×

অর্থনীতি

আমানতে সুদহার কমালে তারল্য সংকট বাড়বে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ জুন ২০১৮, ০২:২১ পিএম

আমানতে সুদহার কমালে তারল্য সংকট বাড়বে
বেসরকারি ব্যাংকগুলো বর্তমানে আমানত সংগ্রহ করছে ৮ থেকে ১১ শতাংশ সুদে। আগামী ১ জুলাই থেকে ব্যাংক আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার নির্দেশনা দিয়েছে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবি। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আমানতের এই সুদহার কমে আসার ফলে সঞ্চয়বিমুখ হবেন সাধারণ মানুষ। বিনিয়োগ বাড়বে শেয়ারবাজারে। আমানতের অর্থের বড় অংশই প্রতারণামূলক কোম্পানির ফাঁদে যাবে। বেশি মুনাফা দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করবে মাল্টিপারপাস কোম্পানি, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের নামে গ্রাম-গঞ্জে গড়ে ওঠা সমিতি ও এনজিও। আর একটা অংশ বিদেশে পাচার হবে। তারল্য সংকট বাড়বে ব্যাংক খাতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমানতের সুদহার না কমিয়ে পরিচালন দক্ষতা বাড়িয়ে এবং খেলাপিঋণ কমানোর মাধ্যমে ঋণের সুদহার কমানোর চেষ্টা করতে হবে। তাদের মতে, ব্যাংকের বেশিরভাগ আমানত আসে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীর কাছ থেকেই। তাদের সুদ কমলে তারা নিরুৎসাহিত হবে এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে ব্যাংকের আমানতের সুদের হার কমায় অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে সঞ্চয়পত্র বা পোস্টাল সেভিংস স্কিমে বিনিয়োগ করতে পারেন বলেও মনে করছেন অনেকে। জানা গেছে, আগামী ১ জুলাই থেকে ৯ শতাংশের বেশি সুদ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স (বিএবি)। পাশাপাশি ১ জুলাই থেকে সরকারি রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজেটে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদার। এদিকে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানো এবং ব্যাংকগুলোর স্বার্থে প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে করপোরেট কর ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার (সিআরআর) ১ শতাংশ কমানো এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকা ও এক পরিবারের ৪ জনকে ব্যাংকের পর্ষদে থাকার সুযোগ দেয় সরকার। এত সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরও সুদের হার না কমায় বিভিন্ন মহলে তীব্র সমালোচনা ছিল। আর এর আগে গত এপ্রিলে এক মাসের মধ্যে সুদের হার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন ব্যাংকমালিকরা। এদিকে ঋণের সুদহার যেভাবে কমছে, তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ গতিতে কমছে আমানতের সুদহার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ছয় বছরের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১২ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমছে ব্যাংক আমানতের সুদহার। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে আমানতের সুদহার ছিল আট দশমিক ৪০ শতাংশ; ২০১৩ সালে তা সামান্য বেড়ে আট দশমিক পাঁচ শতাংশ হলেও ২০১৪ সালের একই সময়ে আমানতের সুদহার নেমে সাত দশমিক ৪৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১৫ সালে ব্যাংক আমানতের সুদহার আরো কমে ছয় দশমিক ৬৬ শতাংশ হয়। ২০১৬ সালে এই সুদহার পাঁচ শতাংশে নেমে আসে, সেপ্টেম্বরে যা দাঁড়ায় পাঁচ দশমিক ৩৯ শতাংশে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে আসে আমানতের সুদহার, যা চার দশমিক ৯০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বেসরকারি ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহ করছে ৮ থেকে ১১ শতাংশ সুদে। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী আগামী ১ জুলাই থেকে ব্যাংক আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার নির্দেশনা দিয়েছে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবি। আগামী ১ জুলাই থেকে আমানতের নতুন সুদহার করবে ব্যাংকগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমানতের সুদহার কমে এলে সঞ্চয়বিমুখ হবেন সাধারণ মানুষ। বিনিয়োগ বাড়বে শেয়ারবাজারে। আমানতের অর্থের বড় অংশই প্রতারণামূলক কোম্পানির ফাঁদে যাবে। বেশি মুনাফা দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করবে মাল্টিপারপাস কোম্পানি, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের নামে গ্রাম-গঞ্জে গড়ে ওঠা সমিতি ও এনজিও। আর একটা অংশ বিদেশে পাচার হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংকের চেয়ারম্যান তমাল এস এম পারভেজ বলেন, সঞ্চয়পত্রে সুদহার বেশি, তাই অনেক ব্যবসায়ী সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন। এটি বন্ধ করতে হবে। তা না হলে ব্যাংকের সুদহার কমিয়ে লাভ হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, যদি ব্যাংকে টাকা রেখে মুনাফা কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়, তাহলে মানুষ ব্যাংকের পরিবর্তে অন্য ঝুঁকিপূর্ণ খাতে টাকা চলে যেতে পারে। এমনকি পাচারেরও আশঙ্কা রয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, একটু বেশি লাভের আশায় অনেক ভুঁঁইফোড় কোম্পানির কাছে টাকা খাটাবে। এতে সঞ্চয়ী মানুষরা সর্বস্ব খোয়াতে পারেন বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। ব্যাংক আমনতের সুদহার কমানোর এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমানতকারীরা এমনি আগ্রহ হারিয়েছে ব্যাংকের অবস্থার কারণে। ক্ষুদ্র আমানতকারীরা তাদের সামান্য অর্থের জন্য একটি নিরাপদ জায়গা চায় আর সেজন্যই তারা ব্যাংকে টাকা রাখত। এখন আমানতের সুদের হার কমানোর কারণে যাদের টাকা আছে এমন খাতে টাকা রাখবে যা কাজে লাগবে না। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমানে ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণ করছে বেসরকারি ব্যাংক মালিকরা। তার বড় প্রমাণ হচ্ছে, একটা এসোসিয়েশনের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে দেশের ব্যাংক সুদের হার নির্ধারণ। বিষয়টা বাজার অর্থনীতির পরিপন্থী। তিনি বলেন, ঋণের সুদ কমাতে গিয়ে যে জোর করে আমানতের সুদ কমানো হচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমাতে হলে আমানতের সুদ হার কমাতে হবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে ঋণের সুদহার কমানোর বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ব্যাংক মালিকদের মধ্যে একটি চক্র আছে, যারা বিভিন্ন অজুহাতে সুদের হার ৯ থেকে ১১ শতাংশে নিয়ে যেতে পারে। আবার প্রকাশ্য-লুক্কায়িত সেবা মাশুলের নামেও টাকা কেটে নেয়ার চেষ্টা চালায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে কঠোরভাবে এগুলো তদারকি করা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App