×

মুক্তচিন্তা

পাহাড় কাটা বন্ধে আলাদা সেল গঠন জরুরি

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১৮ জুন ২০১৮, ১০:১৪ পিএম

প্রভাবশালী মহলের পাহাড় কাটার মতো আইনবিরুদ্ধ কার্যক্রম বন্ধসহ পাহাড়ে অবৈধ বস্তি বানিয়ে বাণিজ্য, প্রকারান্তরে মানুষ হত্যা করার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে। ২০০৭ সালের পাহাড় ধসের ভয়াবহ ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির ৩৬টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করা জরুরি। প্রয়োজনে পাহাড় কাটা বন্ধ করতে আলাদা সেল গঠন করতে হবে।

বর্ষাকালে পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। গত ১২ জুন রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরে পাহাড় ধসে শিশুসহ ১১ জন এবং কক্সবাজারে ৩ জন পাহাড় ধসে ও গাছ চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। এ বছরেরই ২১ মে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের মিয়ানমার সীমান্তবর্তী মনজয় পাড়ায় বড়ইতলী গ্রামে পাহাড় কাটার সময় মাটি ধসে ৫ জন চাপা পড়লে নারীসহ ৩ শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে। গেলবারেও প্রবল বর্ষণের ফলে পাহাড় ধসে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙ্গুনিয়া, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, বান্দরবান ও সিলেটের মৌলভীবাজারে দফায় দফায় পাহাড় ধসে ১৬৫ জন মানুষ মারা যায়। আহত হয় শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। ২০০৭ সালের ভারি বর্ষণে চট্টগ্রামের হাটহাজারি, পাহাড়তলী, বায়জিদ বোস্তামী, খুলসী এলাকায় পাহাড় ধসে ১২৭ জন নিহত এবং দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়। ২০১৫ সালে পাহাড়ের মাটি ধসে পড়ে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও রামুতে নারী ও শিশুসহ ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরী এবং পাশর্^বর্তী এলাকায় পাহাড় ধসে ২০০৮ সালে ১৪ জন, ২০১১ সালে ১৭ জন, ২০১২ সালে ২৮ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। গত চার দশকে পাহাড়ি এলাকার পাহাড় ধসে ৬ শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটে এক শ্রেণির প্রভাবশালী মহল আইনকানুন উপেক্ষা করে প্রতিনিয়ত পাহাড় কেটে চলেছে। কাটা পাহাড়ের গায়ে গড়ে তোলা হচ্ছে হাজার হাজার কাঁচা, নড়বড়ে বাড়িঘর। ইতোপূর্বে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের আবাসিক হোটেল-মোটেল জোনসংলগ্ন কলাতলী সৈকতপাড়ায় একটি সরকারি উঁচু পাহাড় কেটে বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। শহরের লাইট হাউস পাহাড়, আদর্শ গ্রাম, পাহাড়তলী, জাদিরাম পাহাড় এবং হিলটপ সার্কিট হাউস পাহাড় কেটেও অসংখ্য ঘরবাড়ি তোলা হয়েছে। বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, শহরের প্রায় সাতশ একরে ছোট-বড় ১২টি পাহাড়ে বর্তমানে ২০ হাজারের বেশি বাড়িঘর রয়েছে এবং অবৈধ সেখানে কমপক্ষে আড়াই লাখ মানুষ বাস করছে। নাসিরাবাদ এলাকা থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত ৭-৮ কিলোমিটার এলাকা পাহাড়শূন্য হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এবং ষোলশহর এলাকার ১৫০ একর পাহাড়ের জমি কেটে নির্মিত হয়েছে আধুনিক ভবন। শহরের শান্তিনগর পাহাড় এলাকায় ৫শ একর জমি কেটে নির্মাণ করা হয়েছে নানা ধরনের ঘরবাড়ি। সীতাকুণ্ড পাহাড় কেটে ৮৯০ একর জমিতে বস্তি ও বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছে। তথ্যমতে, গত ২০ বছরে চট্টগ্রামে ২ হাজার একরেরও বেশি ভূমির পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে।

২০১৩ সালের জরিপ অনুযায়ী, রাঙ্গামাটি শহরের ৩২ স্পটে পাহাড়ের ঢালে ৫০ হাজার মানুষ অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর নির্মাণ করে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করে আসছে। এ সব এলাকার ৫৬৮ পরিবারকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতোপূর্বে বান্দরবানে সেনা রিজিয়নের পাশেই নির্বিচারে পাহাড় কাটা হয়েছে। নিষিদ্ধ হলেও কখনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পাহাড় ও টিলা লিজ দেয়া হয়েছে। লিজ দেয়া পাহাড়ের মাটি অবৈধভাবে কেটে নেয়া হচ্ছে কেউ দেখেও দেখে না। এমনকি সরকারি কাজেও পাহাড়ের মাটি ব্যবহারের নজির রয়েছে। মাঝে মাঝে মাটিকাটা শ্রমিক বা ট্রাক্টর চালককে আটক করা হয়, কিন্তু আসল অপরাধী থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিগত কয়েক যুগ ধরে পাহাড় কাটার পাশাপাশি পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজিকে নির্বিচারে ধ্বংস করে সমতল ভূমিতে মুনফালোভী সিন্ডিকেট গড়ে তুলছে আবাসিক প্লট ও অভিজাত ফ্ল্যাট। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নদীভাঙন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে গৃহহারা, নিম্ন আয়ের হতদরিদ্র, ছিন্নমূল পরিবার চট্টগ্রামের পাহাড়ের ঢালে গড়ে ওঠা বস্তিতে ঠাঁই নিয়েছে।

দীর্ঘকাল ধরে পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ের গায়ের গাছপালা উজাড়ের ফলে পাহাড়ের অবশিষ্ট মাটি আলগা হয়ে যায়। বৃষ্টি হলে পাহাড়ের গা বেয়ে তীব্র বেগে নেমে আসা ঢল আলগা মাটি ধুয়ে নিয়ে নিচে নামতে থাকে। পাহাড় হয়ে পড়ে দুর্বল, জীর্ণশীর্ণ। পাহাড় কাটার ফলে ভ‚মি ধস ছাড়াও মাটির অণুজীব বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধীরে ধীরে হারাতে থাকে প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত পাহাড়ের মালিকানা ভ‚মি মন্ত্রণালয়ের। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় বনজসম্পদ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। পাহাড় এলাকায় বাড়িঘর নির্মাণের নিয়ন্ত্রণ পূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত। তাছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ বিধি ১৯৯৫-এর ১৫ ধারামতে, অবৈধভাবে পাহাড় কেটে পরিবেশ বিনষ্ট করা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং যার জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান।

পাহাড় ধস শুরু পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান থেকে বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়েও নেয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই মানুষগুলো আবার সেখানে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। বর্ষাকালে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা বস্তি উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে ছিন্নমূল মানুষগুলোকে আশ্রয়হীন করা পাহাড় ধসে মৃত্যু রোধের কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। প্রবল বর্ষণে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা দেখা দিলে পাহাড়ে বসবাসকারীদের নিরাপদে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া, তাদের আশ্রয় ও খাবার সরবরাহ একটি সাময়িক ব্যবস্থা হতে পারে। পাহাড় ধসে মাটির নিতে পড়ে থাকা মানুষগুলোকে যত শিগগির সম্ভব উদ্ধার করার আধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণও হতে পারে হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে আনার একটি আপাত ব্যবস্থা।

প্রভাবশালী মহলের পাহাড় কাটার মতো আইনবিরুদ্ধ কার্যক্রম বন্ধসহ পাহাড়ে অবৈধ বস্তি বানিয়ে বাণিজ্য, প্রকারান্তরে মানুষ হত্যা করার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে। ২০০৭ সালের পাহাড় ধসের ভয়াবহ ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির ৩৬টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করা জরুরি। প্রয়োজনে পাহাড় কাটা বন্ধ করতে আলাদা সেল গঠন করতে হবে। পাহাড় অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের শুধু উচ্ছেদ নয়, তাদের নিরাপদ পুনর্বাসন করার মাধ্যমেই পাহাড় ধসজনিত মৃত্যু প্রতিরোধের স্থায়ী সমাধান হতে পারে।

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ : লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App