×

মুক্তচিন্তা

আর্থিক খাতে সুশাসন নয় কেন?

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ২১ জুন ২০১৮, ০৯:৩৩ পিএম

মন্ত্রণালয় কোনো কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে গণনাতেই আনে না অথচ বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ। আবার কোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠালেও তা তেমন গুরুত্ব পায় না। এমতাবস্থায় স্বায়ত্তশাসন, সুশাসন কিংবা শৃঙ্খলা উন্নয়ন খুবই জরুরি বলে প্রতীয়মান হয়। আশা করা হয় এই বিষয়গুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে এবং দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

সাম্প্রতিককালে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রণীত বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২-তে এটিকে একটি স্বতন্ত্র স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে দেশের সার্বিক আর্থিক উন্নয়নের স্বার্থে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে পরিচালিত নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ কি এ কথাটি সুধীমহলে বহুল আলোচিত। প্রথাগতভাবে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক খাতের অভিভাবক, ব্যাংকের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল, সরকারের আর্থিক সম্পদের রক্ষক, পরামর্শক এবং আর্থিক সম্পদ উন্নয়নের কাজে পথিকৃৎ। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের মতে বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুটি মূল কাজ : (১) বছরে দুবার মুদ্রানীতি প্রণয়ন; (২) সংস্থা হিসেবে তফসিলি ব্যাংকের কাজের পরিদর্শন, তদারকি ও পরিবেশ মূল্যায়ন। প্রথমটির মুখ্য উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা যাতে সঠিক সময়ে সঠিক মুদ্রা সঠিক হাতে পৌঁছে দেয়া যায়। এর দুটি হাতিয়ার আছে যেমন (১) পরিমাণগত যার মধ্যে আছে ব্যাংক রেইট পলিসি, খোলাবাজার অপারেশন, সিআরআর ও এসএলআর এবং অন্যটি হলো গুণগত : যেমন রেশনিং, নৈতিকভাবে প্ররোচিত করা, প্রচারণা ও মিটিং করা।

দেশের প্রচলিত নিয়মানুসারে তফসিলি ব্যাংকগুলো তাদের আমানতের একটি অংশ সিআরআর হিসেবে ৬.৫ শতাংশ ও এসএলআর হিসেবে ১৩ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত রাখতে হয় যার উদ্দেশ্য বাজারে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ। এই দুটি হার কমবেশি করা হয় অর্থনীতির সার্বিক বিবেচনায়। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত তাদের স্ব-স্ব পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে তাদের সার্বিক সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করে যা সব দেশের একই নীতি। সম্প্রতি সিআরআর ১ শতাংশ কমানো হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো প্রকার বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াই বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) দাবির মুখে। আরো বলা হয়েছে ‘আগে বাস্তবায়ন তারপর বিশ্লেষণ’। বিষয়টি এমনো হতে পারত বিএবি সদস্যরা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ করতে পারত এবং এই আলাপের ফলাফল কেন্দ্রীয় বাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠাতে পারত। কিন্তু বিষয়টি উল্টো হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। এভাবে যদি ক্ষমতার বলয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে উপেক্ষা করে মুদ্রানীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয় তাহলে দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাখার যৌক্তিকতা কী? আর্থিক খাতের গবেষকরা বলছেন, আমানতকারীদের স্বার্থেই সিআরআর/এসএলআর ২০-২২ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা হয় কারণ ব্যাংকের মোট আমানতের ৯০ শতাংশই তাদের ও বাকি ১০ শতাংশ মালিকপক্ষ বিএবির সদস্যদের। এ ঘটনাটিতে সংখ্যালঘু ব্যাংক মালিকদের স্বার্থ রক্ষা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ আমানতকারীদের নয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে বাজারে ১০ হাজার কোটি টাকা চলে এসেছে যা ব্যাংকগুলোর বর্তমান মূলধন সংকটে বিমোচনে ব্যবহৃত হবে।

এখন প্রশ্ন উঠেছে ব্যাংক মূলধন সংকটের কারণ কি? বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, (১). খেলাপি ঋণ বর্তমানে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১২ শতাংশ যাকে বলা হয় মহাবিপদ সংকেত; (২). এডভান্স ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিধায় সেখানে ব্যাংকগুলোর তাদের আমানতের ৮০-৮৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করতে পারে সেখানে কিছু কিছু বেসরকারি ব্যাংক নিয়ম লঙ্ঘন করে এডিআর রেশিও ৯০ শতাংশে এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ৯২ শতাংশ উন্নীত করেছে। এ দুটি হলো তারল্য সংকটের মূল কারণ। এর ফলে ব্যাংকগুলোয় বিনিয়োগ করতে তার অপারগতা প্রকাশ করছে উদ্যোক্তাদের। এর জন্য দায়ী ভ্রান্ত রাজনীতি, সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য লোক নিয়োগ, ঋণখেলাপিদের পৃষ্ঠপোষকতা করা অব্যাহত রাখা এবং ব্যাংক জালিয়াতিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়া।

অবস্থাটা এ রকম যে সরকার-ব্যাংক মালিক-নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি এক হয়ে যায় তা হলে অর্থনীতির জন্য এর চেয়ে বড় বিপদ আর কী হতে পারে। বিএবি অর্থমন্ত্রীর কাছে আরো একটি দাবি করছেন যা বাস্তবায়ন হলে তা হবে আরো একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তা হলো সরকারি ফান্ডের অর্ধেক বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখতে হবে। এরই মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেড এবং এনআরবি লিমিটেড ভীষণভাবে তারল্য সংকটের কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে, শীর্ষ পর্যায়ে নীতিনির্ধারকদের অব্যাহতি দেয়া হয়েছে সত্যি কিন্তু অগণিত আমানতকারীর জমা রাখা অর্থের কি হবে? সরকারি খাতের জলবায়ু তহবিলের ৫০০ কোটি টাকার ফান্ড যা ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেডে জমা ছিল তার কী হবে? এনআরবি ব্যাংকে জমাকৃত আড়াইশ কোটি টাকা সরকারি ফান্ডের কী হবে? এই অবস্থায় যদি বিএবির দাবি সরকার মেনে নেয় তা হলে আর্থিক খাতের বিপর্যয় আর ঠেকানো যাবে না।

কোনোভাবেই আর্থিক খাতে দ্বৈতশাসন থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব হয়ে যায় এবং এর জন্য সরকারের ব্যাংকিং ও আর্থিক বিভাগকে দায়ী করা হয় যারা সব সময়ই রাজনৈতিক বিবেচনায় বৃহদাকার ঋণ পুনর্গঠন, নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স অনুমোদন, ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে পরিবারতন্ত্র কায়েম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রভাবিত করে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সরকারের মুখোমুখি হতে দেখা যায় যা দেশের উন্নয়নের জন্য অশুভ সংকেত। কিন্তু কেন এমন হয় এটা কী বাংলাদেশ ব্যাংকের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণ নাকি ব্যাংকিং খাত নিয়ে সরকারের রাজনৈতিক খেলা। প্রায়শই বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এই বলে যে এই ব্যাংকটির গভর্নর তার কাজের জন্য কোন সংস্থার কাছে দায়বদ্ধ- অর্থ মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, নাকি জাতীয় সংসদ সচিবলায়।

এই প্রশ্নটি কোনো একটি জাতীয় সেমিনারে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে করেছিলাম কিন্তু উত্তর পাইনি। অথচ ভারতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর তার কাজের জন্য ভারতীয় লোকসভার কাছে দায়বদ্ধ বিধায় সেই দেশটির সরকার তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ব্যাংকের ওপর চাপাতে সাহস পায় না যেটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অহরহ ঘটে চলছে। এখন এ থেকে পরিক্রমণের উপায় নিয়ে ভাবতে হবে। বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায়শই অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে মতানৈক্যে জড়িত হয় যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিষয়টি এমন যে মন্ত্রণালয় কোনো কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে গণনাতেই আনে না অথচ বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ। আবার কোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠালেও তা তেমন গুরুত্ব পায় না। এতে করে অনেক সিদ্ধান্ত চলে আসছে যেমন নতুন ব্যাংক খোলার লাইসেন্স, বড় বড় ঋণ অবলোকন/ মওকুফ, সঞ্চিতি বাড়ানো-কমানো যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক করতে বাধ্য হচ্ছে যদিও সেগুলো দেশের সার্বিক আর্থিক উন্নয়নের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এমতাবস্থায় স্বায়ত্তশাসন, সুশাসন কিংবা শৃঙ্খলা উন্নয়ন খুবই জরুরি বলে প্রতীয়মান হয়। আশা করা হয় এই বিষয়গুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে এবং দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভ‚মিকা রাখবে।

মিহির কুমার রায় : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন সিটি ইউনিভার্সিটি ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App