×

মুক্তচিন্তা

আয়না ভেঙে লাভ নেই, আয়নাই জাতির দর্পণ

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০১৮, ০৭:৪৭ পিএম

আমরা মিডিয়ার কাছে যেমন দায়িত্বশীল আচরণ আশা করি তেমনি চাই অকারণে কাউকে যেন টার্গেট করা না হয়। এখন সময় যদি হয়তো সামনে যাওয়ার সবাইকে বলার সুযোগ দিতে হবে। দেশ এগুচ্ছে সমাজ এগুচ্ছে আর মানুষ কেন পিছিয়ে থাকবে? মিডিয়ার ভালোমন্দ বোঝার শক্তি আমজনতার ভালোই আছে। তাদের বিশ্বাস ও রুচির ওপর আস্থা রাখা দরকার।

সংবাদপত্র বা মিডিয়া খোলা-বন্ধ নিয়ে একটা গল্প মনে পড়ছে। প্রয়াত অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন বাংলাদেশের বর্ষীয়ান সম্পাদক। তার সম্পাদিত চাটগাঁর দৈনিক আজাদীর জনপ্রিয়তা ঢাকার যে কোনো কাগজকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে। সকালবেলা টেকনাফ থেকে সীতাকুণ্ড অবধি এর জনপ্রিয়তা চোখে পড়ার মতো। এই কাগজটিও এক সময় অকারণে রোষানলের শিকার হয়েছিল।

বয়স ও মর্যাদায় দুস্তর ব্যবধান এবং পিছিয়ে থাকার পরও প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল আমার। মূলত স্নেহ ও শ্রদ্ধায় এক মধুর সম্পর্ক। গল্পটি তার কাছ থেকে শোনা। তখন তিনি সবেমাত্র বাকশালের গভর্নর পদে মনোনীত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বঙ্গভবনে সময় কাটিয়ে দায়িত্ব বুঝে নিয়ে নিজের রুমে ফিরে জানলেন সরকার কয়েকটি পত্রিকা ছাড়া বাকিগুলোর প্রকাশনা স্থগিত করেছে এবং সে বাতিলের তালিকায় আছে তার সম্পাদিত দৈনিক আজাদী। অধ্যাপক সাহেবের তো চোখ কপালে। এতটা সময় কাটালেন গণভবনে বঙ্গভবনে এত ছোটাছুটি বাকশালের গভর্নরের পদ বুঝে নেয়া আর তিনিই জানতে পারলেন না এই খবর। তথ্যমন্ত্রী তাহের ঠাকুর নিরুত্তর। জানলেও মুখ খোলে না।

পড়িমরি করে আবার ছুটলেন, যেভাবেই হোক দেখা করলেন তার নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুও শুনে অবাক! তাকে বলেছিলেন, বলিস কি? তোর পত্রিকাও বন্ধ করে দিছে? দাঁড়া আমি দেখছি। বলাবাহুল্য এরপর মুক্তি পেয়েছিল চট্টগ্রামের গৌরব দৈনিক আজাদী।

দেশের জনপ্রিয়তম অনলাইন পোর্টাল বিডিনিউজ২৪ ডটকমের বন্ধ হওয়ার খবর দেখে এ ঘটনাটি মনে পড়ছিল। এখনো সেই বাস্তবতা। সরকারপ্রধান বা শীর্ষের অনেকেই জানেন না কি হচ্ছে কেন হচ্ছে? যদি জানতেনই বিডিনিউজ২৪ ডটকমের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞার পর তা আবার তুলে নেয়া হতো না এই অনলাইন পোর্টালের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। নিয়মিত একজন লেখক হিসেবে আমি এর পাঠকপ্রিয়তা এবং রুষ্ট মানুষের আচরণ দুই-ই টের পাই। তাই সহজেই বুঝতে পারি কেন তা হতে চলেছিল। প্রকাশনা শিল্প যে কোনো জাতির দর্পণ। এ কথা বলি না সবাই সে নিয়ম বা আইন মেনে চলেন। সমস্যা হলো আমাদের দেশে কোনো কিছুই নিয়মে চলে না। একটা সময় ছিল যখন একনায়কদের শাসনে দেশে কিছু বলাই যেত না। এরশাদ আমলে সে সমস্যা প্রকটতর হওয়ায় আমরা সবাই কমবেশি ভুগেছি। একটি মাত্র রাষ্ট্রীয় টিভি আর রেডিও দিনমান তার প্রশংসা আর গুণগানে এমন হাল করেছিল মানুষ বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। এরশাদ যাওয়ার পর আমরা ধরে নিলাম গণতন্ত্র এসে গেছে ফলে স্বাধীনভাবেই মন খুলে কথা বলা যাবে। যাওয়া শুরু হলো বটে তবে সত্যিকার স্বাধীনভাবে বলা গেল না। তারপরও বাধা পেরিয়ে ধীরে ধীরে মাথা তুলল দেশের মিডিয়া। এখন তো এমন কয়টা চ্যানেল আর কয়টা প্রিন্ট মিডিয়া তা জানাও মুশকিল। মিডিয়ার এই রমরমা সময়েও আসলে কি আমরা স্বাধীনভাবে সব বলতে পারি? না পারা যায়?

সরকারকে দোষারোপ করার আগে আমার দেশের কথা ভাবুন। সরকার বিরোধিতার নামে দেশ ও ইতিহাসের বিরোধিতা, ধর্মের নামে উত্তেজনার নামে দেশের বারোটা বাজিয়ে জাতিকে শেষ করার চক্রান্ত বা প্রচার কি মিডিয়ার কাজ? তাই এই জাতীয় মিডিয়া বন্ধ করে দেয়াটাই ছিল যৌক্তিক। আবার এখন দেখছি সুযোপ পেলেই সরকার বিরোধিতার নামে দেশ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রচারণা। ইতিহাস ও অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যারা মিডিয়াকে ব্যবহার করে দেশ ও সমাজের শান্তি নষ্ট করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়াই যৌক্তিক।

কিন্তু বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন পোর্টাল বিডিনিউজ২৪ ডটকম কেন সে খপ্পরে পড়ল? আবার বাধানিষেধ উঠেও গেল। এর কারণ কি আমরা জানতে পারব? এ কারণেই আমাদের মনে হচ্ছে কোথায় কি হচ্ছে কেন হচ্ছে কারা করছে কেন করছে সেটা আসলে পরিষ্কার না। আমাদের সমাজে ঘোলাপানিতে মৎস্য শিকার একটা পুরনো রোগ। এই ফাঁদে পড়ে বহু প্রগতিশীল দেশদরদী মিডিয়া ও মানুষের সর্বনাশ হয়ে গেছে। আখেরে এর ফল ভোগ করতে হয় সবাইকে। বঙ্গবন্ধু আমল থেকে আজ অবধি এই প্রক্রিয়া থামেনি। কে কাকে কেন টার্গেট করছে সেটা বোঝা না গেলে সরকারের লোকসান ব্যতীত লাভ হবে না।

আমরা মিডিয়ার কাছে যেমন দায়িত্বশীল আচরণ আশা করি তেমনি চাই অকারণে কাউকে যেন টার্গেট করা না হয়। এখন সময় যদি হয়তো সামনে যাওয়ার সবাইকে বলার সুযোগ দিতে হবে। দেশ এগুচ্ছে সমাজ এগুচ্ছে আর মানুষ কেন পিছিয়ে থাকবে? মিডিয়ার ভালোমন্দ বোঝার শক্তি আমজনতার ভালোই আছে। তাদের বিশ্বাস ও রুচির ওপর আস্থা রাখা দরকার।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলা হয় গণতন্ত্রের মানসকন্যা। এটা তার অর্জন। যারা তিনি এবং তার সরকারকে বিপাকে ফেলতে চায় হয়তো এটা তাদের কাজ। স্বাধীনভাবে যে সব মিডিয়া বিচরণ করে বা করতে পারে আখেরে তারা তাকেই শক্তি জোগায়। কারণ আওয়ামী লীগের আসলে হারানোর কি আছে? ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ অতীত তাদের শক্তি। যেটুকু ঝামেলা নেতা বা মন্ত্রী মিনিস্টারদের নিয়ে। সেটা তো প্রধানমন্ত্রী জানেন এবং বলেনও। ফলে তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা জাতির চাওয়া স্বচ্ছ ও স্বাভাবিক মিডিয়া বিকাশ। মনে পড়ে বিএনপি ও জামায়াত জোটের আমলে মিডিয়াকে বারবার স্তব্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল। তাতে তাদের কোনো লাভ হয়নি। আমাদের মানুষজন যা জানুক আর না জানুক সচেতনতায় সবসময় এগিয়ে। এই যে বিশ্বকাপ এমন অনেক দেশ আছে যারা মূল পর্বে খেলছে অথচ তাদের জনগণের কোনো খবর নেই। এমনকি সিডনিতেও। অস্ট্রেলিয়ার এত ভালো খেলার পরও ক’জন মানুষ দেখছে? পাবে হোটেলে জড়ো হওয়া কিছু মানুষ ছাড়া সব সুনসান। আর আমরা? রাত জেগে গাঁটের টাকায় পতাকা বানিয়ে আরেক দেশের জন্য জানবাজি রাখা জাতি। এটা কেবল উন্মাদনা না। এতে সচেতনতার গন্ধও আছে বৈকি।

তাই বারবার বলি সরকারের উন্নয়ন দেশের অগ্রগতি বা জাতির সামনে যাওয়া রুখে দেয়ার অপশক্তি ছাড়া কাউকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরং মিডিয়া বা জানালা বন্ধ হলে নিজেদের ঘরই আঁধারে ঢেকে যাবে। তখন কে দুশমন কে বন্ধু খুঁজে বের করা হবে কঠিন কাজ। মুখ দেখার আয়না হারিয়ে গেলে মানুষ বা জাতি তার নিজের চেহারাও ঠিকভাবে দেখতে পায় না। ত্রুটি ধরা পড়লে সেটা সারিয়ে না নিয়ে আয়না ভেঙে লাভ নেই। এটাই মনে রাখা দরকার।

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App