×

মুক্তচিন্তা

বাজেট ও ঈদযাত্রার সাতকাহন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০১৮, ০৮:৫৬ পিএম

রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন দ্রুত দৃশ্যমান করতে হলে উন্নয়ন কাজে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি না করে বরং সম্ভব স্বল্পতম সময়ে প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নই জনগণের কাম্য। তাতে কেবল ঈদযাত্রাই নয়- দেশব্যাপী জনগণের সব সময়ের ভোগান্তি লাঘব হয়। সড়ক মহাসড়কের দীর্ঘদিনের ব্যাপক জনভোগান্তির চলমান অবস্থায় সদ্য প্রস্তাবিত বাজেটের মাধ্যমে সরকার যদি অন্তত ‘ভোটার তুষ্টির’ বাজেটও জনগণকে উপহার দিতে পারে সেটাই বা বেশি খারাপ হবে কেন? ব্যাপক জনতুষ্টি অর্জন সম্ভব হবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওপর উন্নয়ন কাজে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি আরো সক্রিয় করার মধ্য দিয়েও।

কাল-অকালের কাহনকথা

গত ৭ জুন মহান জাতীয় সংসদে মাননীয় অর্থমন্ত্রী কর্তৃক ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য বিশাল অঙ্কের বাজেট প্রস্তাব ঘোষিত হয়েছে। প্রস্তাবিত এই বাজেট নিয়ে দেশব্যাপী চলছে নানামুখী আলোচনা, তির্যক সমালোচনাও হচ্ছে বিস্তর। কেউ কেউ সমালোচনা করে বলছেন বাজেটে কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই, কেউ কেউ বলছেন এবার প্রস্তাব করা হয়েছে উচ্চবিত্তের তুষ্টি ও নিম্নবিত্তের কষ্টের বাজেট। আবার কেউ কেউ বলছেন প্রতি বছর বাইশ লাখ শিক্ষিত তরুণ চাকরির বাজারে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু এবারের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণায় সেইসব চাকরি প্রার্থীদের কর্মসংস্থানের কোনো ইঙ্গিত নেই। কেউ কেউ আবার বলছেন প্রস্তাবিত বাজেট ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ারই পরিপন্থী’। প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে এ রকমের প্রতিক্রিয়া, বক্তব্য, মন্তব্যের মধ্য দিয়ে আমাদের জীবনের আরো ক’টি দিন কাটবে সন্দেহ নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ সব প্রতিক্রিয়ার জন্ম ও প্রচার মূলত সমাজের বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর বা তাদের প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে যতটা উঠে এসেছে ঠিক ততটাই উঠে এসেছে তরুণ উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে তরুণ চাকরি প্রার্থী পর্যন্ত সব স্তরেরই প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে। আবার রাজনৈতিকভাবে এ পর্যন্ত যে সব মতামত বা প্রতিক্রিয়া আমরা দেখি তার অন্যতম হলো প্রস্তাবিত বাজেট ‘ভোটার তুষ্টির বাজেট’। কিন্তু এ কথা যদি প্রকৃত অর্থেই যথার্থ হয়ে থাকে তবে ধরে নিতে কিংবা বলতে বাধা থাকার কথা নয় যে, এবারকার প্রস্তাবিত বাজেট খুব একটা খারাপ হয়েছে। কারণ ভোটার কিংবা জনগণকে তুষ্ট করাই তো সব সময় যে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং প্রথম কর্তব্য হওয়ার কথা। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলই চাইবে জনগণের তুষ্টি। সরকারি দল বাজেটের মাধ্যমে আর বিরোধী দল বাজেটের ভেতকার অন্তঃসারশূন্যতা জনগণের সম্মুখে তুলে ধরার মাধ্যমে। হয়তোবা সে চেষ্টাই উভয় পক্ষ থেকেই সক্রিয় আছে। সুতরাং সমাজের বিভিন্ন পর্যায় উদ্ভত এবং থেকে বাজেট নিয়ে সৃষ্ট এসব প্রতিক্রিয়ার কোথাও না কোথাও সীমাবদ্ধতা আছে। বর্ণিত সীমাবদ্ধতা প্রস্তাবিত বাজেটে থাকাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। অর্থনীতি বা রাজনীতি ব্যক্তিগতভাবে আমার অধীত বিষয়ের বাইরে। কিন্তু একথা বুঝতে হলে অর্থশাস্ত্র বা রাজনৈতিক জ্ঞানের খুব একটা গভীরতা থাকতে হয় না যে, প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেরই মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে ‘জনতুষ্টি’ একটু ঘুরিয়ে বললে ভোটার তুষ্টি। আর তা একটি আদর্শ বাজেট দিয়ে হোক বা দলটির অন্যান্য আদর্শিক কর্মসূচি দিয়ে হোক। বিপদে-সম্পদে দেশের জনগণের পাশে থাকার মধ্যেই যে কোনো রাজনৈতিক দলের সার্থকতা। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতিতে এই সংস্কৃতিচর্চার অভাব খুবই প্রকট। সে দিক দিয়ে এবারের বাজেটোত্তর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিরোধী শিবির থেকে প্রাপ্ত ‘ভোটার তুষ্টির বাজেট’- এই ‘বাহাস’ যথার্থ বলে বিবেচনা করা হলে তা আওয়ামী লীগের পক্ষেই বরং বেশি সমর্থন চলে যায় সে দিকটি নিন্দুকরা ভেবেছেন কিনা তা নিয়ে আমাদের মনে সংশয় ও সন্দেহ উভয়ই জাগ্রত হয়। প্রসঙ্গত, টিকা-আকারে এ কথা বলে রাখা ভালো যে, অর্থবছরের প্রচলিত ক্যালেন্ডারের কারণে উন্নয়ন বাজেটের সব অর্থবছরের শেষ সময়ে অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমে বাস্তবায়নের জন্য অপচয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্রাতিরিক্ত! জনভোগান্তির পরিমাণও দাঁড়ায় অবর্ণনীয়! তাই অনেকে জানুয়ারি-ডিসেম্বরকে অর্থবছর হিসেবে ঘোষণার দাবি তুলেছেন। রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় রোধে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে বলেও আমরা বিশ্বাস করি।

প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনা ও সমালোচনা করতে করতেই আমরা দেখছি পবিত্র ঈদুল ফিতর সমাগত। বিশে^র সব প্রান্তের মতো বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছেও এক বড় আনন্দ উৎসবের নাম ঈদ। আর এই আনন্দ উৎসব উপভোগের জন্য শহরে বিশেষত ঢাকায় বসবাসকারী এক বিরাট সংখ্যক মানুষ সপরিবারে নাড়ির টানে গ্রামের বাড়ি ছুটে যান। শুধু ঢাকায় বসবাসকারীরাই নন- ঈদের আনন্দকে সামনে রেখেই দেশের বিভিন্ন শহরে বসবাসকারী মানুষ নিজ নিজ কর্মস্থল থেকে এলাকায় আপনজনদের মাঝে ছুটে যান। তাই সড়কপথ, জলপথ ও রেলপথে প্রতি ঈদেই দেখা যায় বাড়তি জনস্রোত ও যানস্রোত। এই জনস্রোত ও যানস্রোত মাঝে মধ্যে এতটাই ব্যাপক ও বেসামাল হয়ে পড়ে যে তা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হয় ত্রিবিধ যাত্রাপথের নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তাদের। আমরা দেখি কিলোমিটারের পর কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট ঢাকার চারপাশে অবস্থিত বহির্মুখী সড়কগুলোতে। এর ওপর ঋতুগত কারণে বৃষ্টির যোগ থাকলে যানজটের দৈর্ঘ্য মেপে শেষ করারও উপায় থাকে না। এবারের ঈদকে সামনে রেখে বৃষ্টির পূর্বাভাষ অমূলক কিছু নয়। বিগত বছরগুলোর ঈদযাত্রার কথা মনে পড়লেই সেই যাত্রাপথের ভয়ঙ্কর ভোগান্তির কথাই সর্বাগ্রে মনে হয়। আর হয়ে পড়তে হয় বিষাদে ভারাক্রান্ত! অগণিত ছেলে-বুড়ো-নারী-শিশুর অবর্ণনীয় ভোগান্তি দেখে ঈদ আনন্দের কথা বিস্মরণ হওয়ার উপক্রম হয়।

যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী জননেত্রীকে আশ্বস্ত করে বলেছেন বিগত যে কোনো বছরের চেয়ে এবার সড়কের অবস্থা ভালো। আর এখন পর্যন্ত জনভোগান্তির তেমন কোনো খবর কোনো প্রান্ত থেকেই শোনা যায়নি। অবশ্য, সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী সপ্তাহ খানেক আগেই বলেছেন, এবারের ঈদযাত্রায় জনভোগান্তি আগের মতো হবে না। কিন্তু মন্ত্রীর কথা বিশ্বাস করতে পারলে সব পথের বিশেষত সড়ক পথের সব যাত্রী আশ্বস্ত হতে পারতেন। বরাবরের অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা বলা যায় যে, সাধারণ মানুষের ঈদযাত্রা ততটা নির্বিঘ্ন হওয়ার মতো সুযোগ এ দেশের কোনো প্রান্তেরই সড়কপথের নেই। এমনকি ঢাকা-ময়মনসিংহের যে সড়কের উদাহরণ সবাই দেখাতে চান সেখানেও কিন্তু যাত্রা নির্বিঘ্ন নয়। বিশেষত জয়দেবপুর চৌরাস্তার মোড় একেবারেই যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এছাড়া টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তার মোড় পর্যন্ত সড়কপথের অবস্থা অনেকটাই নাজুক। ঈদকে সামনে রেখে আবার দেশব্যাপী ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। এই মেরামত প্রকৃতপক্ষে জোড়াতালি ছাড়া কিছুই না।

সড়ক প্রশস্তকরণে আমরা সরকারের প্রচেষ্টাকে দৃশ্যমানই দেখছি এতে সন্দেহ করি না। কিন্তু সড়ক প্রশস্তকরণের এই প্রক্রিয়ার ধীরগতি যেন আরো বেশি পরিমাণে দৃশ্যমান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর বর্তমান সরকার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজ শুরু করেছিল। ঢিমেতালে সেই কাজ শেষ হয়েছিল, অতিশয় ধীরগতিতে শেষ হয়েছিল ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কও। বর্তমানে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কেও দেখছি উন্নয়ন কাজের মহাধীরগতি! উন্নয়ন কাজের ধীরগতির উল্টো দিকেই জড়িয়ে আছে জনভোগান্তি। বর্তমানে সাধারণভাবেই সব সড়কপথে জনভোগান্তি মাত্রাহীন। আর আনন্দের ঈদযাত্রাকে উপলক্ষ করে জনচাপ এবং যানচাপে সড়ক মহাসড়কগুলোতে নাজুক অবস্থার তৈরি হয়। নতুন-পুরনো এবং ফিটনেসবিহীন অসংখ্য গাড়িতে সড়কপথ সয়লাব হয়ে যায়। এসবের কোনোটি সড়কের ওপর সহসা বিকল হয়ে গেলে অতীতে দেখা গেছে মুহূর্তেই দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। সেই জট কাটিয়ে সড়কপথ পুনরায় স্বাভাবিক ও সক্রিয় করতে পুলিশ ও সংশ্লিষ্টদের হিমশিম খেতে হয়েছে। এবার কি তা থেকে যাত্রীদের মুক্তি মিলবে কী? আমরা সড়ক মহাসড়কের উন্নয়নে নিয়োজিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘প্রফেশনাল এটিচ্যুড’ যেমন প্রত্যাশা করি তেমনি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ‘প্রফেশনাল তদারকি’ও প্রত্যাশা করি। তীব্র যানজট ও অসহনীয় জনভোগান্তি কমাতে উভয়ের কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধনের বিকল্প নেই। রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন দ্রুত দৃশ্যমান করতে হলে উন্নয়ন কাজে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি না করে বরং সম্ভব স্বল্পতম সময়ে প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নই জনগণের কাম্য। তাতে কেবল ঈদযাত্রাই নয়- দেশব্যাপী জনগণের সব সময়ের ভোগান্তি লাঘব হয়।

সড়ক মহাসড়কের দীর্ঘদিনের ব্যাপক জনভোগান্তির চলমান অবস্থায় সদ্য প্রস্তাবিত বাজেটের মাধ্যমে সরকার যদি অন্তত ‘ভোটার তুষ্টির’ বাজেটও জনগণকে উপহার দিতে পারে সেটাই বা বেশি খারাপ হবে কেন? ব্যাপক জনতুষ্টি অর্জন সম্ভব হবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওপর উন্নয়ন কাজে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি আরো সক্রিয় করার মধ্য দিয়েও। সবার ঈদ আনন্দময় হোক- ঈদ মোবারক।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App