×

জাতীয়

বিচারের অপেক্ষায় মাদকের হাজার হাজার মামলা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ জুন ২০১৮, ১২:৩৭ পিএম

বিচারের অপেক্ষায় মাদকের হাজার হাজার মামলা
দেশে গত এক মাসের মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানে নিহতের সংখ্যা প্রায় ১৫০ ছাড়িয়েছে। একই অভিযোগে আটক হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত না করে আইন-বহিভূত হত্যার পথ বেছে নেয়ায় ব্যাপক সমালোচনাও হচ্ছে। তবে সমাজ থেকে মাদক নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত রাখার পক্ষে অবিচল সরকার। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, মাদকবিরোধী আইন থাকা সত্তে্বও সারা দেশের আদালতগুলোয় হাজার হাজার মামলা বছরের পর বছর ঝুলে রয়েছে কেন? এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, একাধিক সমন জারি করেও সাক্ষী হাজির করতে না পারা, তদন্ত কর্মকর্তার অনীহা, সরকারি কৌঁসুলীদের গাফিলতি ও জামিন নিয়ে আসামির পলায়নসহ দফায় দফায় রাষ্ট্রপক্ষের সময় আবেদন, এভাবেই একটা সময় এসব মামলা হিমাগারে চলে যায়। আর বিচার বিলম্বের সুযোগ কাজে লাগিয়ে আসামিরা জামিন নিয়ে পুনরায় অপরাধ সাম্রাজ্যে বিচরণ করে।  জানা গেছে, ঢাকা মহানগরের ৪৪টি আদালতে বিচারের জন্য অপেক্ষমাণ প্রায় ৫০ হাজার মামলা। এর মধ্যে সাক্ষীর অভাবে ২৫ হাজার মাদকের মামলার বিচার ৫ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলছে। সূত্র বলছে, ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মহানগর আদালতগুলোয় বিচারাধীন ৮০ হাজার ৬৬০টি ফৌজদারি মামলার মধ্যে ৪৮ হাজার ১৯৬টি মামলাই মাদকের। ৫-১০ বছরের মধ্যে বিচারাধীন মাদকের মামলার সংখ্যা ১৫ হাজার ৮১৩টি। ১০ বছর কিংবা তার বেশি সময় আদালতে ঝুলছে এমন মামলার সংখ্যা ৯ হাজার ৪৩২টি। এমনকি এক বছরে (২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি) বিচারের জন্য আসা মোট ফৌজদারি মামলার ৮১ শতাংশই মাদকের। এক বছরে ৮ হাজার ১৮১টি ফৌজদারি মামলার মধ্যে মাদকের মামলা ৬ হাজার ৬৮০টি। বিচারাধীন মাদকের মামলাগুলোর মধ্যে ২৪ বছরের পুরনো মামলাও রয়েছে! সাক্ষী হাজির করতে না পারায় এ বিলম্ব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যায় না এবং অনেক সময় আদালতকে জানানোও হয় না। ফৌজদারি আইনের ১৭১(২) উপধারায় বলা আছে, সাক্ষী হাজির করা পুলিশের কাজ। সাক্ষীদের আদালতে হাজির না করার পেছনে আসামিদের ভ‚মিকা থাকার অভিযোগও রয়েছে। বিচার প্রলম্বিত হলে এর সুবিধা পায় আসামিপক্ষই। এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, অধিদপ্তর গত বছর মাদক আইনে মামলা করেছে ১১ হাজার ৬১২টি। মার্চ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৩ হাজার ২৮৯টি। এর মধ্যে ২ হাজার ৫৪৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ১৬ মামলায় আসামিদের সাজাও হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ, র‌্যাবসহ অন্য সব সংস্থা মিলে মাদক আইনে মামলা করেছে ১ লাখ ৬ হাজার ৫৪৬টি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাদকবিরোধী আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে। যাদের মাদকের গডফাদার বলা হয়, তাদের আইনে সোপর্দের ব্যবস্থা বর্তমান আইনে নেই। বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, মূলত সরকারি কৌঁসুলি ও পুলিশের ব্যর্থতায় মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। পৃথিবীর সব দেশে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীরা ক্যাডারভুক্ত হন। আমাদের দেশে ল’ ক্যাডার সার্ভিস আজও চালু হয়নি। এটা হলে একদিকে যেমন জবাবদিহিতা থাকে, অপরদিকে দক্ষতা-যোগ্যতাও থাকে। আমাদের দেশে পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ হয় রাজনৈতিক ও সাময়িকভাবে। সরকার বদল হলে তারাও বদলায়। ফলে পেশাগত দক্ষতা-যোগ্যতার দিকে তারা মনোযোগী নন। সামগ্রিক সিস্টেমে পরিবর্তন আনতে হবে। আদালতে সাক্ষী হাজির ও জব্দ বস্তু প্রদর্শন করাও পুলিশের দায়িত্ব। ভাসমানদের সাক্ষী করায় তাদের অনেক সময় খুঁজেও পায় না পুলিশ। ২০টি মাদক মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ওই সব মামলায় সাক্ষী হিসেবে ৪০ জন পুলিশ সদস্য ও অর্ধশতাধিক জব্দ তালিকার সাক্ষীকে খুঁজে না পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। চার্জশিটে উল্লেখিত সাক্ষীদের স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানায় প্রথমে সমন পাঠানো হয়েছে এবং পরে তাদের বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। তার পরও তাদের আদালতে হাজির করা যায়নি। ফলে ওই সব মামলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলে শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। এসব দুর্বলতার ফলে আসামিদের একটি অংশ জামিনে বের হয়ে পুরনো অপরাধে জড়াচ্ছেন। আরেকটি অংশ বিনা বিচারে বছরের পর বছর জেলে থাকছে। ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী নজিবুল্লাহ হিরু বলেন, সাধারণত মাদক মামলায় পুলিশ চার্জশিটে ভাসমান লোকদের সাক্ষী করে। ফলে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেকে আছেন যারা পরে সাক্ষ্য দিতে চান না। পুলিশের খামখেয়ালিও আছে। থানা-পুলিশ সমনে আগ্রহী না হয়ে ওয়ারেন্ট নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। ‘ম্যানেজ’ করে সাক্ষীদের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করার অভিযোগও আছে। তিনি বলেন, মামলা ঝুলে থাকার সব দায় পুলিশের নয়। একটি নির্দিষ্ট সময় পর সাক্ষী না এলে মামলা নিষ্পত্তির ক্ষমতা বিচারককে দেয়া আছে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, অনেক সময় সাক্ষীরা প্রভাবিত হয়ে আদালতে উল্টো সাক্ষী দেন। মাদক মামলায় জব্দ তালিকার সাক্ষী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের হাজির করতে পারছে না পুলিশ। নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর দেয়া থাকলেও অনেক সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। এর সুবিধা নেয় আসামিপক্ষ। তিনি বলেন, সাক্ষী হাজিরের দায়িত্ব পুলিশের। আর মামলার চার্জশিটও দেয় পুলিশ। তারাই নাম-ঠিকানা যাচাই-বাছাই করে চার্জশিটে সাক্ষীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে। আবার সাক্ষী হাজিরের সময় হলে পুলিশই তাদের দেয়া ঠিকানায় সাক্ষী খুঁজে পায় না। সব ক্ষেত্রে এটি মেনে নেয়া যায় না। চলতি বছরের শুরুতে মাদক মামলায় সাক্ষ্য দেয়ার ব্যাপারে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অনীহা থাকার অভিযোগ করে তাদের সতর্ক করেছেন নাটোরের জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ মো. রেজাউল করিম। জেলা পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি কনফারেন্স অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ বিচারক মাদক মামলায় সাক্ষ্য দেয়ার ব্যাপারে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অনীহার অভিযোগ তুলে বলেন, গত দেড় বছর ধরে আমি নাটোরে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। সাক্ষীর অভাবে এ সময়ের মধ্যে মাদকের একটি মামলাও নিষ্পত্তি করতে পারিনি। প্রায় মামলাতে বাদী সাক্ষ্য দিয়ে যাওয়ার পর অন্য সাক্ষীরা আদালতে আসছেন না। বিশেষ করে তদন্তকারী কর্মকর্তারা অনুপস্থিত থাকছেন। এ ব্যাপারে তিনি কনফারেন্সে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তা ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালককে সতর্ক হওয়ার আহবান জানান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App