×

মুক্তচিন্তা

সুকুমারবৃত্তির উন্মেষ ও কুপ্রবৃত্তি অবদমনই রোজার শিক্ষা

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ মে ২০১৮, ০৮:৩৫ পিএম

সততা, ধৈর্য, আমানতদারী শোকর, ইনসাফ আদল প্রভৃতি সকল অনুপম চারিত্রিক গুণাবলীর বাস্তব নমুনা পাওয়া যায় মুত্তাকীর জীবন পরিক্রমায়। তাকওয়ার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ছয়টি। সত্যের সন্ধান, সত্য গ্রহণ, সত্যের ওপর সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা, আল্লাহভীতি, দায়িত্ব সচেতনতা, দায়িত্বানুভূতি ও আল্লাহ্ নির্দেশ পালন। আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাক্ওয়ার প্রভাব অপরিসীম।

আজ থেকে শুরু হচ্ছে মাহে রমজানের দ্বিতীয় পর্ব মাগফিরাতের দশক। এর আগে রহমতের দশ দশটি দিন আমরা পার করে এসেছি। মাগফিরাত তথা আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমার সওগাত নিয়ে আজ থেকে নতুন প্রত্যয়ে জেগে উঠবে রোজাদার মুমিন মুসলমানরা। এই মাগফিরাতের দশকে সিয়াম সাধনাসহ নানাবিধ ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে আমাদের আল্লাহ পাকের নৈকট্য অর্জনে নিবেদিত হতে হবে। রোজার একটি মুহূর্তও যেন হেলায়-অবহেলায় পার হয়ে না যায় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। আগামী বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকব কিংবা আগামী দিনের রোজাগুলো পাব এমন নিশ্চয়তা নেই। জীবন-মৃত্যু সবই আল্লাহ তায়ালার হাতে। এখানে মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা হাত নেই। কে কখন মারা যাবে এর কোনো আগাম সংবাদ কারো জানা নেই। তাই আজ রোজা পালনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের যে সুযোগ আমরা পাচ্ছি তাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে।

বছরের অন্য এগারো মাসের জীবনধারার সাথে রোজার দিনগুলোর কোনো তুলনা চলে না। এ মাসে রোজাদার মুসলমানরা নিজেদের স্বভাব-চিন্তাধারা ও কর্মকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা-সাধনা করে। রোজা হচ্ছে সারা বছর সাবধানী পথ চলার লক্ষ্যে ঐশী প্রশিক্ষণ। রোজা মানুষের মধ্যে তাক্ওয়ার গুণ সৃষ্টি করে। তাকওয়া মানে খোদাভীতি ও আত্মবোধের জাগৃতি। তাকওয়া মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ইহজীবন শান্তিময় করার এবং পারলৌকিক কল্যাণের মূল ভিত্তি হচ্ছে তাকওয়া। তাকওয়া অর্জনে ব্রতী হওয়া প্রতিটি মুসলমানের অপরিহার্য কর্তব্য। তাকওয়ার গুণ অর্জন করতে না পারলে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভ করা অসম্ভব। রোজার সঙ্গে রয়েছে তাকওয়ার নিবিড় যোগসূত্র। বান্দার মধ্যে তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে পবিত্র কুরআন পাকে বলা হয়েছে ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছিল। আশা করা যায় তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি হবে। (আল বাকারা : ১৮৩) এখানে বলা হচ্ছে ‘লা আল্লাকুম তাত্তাকুন’ অর্থাৎ ‘তোমরা যেন মুত্তাকী হতে পার’। তাই আমাদের জানা প্রয়োজন মুত্তাকী কারা, তাক্ওয়াই বা কী? মূলত তাকওয়া আরবি শব্দ। অর্থ ভয় করা, বিরত থাকা, বেছে চলা, আল্লাহ্ভীতি, আত্মশুদ্ধি ও অসৎ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রেখে কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক পরিশুদ্ধ জীবন পরিচালনার নামই তাকওয়া। প্রত্যেক কাজের জন্য সর্বদ্রষ্টা ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ কাছে জবাবদিহির অনুভূতিকে তাকওয়া বলে। হাদীস শরীফের আলোকে তাক্ওয়ার সংজ্ঞা হলো- আল্লাহ্র রাসূল (দ) যা করতে বলেছেন তা করা এবং যা করতে নিষেধ করেছেন তা বর্জন করা। হজরত ওমর (রা.)-এর মতে ইমান আক্বিদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক সব বৈরী পরিবেশকে পাশ কাটিয়ে স্বীয় মহৎ বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে জীবন যাপন করার নামই তাক্ওয়া (ইমাম গাজ্জালী কৃত ইয়াহ্ইয়া উলুমুদ্দীন)। হজরত ওমর বিন আব্দুল আযিয বলেছেন : দিনে রোজা রাখা অথবা রাতে জাগরণ থাকা অথবা উভয়ের আংশিক আমলের নাম তাকওয়া নয় বরং তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহ্ যা ফরজ করেছেন তা পালন করা এবং যা করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে দূরে থাকা।

একদা কোনো এক ব্যক্তি তাক্ওয়ার অর্থ জিজ্ঞেস করলে হজরত ওমর (রা.) বলেন: আপনি কি কখনো কণ্ঠকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করেছেন? বললেন ‘হ্যাঁ! আপনি তখন কী কী করেছিলেন? ‘আমি সাবধানতা অবলম্বন করে দ্রুতগতিতে ঐ পথ অতিক্রম করেছিলাম।’ বলা হচ্ছে এটাই হচ্ছে তাক্ওয়া। এভাবে সাবধানি পথ চলাই তাক্ওয়া। আর তাক্ওয়া সুসম্পন্ন ব্যক্তিকে মুত্তাকী বলে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে ‘যে ব্যক্তি মহান প্রভুর সামনে দাঁড়াতে ভীত সন্ত্রস্ত হয়েছে এবং নিজেকে প্রবৃত্তির কামনা থেকে বিরত রেখেছে তার জন্য রয়েছে জান্নাতে বাসস্থান।’ মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন ‘যে ব্যক্তি নিজেকে শিরক, কবিরা গুনাহ, অশ্লীল কাজকর্ম এবং কথাবার্তা থেকে নিজেকে বিরত রাখে তাকে মুত্তাকী বলা হয়। সততা, ধৈর্য, আমানতদারী শোকর, ইনসাফ আদল প্রভৃতি সকল অনুপম চারিত্রিক গুণাবলীর বাস্তব নমুনা পাওয়া যায় মুত্তাকীর জীবন পরিক্রমায়। তাকওয়ার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ছয়টি। সত্যের সন্ধান, সত্য গ্রহণ, সত্যের ওপর সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা, আল্লাহভীতি, দায়িত্ব সচেতনতা, দায়িত্বানুভূতি ও আল্লাহ্ নির্দেশ পালন। আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাক্ওয়ার প্রভাব অপরিসীম। আমাদের ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তাক্ওয়া না থাকার কারণে সমাজের সর্বস্তরে আজ দুর্নীতি সন্ত্রাস, সুদ-ঘুষ অরাজকতা, অনৈতিকতা ইত্যাদি শেকড় গেড়ে বসেছে। মানব চরিত্রের এ দুষ্টক্ষত থেকে বাঁচতে তাক্ওয়া তথা খোদাভীতির বিকল্প নেই। এটা আজ পরীক্ষিত সত্য। মানব সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী যাবতীয় অন্যায়, অসত্য, অনাচার, ধর্ম বিবর্জিত গর্হিত কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার প্রশিক্ষণ এ মাহে রমজান।

এই পবিত্র মহিমান্বিত মাসে ও দেখা যায় রোজাদারদের কেউ কেউ অযথা বেহুধা কাজে সময় নষ্ট করে। সারা রাত জেগে লুডু বা তাস খেলায় মেতে থাকে। রোজাদার কখনো এভাবে রোজার মুহ‚র্তগুলোকে হেলায়-খেলায় অতিবাহিত করতে পারে না। বরং অবসর সময়ে কুরআন মজিদ তেলাওয়াত, নফল নামাজ, তাহাজ্জুদ পড়ে রোজার দিনগুলো অতিবাহিত করলে এতে অশেষ পুণ্য অর্জিত হয়। আল্লাহ্র মেহেরবানী ও নৈকট্য পেতে হলে রোজার দিনগুলো ইবাদত-রিয়াজতে মগ্ন থাকতে হবে। ক্রীড়া-কৌতুকে না থেকে রোজার দিনগুলোকে ইবাদতের মধ্য দিয়ে সার্থক করে তুলতে হবে। রোজাদারদের বছরের শুধু একটি মাস সঠিক পথে থাকলে হবে না। রোজার শিক্ষাকে আত্মস্থ করে সারা বছর নিজেকে সংযত, সংযমী ও কর্তব্যনিষ্ঠ হয়ে চলতে হবে। বছরজুড়ে সাবধানী পথ চলার বাস্তব প্রশিক্ষণ মাহে রমজান। সুকুমারবৃত্তির উন্মেষ ও কুপ্রবৃত্তি অবদমনই রোজার শিক্ষা।

আ ব ম খোরশিদ আলম খান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App