×

মুক্তচিন্তা

আওয়ামী লীগের গাজীপুর জয় : অতঃপর?

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ৩০ জুন ২০১৮, ০৭:১৩ পিএম

বিএনপি-দরদিরা মানতে চান না যে, বর্তমানে এই দলটি এক নাজুক সময় অতিক্রম করছে। দেশের মানুষের বিবেচনাবোধ নিয়ে সঠিক ধারণা না থাকলে একটি রাজনৈতিক দল সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মানুষ কোন বিবেচনায়, কেন আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বিএনপিকে গ্রহণ করবে সেটা যতক্ষণ তারা স্পষ্ট করতে না পারবে ততক্ষণ নির্বাচনে বিজয় তাদের অধরাই থেকে যাবে।

চলতি হাওয়া

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রত্যাশিত জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ২৬ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম চার লাখের কিছু বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির হাসানউদ্দিন সরকার দুই লাখের সামান্য কম ভোট পেয়েছেন। অর্থাৎ নৌকা মার্কার প্রার্থী ধানের শীষের প্রার্থীকে দুই লাখের বেশি ভোটে পরাজিত করেছেন। বিরাট বিজয়। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়লাভের পর মনে করা হচ্ছিল যে, গাজীপুরেও এবার আওয়ামী লীগেরই জয় হবে। সময়টা এখন সরকারের, আওয়ামী লীগের, আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে শেখ হাসিনার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের উন্নতির জন্য, দেশবাসীর কল্যাণের জন্য, জীবনমান উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করছেন। নির্বাচনে দেশের মানুষ তার প্রতিদান দিচ্ছেন।

২০১৩ সালে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় এবং বিএনপির বিজয় ছিল অনেকটা অপ্রত্যাশিত। সব সিটিতে আওয়ামী লীগ হারবে- সেটা অতি আওয়ামী লীগ বিরোধীরাও ভাবেননি। তারপরও আওয়ামী লীগ পাঁচ সিটিতেই হেরেছিল। তখন সময়টা যে কোনো কারণেই হোক বিএনপির অনুক‚লে চলে গিয়েছিল। তারপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়া এবং নির্বাচন ভণ্ডল করার জন্য বিএনপি-জামায়াতের সহিংস আন্দোলন বিএনপিকে রাজনীতির ভুল পথে ঠেলে দেয়। এক বছর পর সরকার পতনের জন্য জামায়াতের কাঁধে সওয়ার হয়ে আগুন-সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়ে বিএনপি রাজনীতির মূল সড়ক থেকে ছিটকে পড়েছে। দৌড় প্রতিযোগিতায় একবার পিছিয়ে পড়লে আবার এগিয়ে যাওয়া যে সহজ কাজ নয়, এটা সবাই জানেন। বিএনপিরও তা না জানার কথা নয়। রাজনীতির প্রতিযোগিতায় বিএনপি আওয়ামী লীগের তুলনায় পিছিয়ে আছে। বিএনপির জন্য এখন সময় অনুকূল নয়। এসব যারা বুঝতে চান না, তারা মনের সুখে বিএনপি নিয়ে নানা কল্পগল্প তৈরি করছেন, কিন্তু মাঠের বাস্তবতা যে ভিন্ন সেটা খুলনার পর গাজীপুরে বোঝা গেল। আশা করা হচ্ছে, আগামী ৩০ জুলাই বরিশাল, সিলেট এবং রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও বোঝা যাবে। আওয়ামী লীগকে এসব নির্বাচনে হারানো বিএনপির পক্ষে সহজ হবে না। মানুষ নিজ নিজ সিটির উন্নয়নকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। খুলনায় বিএনপিকে জোর করে হারিয়ে দেয়ার যে অভিযোগ দলটির পক্ষ থেকে করা হয়েছিল, গাজীপুরেও সেই একই অভিযোগ করা হয়েছে। গাজীপুর সিটি নির্বাচন সম্পর্কে বিএনপির অভিযোগ হলো : অধিকাংশ কেন্দ্রেই অনিয়ম-জালজালিয়াতির ভোট হয়েছে। আগে থেকেই ব্যালটে সিল দেয়া হয়েছিল। গ্রেপ্তার-হামলা-বাধার কারণে বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা ভোট দিতে পারেননি। বিএনপির এসব অভিযোগ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভোটের অনিয়মের অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ দিতে পারেনি বিএনপি। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করতে বিএনপির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন তিনি।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হয়েছে। মানুষ দলবেঁধে উৎসবমুখর পরিবেশেই ভোট দিয়েছেন। গণমাধ্যমে কিছু কিছু অনিয়মের খবর এসেছে। কেন্দ্র দখল, জাল ভোটের ঘটনাও কিছু ঘটেছে। এগুলো ঘটেছে বলেই ৪২৫ ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ৯টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত বা বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। তবে যে মাত্রায় অনিয়মের অভিযোগ বিএনপির তরফ থেকে করা হচ্ছে সেটা ঠিক নয়। যদি সত্যি নির্বাচনটা তামাশায় পর্যবসিত হতো, তাহলে গাজীপুরবাসী নীরবে সব মেনে নিত না। খুলনার মতো ঘটনা গাজীপুরে হলে প্রতিরোধ শুরু হবে বলে বিএনপি বলছিল। গাজীপুরে কোনো প্রতিরোধ না হওয়ায় এটাই প্রমাণ হয় যে বড় মাত্রায় ভোট-অনিয়ম হয়নি। তা ছাড়া যদি ভোট ডাকাতিই হয়ে থাকে এবং বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা ভোট নিতে নাই পারেন তাহলে ধানের শীষ দুই লাখ ভোট পেল কি করে? জাল ভোট যারা দিয়েছে তারা কি বিএনপিকেও কিছু দিয়েছে?

নির্বাচন সম্পর্কে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত ২৭ জুনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ‘অধিকাংশ কেন্দ্রেই ভোট ছিল শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর। কেন্দ্রে কেন্দ্রে ছিল ভোটারের দীর্ঘ সারি। ছিল ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। নারী ভোটারের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। দিনভর ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি থাকলেও বিএনপি নেতাকর্মীদের খুব একটা দেখা যায়নি। নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো গোলযোগ কিংবা সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি’।

তাহলে বিএনপি কেন অভিযোগ করছে? কারণ বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভের জন্য অংশ নেয়নি, তাদের উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচন, সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করা, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। বিএনপির মেয়র প্রার্থী ভোটের দিন দুপুরেই ভোট স্থগিতের দাবি সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরে ঘরে ঢুকেছিলেন। তিনি বলেছিলেন : ‘প্রশাসনের সহযোগিতায় প্রকাশ্যে ব্যালট পেপারে সিল মারার পরও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকার উদ্দেশ্য হলো এ সরকারের চরিত্র উন্মোচন করা। গাজীপুরের ভোট দেখে নতুন প্রজন্ম আওয়ামী লীগের চরিত্র ভালো করে জেনেছে’।

এ বক্তব্য থেকেও এটা স্পষ্ট যে ভোটে জেতা নয়, ‘সরকারের চরিত্র উন্মোচন’ই ছিল বিএনপির উদ্দেশ্য। এক হিসেবে এটা বলা যায় যে, গাজীপুরে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দলেরই উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনে জয়লাভ। তারা জয়লাভ করেছে। বিএনপির উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনকে বিতর্কিত করা। তারা এই উদ্দেশ্য পূরণে কিছুটা সফল হয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট গাজীপুর নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপিকে নৈতিক সহযোগিতা করেছেন।

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে নতুন নির্বাচন দাবি করেছে বিএনপি। তারা জানে তাদের এই দাবি পূরণ হবে না। কোনো দাবি আদায় করতে হলে যে চাপ সরকারের ওপর সৃষ্টি করতে হয় তা করার ক্ষমতা বিএনপির নেই। ঢাকায় বসে বিএনপি নেতারা গাজীপুর নির্বাচন বাতিল দাবি করছেন, গাজীপুরের নেতারা কি করছেন? নির্বাচনের আগে প্রতিরোধের ‘আওয়াজ’ দিয়ে হাসান সরকার নির্বাচনের পর চুপসে গেলেন কেন? গ্রেপ্তার-নির্যাতনের ভয়ে? গাজীপুরে ভোটার ১১ লাখের বেশি। এর মধ্যে বিএনপির ভোটার যদি দুই লাখও ধরা হয়, তাহলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তার হয়েছেন কতজন? শ’খানেকের বেশি নয়। শতকরা কতজন হলো? এ সামান্য ধাক্কাই যদি বিএনপি সামলাতে না পারে তাহলে সরকারকে কথায় কথায় চ্যালেঞ্জ না জানিয়ে জনসমর্থন বাড়ানোর কাজেই কি বেশি মনোযোগ দেয়া উচিত নয়? বিএনপিকে কথায় ও কাজে এক হতে হবে। না হলে আওয়ামী লীগের মতো তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত এবং সুসংগঠিত দলকে মোকাবেলা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।

বিএনপি বলেছিল, গাজীপুর নির্বাচনের ফলাফল দেখে বরিশাল, সিলেট, রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত জানানো হবে। গাজীপুরে বিএনপি হারলো, বিএনপি বলছে তাদের হারিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো, বিএনপি বাকি তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে কেন? তাহলে কি এটাই ধরে নিতে হবে যে, গাজীপুরের নির্বাচন যতটা খারাপ তারা বলছে ততটা খারাপ আসলে হয়নি? বিএনপি এখন বলছে, বাকি তিন সিটি নির্বাচনের ফলাফল দেখে জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বিএনপি কি আশা করছে যে বাকি তিন সিটিতে তারা জয় পাবে? যদি আশা পূরণ না হয়, তাহলে কি বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না?

বিএনপি-দরদিরা মানতে চান না যে, বর্তমানে এই দলটি এক নাজুক সময় অতিক্রম করছে। দলের প্রধান দুই নেতা- খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের পক্ষে রাজনীতিতে সরাসরি বা প্রত্যক্ষ ভ‚মিকা রাখা নিয়ে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তা দূর করা যেমন দলটির জন্য দুরূহ, তেমনি এ ব্যাপারে অস্পষ্টতা রেখে মানুষের কাছে ভোট পাওয়াটাও সহজ নয়। দেশের মানুষের বিবেচনাবোধ নিয়ে সঠিক ধারণা না থাকলে একটি রাজনৈতিক দল সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মানুষ কোন বিবেচনায়, কেন আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বিএনপিকে গ্রহণ করবে সেটা যতক্ষণ তারা স্পষ্ট করতে না পারবে ততক্ষণ নির্বাচনে বিজয় তাদের অধরাই থেকে যাবে।

বিভুরঞ্জন সরকার : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App