×

মুক্তচিন্তা

বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রসঙ্গে

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০১৮, ০৮:১১ পিএম

এই দুর্গতি থেকে উদ্ধার লাভ কীভাবে সম্ভব হবে সেটাই মূল প্রশ্ন। এ প্রশ্নে উত্তর পাওয়া সহজ কাজ নয়। উদ্ধার পেতে এবং জাতি ও রাষ্ট্রকে উদ্ধার করতে কিছু দৃঢ়চিত্ত লোক যদি ঐক্যবদ্ধ হতেন, চিন্তা করতেন এবং মত প্রকাশ করতেন তাহলে তা দ্বারা নবচেতনার সূচনা হতো। আমি সন্ধান করি। আমি তাদের সঙ্গে একত্রিত হতে চাই। রাজনৈতিক সর্বজনীন কল্যাণে উন্নত নতুন প্রক্রিয়ার সূচনা চাই।

কোনো বিষয়ের জ্ঞানই সেই বিষয়ের ইতিহাসের জ্ঞান ছাড়া পর্যাপ্ত ও কার্যোপযোগী হয় না। বাংলাদেশের সমাধানযোগ্য সমস্যাবলির সমাধান যারা আন্তরিকভাবে কামনা করেন, তাদের এ ব্যাপারটি বুঝতে হবে। কোনো গুরুতর সমস্যার সমাধান করতে হলে কারণ-করণীয়-করণ ও ফলাফলের সূত্র ধরে তার প্রতিটি অংশকে এবং সমগ্রকে বোঝার চেষ্টা করতে হয়। তারপর সমাধানের লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন, কর্মসূচি ও কর্মনীতি নির্ধারণ এবং কাজ করতে হয়। চিন্তা ও কাজের ধারায় নেতৃত্ব, সংঘশক্তি ও জনসম্পৃক্তি লাগে। নেতৃত্ব ও অনুসারীদের চরিত্র উন্নত করতে হয়। গতানুগতিতে অবস্থার উন্নতি হয় না। যে রকম সরকার, রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক চিন্তা ও কার্যক্রম চলে আসছে এবং চলছে, তাতে রাষ্ট্র, জাতি ও জনজীবন এই রকমই থাকবে- ক্রমে অবস্থা আরো খারাপ হবে। উৎপাদন বাড়বে, সম্পদ বাড়বে, বৈষম্য বাড়বে, শোষণ বাড়বে, অন্যায়-অবিচার ও জুলুম-জবরদস্তি বাড়বে, দুর্নীতি বাড়বে, আইনের শাসন যেটুকু আছে তা দ্রুততর গতিতে ক্ষয় পেতে থাকবে। যারা মনে করেন, বর্তমান ধারায় রাজনীতির উন্নতি হবে, গণতন্ত্র হবে, রাষ্ট্র জাতি ও জনজীবন উন্নতির দিকে যাবে, তাদের বক্তব্য ও কাজের প্রতি আমার একটুও আস্থা নেই। দুঃখ এই যে, তারা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান- তারাই রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি রাষ্ট্রের সরকার, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলো, সিএসও ও এনজিওর বিশিষ্ট নাগরিকরা ১৯৮০-এর দশকের প্রথমদিক থেকেই ক্রমাগত বলে আসছেন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, কালো টাকা ও পেশিশক্তি থেকে নির্বাচন, ভোট কেন্দ্রে সেনাবাহিনী রাখা, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনতা দান, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ ভ‚মিকা পালন ইত্যাদি কথা ক্রমাগত উচ্চারিত হচ্ছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য অরাজনৈতিক নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে, নাগরিক কমিটির পর নাগরিক কমিটি সীমাহীন তৎপরতা চালিয়েছে, যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন করা হয়েছে, জরুরি অবস্থা হয়েছে- খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা কারারুদ্ধ থেকেছেন, মামলায় পড়েছেন; আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, ক্ষমতাচ্যুত থাকার ফলে খালেদা জিয়া মামলায় ঝুলছেন এবং কারাদণ্ডে পড়েছেন। এর আগে স্বৈরাচারী এরশাদ সাত বছর কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। এরশাদের কারাদণ্ড ভোগের সুফল কী হয়েছে? খালেদার কারাদণ্ড ভোগের সুফল কী হবে? স্বৈরাচারের অবসানের পর ১৯৯১ সাল থেকে অস্বৈরাচারী শাসকদের কালে রাষ্ট্র, জাতি ও জনজীবনের অবস্থা কি ভালো হয়েছে? অস্বৈরাচারী, অমৌলবাদী, অসাম্প্রদায়িক শক্তি কী করেছে? কী করতে চাইছে? কী করবে? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির শাসনকালে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তি কি শেষ হচ্ছে? সামনে আমাদের কী আছে? কিছু লোক ক্ষমতা ও অর্থবিত্তের দিক দিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি, মোট জাতীয় আয় বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ও গড় আয়ু বৃদ্ধির পাইকারি হিসেব দিয়ে অর্থনীতিবিদদের সৃষ্ট উন্নয়ন-উচ্ছ্বাসে প্রচুর ফাঁকিঝুঁকি আছে। সামগ্রিক বিচারে অর্থনীতিবিদদের চিন্তা খুব বেশি সীমাবদ্ধ, খুব বেশি ত্রুটিপূর্ণ, ন্যায়-অন্যায়ের বিবেচনা থেকে দূরে। একমাত্র অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন নৈতিক প্রশ্নেও মত ব্যক্ত করেন। অন্য অর্থনীতিবিদরা এবং জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল সেগুলোতে কোনো গুরুত্ব দেয় না। অমর্ত্য সেন বিশ্বব্যাংক ইত্যাদির ধারায়ই অবস্থান করছেন, চিন্তার বা কাজের ভিন্ন কোনো ধারা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন না, চিন্তাও করছেন না। যে ধারায় যে অবস্থানে থেকে তিনি লিখছেন, কাজ করছেন তাতে তিনি সাম্রাজ্যবাদীদের শো পারসন হয়ে আছেন।

যারা ভাবছেন ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন দ্বারা দেশের রাজনীতি উন্নতির দিকে চলতে আরম্ভ করবে, তারা তাদের চিন্তা ও পাণ্ডিত্য নিয়ে চলুক। কামনা করি, তাদের আশা সফল হোক। তবে তাদের আশাকে বাস্তবসম্মত ভাবতে পারি না। যেখানে কোনো দিক থেকেই অবস্থাকে উন্নত করার কোনো চিন্তা নেই, কোনো পরিকল্পনা নেই, ইচ্ছা পর্যন্ত নেই, সেখানে হঠাৎ নির্বাচন দ্বারা অবস্থার উন্নতি ঘটতে থাকবে, তাও কি হয়?

জনজীবন, জাতি, রাষ্ট্র সম্পর্কে চিন্তা করি, লিখি, মত প্রকাশ করি। খুবই সামান্য ব্যাপার। তবু এর জন্য আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করতে চান, এমন কিছু ক্ষমতাশালী ব্যক্তিকে তৎপর দেখতে পাই। কেন তাদের এই তৎপরতা আমি বুঝতে পারি না। বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্রবিরোধী- গণবিরোধী কার্যকলাপ চলছে, সমাজে পচন ধরেছে, পচন অনেক গভীরে পৌঁছে গেছে, রাজনীতির উন্নতি দরকার- এই রকম কিছু কথাই তো আমি লিখি-বলি। যারা আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করতে চান আমি তো তাদেরও মঙ্গল কামনা করি। আমি অশুভবুদ্ধির পরাজয় ও শুভবুদ্ধির বিজয় চাই। অশুভবুদ্ধির স্থায়ী পরাজয় ও শুভবুদ্ধির স্থায়ী বিজয়ের উপায় আমি সন্ধান করি। আমি পারি না। তবু আমার মনোবল ভাঙে না। বাংলাদেশে গণতন্ত্র চলছে? রাজনৈতিক উন্নতির জন্য পলিটিক্যাল সোসাইটিকে সুস্থ, স্বাভাবিক ও উন্নতিশীল করতে হবে। পলিটিক্যাল সোসাইটিতে আছে মন্ত্রিপরিষদ, সংসদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, প্রশাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনৈতিক দল। দেশি-বিদেশি বড় বড় সব শক্তি বাংলাদেশে পলিটিক্যাল সোসাইটিকে দুর্বল করার জন্য কাজ করছে। পলিটিক্যাল সোসাইটির ভেতর সুস্থ, স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনা নেই, আত্মরক্ষার চেষ্টা নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক দল কোনো গুরুত্ব পাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ হয়ে আছে শেখ হাসিনার দলে, বিএনপি হয়ে আছে খালেদা জিয়ার দলে, জাতীয় পার্টি হয়ে আছে এরশাদের দলে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি যেভাবে কাজ করছে তাতে জামায়াত কি শেষ হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক রাষ্ট্রে সরকার গঠিত হয় রাজনৈতিক দল দিয়ে। নাগরিক কমিটি, নাগরিক উদ্যোগ, নাগরিক ঐক্য ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের বিকল্প হতে পারে না। এদের ভূমিকা বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল গঠনের পরিপন্থী। বাংলাদেশে কথিত রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত আছে, কিন্তু প্রকৃত রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে শূন্যগর্ভ, অন্তঃসারশূন্য।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী। ঘুমন্ত জনসাধারণকে জাগাবার উপায় কী? মনে তো হয় যে, এ ঘুম কুম্ভকর্ণের ঘুমের চেয়েও গভীর।

যে গণতন্ত্র বাংলাদেশে চলছে তাতে সমাজের ভেতর পচন বেড়ে চলছে। কেবল আনসার, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও মিলিটারি দিয়ে, আইন-আদালত, জেলখানা, ফাঁসিকাষ্ঠ দিয়ে সামাজিক পচন বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অবক্ষয়ের কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে না। যদি বলি শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেতর দিয়ে পচিয়ে ফেলা হয়েছে, তা হলে কি ভুল বলা হবে? প্রশাসনব্যবস্থায় চলছে ঘুষ-দুর্নীতি। স্তরে স্তরে অপব্যবস্থা আছে, সুব্যবস্থা নেই। উচ্চস্তরের লোকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা ক্রমাগত বাড়ানো হচ্ছে। গোটা ব্যবস্থার মধ্যে সামঞ্জস্যের কোনো বিবেচনার পরিচয় নেই।

বিচারব্যবস্থায় ঘুষ-দুর্নীতি ও সরকারি দলের প্রভাবে বিকারপ্রাপ্ত হয়ে আছে। রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন স্বাভাবিক জনজীবনের প্রতিকূল। কোনো সামঞ্জস্য না রেখে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও সেনাপতিদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা কেবল বাড়ানো হচ্ছে।

ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বীভৎস সব ঘটনা ঘটে চলছে। পরিবার ক্ষয়িষ্ণু- পরকীয় পরিণতিতে খুন-খারাবি বাড়ছে। বিবাহ বিচ্ছেদ অনেক বেড়ে গেছে। নর-নারী সম্পর্ক কোনো স্বাভাবিক রূপ লাভ করছে না। অসামাজিক কার্যকলাপ অনেক বেড়েছে। শেয়ার মার্কেট ও ব্যাংকগুলো চরম দুর্গতির মধ্যে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে পর্যন্ত বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে।

ব্যবসা-বাণিজ্যের জগৎ স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। চাঁদাবাজি অনেক বেড়েছে। দেশব্যাপী সাধারণ মানুষ নির্জীব, নিঃস্পৃহ, নিরাপত্তাহীন। মাদকের প্রসার ঘটেছে। সরকার মাদকের প্রসার যতটা বলে প্রচার করছে, আসলেই কি এতটা ঘটেছে। বন্দুকযুদ্ধে গত এক মাসে অন্তত দেড়শ জনের প্রাণ গেছে। বন্দুকযুদ্ধে গত তিন মাসের মধ্যে আরো অন্তত ৫০ জনের প্রাণ সংহার করা হয়েছে। খবরে প্রকাশ- ২০০৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ক্লিনহার্ট অপারেশন, এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদির নামে এ পর্যন্ত বিনাবিচারে দুই হাজার দুইশ পঁচিশ জনের প্রাণ সংহার করা হয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের ভ‚মিকা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ইত্যাদি রাজনৈতিক ধারায় আছেন। আওয়ামী ধারার বাইরে অন্য ধারাগুলো সব দিক দিয়েই নিতান্ত দুর্বল। তবে রাজনৈতিক ধারাসমূহের তাদের সংযোগ এনজিও ও সিএসওর সঙ্গে। স্বাধীন চিন্তাশীলতা বলে তাদের কিছু নেই। অনেকেই আত্মবিক্রীত- নিতান্ত টাকার দাস।

বাংলাদেশে যে গণতন্ত্র এখন চলছে, তা সমাজের ভেতরকার পচনের জন্য মূলত দায়ী। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই।

এই দুর্গতি থেকে উদ্ধার লাভ কীভাবে সম্ভব হবে সেটাই মূল প্রশ্ন। এ প্রশ্নে উত্তর পাওয়া সহজ কাজ নয়। উদ্ধার পেতে এবং জাতি ও রাষ্ট্রকে উদ্ধার করতে কিছু দৃঢ়চিত্ত লোক যদি ঐক্যবদ্ধ হতেন, চিন্তা করতেন এবং মত প্রকাশ করতেন তাহলে তা দ্বারা নবচেতনার সূচনা হতো। কিন্তু সে রকম যোগ্য দৃঢ়চিত্ত পাঁচ-দশজন লোক বাংলাদেশে কোথায়। আমি সন্ধান করি। আমি তাদের সঙ্গে একত্রিত হতে চাই। রাজনৈতিক সর্বজনীন কল্যাণে উন্নত নতুন প্রক্রিয়ার সূচনা চাই।

আবুল কাসেম ফজলুল হক : বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App