার তথ্য পায় পুলিশ। এ ঘটনায় সংগঠনটির অন্তত ছয়জন সদস্য সম্পৃক্ত ছিল। তাদের মধ্যে মূল পরিকল্পনাকারী আবদুর রহমান ওরফে লালু গত বৃহস্পতিবার পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় জেএমবির আরো তিন সদস্য সাঈদ, আক্কাস ও কাওসার। গুলশানের হলি আর্টিজান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার দীর্ঘদিন পর মুন্সীগঞ্জের এ ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। জানা গেছে, ২০১৩ সালের পর পুরনো জেএমবি দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি অংশের নেতৃত্বে দেয় সালাউদ্দিন ওরফে সালাউদ্দিন ও আরেকটি অংশের নেতৃত্ব দেয় সানাউল্লাহ ওরফে ওয়ামিম বিন আজওয়াদ। সালাউদ্দিন বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য জেএমবির দুটি পৃথক অংশ তৈরি করে। বাংলাদেশ অংশে তার সংগঠনে ছিল তাসনিম, জিয়া ও নাঈম। ভারতের অংশে নেতৃত্বে রয়েছে এনাম ওরফে এডভোকেট ফারুক, কাওসার ওরফে বোমা মিজান ও নসরুল্লাহ ওরফে সোহেল মাহফুজ। এ ছাড়া জেএমবির সানাউল্লাহর নেতৃত্বাধীন অংশটির অধিকাংশই তামিম চৌধুরীর নব্য জেএমবির সঙ্গে মিশে যায়। তাদের মধ্যে ছিল সারোয়ার জাহান, রিপন, পিচ্চি শফিক, সুলতান মাস্টার, ফারদিন, মারজান ও সাগর। এই সংগঠনের একাধিক নেতা বোমা ও আইইডি তৈরির দক্ষ কারিগর। ২০১৩ সালেই এবিটি (বর্তমান নাম আনসার আল ইসলাম) আত্মপ্রকাশের পর পুরনো জেএমবি খানিকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সম্প্রতি পুরনো জেএমবি নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার আলামত পেয়েছেন গোয়েন্দারা। সিলেটে জনপ্রিয় শিক্ষক জাফর ইকবালের ওপর হামলা ও মুন্সীগঞ্জে প্রকাশক হত্যার ঘটনায় পুরনো জেএমবির সরব হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে বলে মনে করছে পুলিশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App