×

মুক্তচিন্তা

সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে ব্রিটেনে রমজান

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ মে ২০১৮, ০৯:২২ পিএম

রমজান আসে যেন বিলাস হয়ে কতিপয় তথা ধনাঢ্য মানুষের। রমজান মাসকে উপলক্ষ করে ধনাঢ্যরা মেতে ওঠেন লোক দেখানো জাকাত প্রদানে। নিম্ন মূল্যের শাড়ি আর লুঙ্গি দিতে গিয়ে এরা প্রাণ নিয়ে নেন কিছু মানুষের। একদিকে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার আকুতি, বস্তিতে নিরন্ন মানুষ, অন্যদিকে ইফতার-সেহরির অর্ধশতাধিক বিলাসী আইটেম দিয়ে রমজানকে আসলে সম্মান দেখানো হয় না বরং এক ধরনের অপমান করা হয় ওই মানুষগুলোকেই।

ব্রিটেনের মোট জনগোষ্ঠীর ৩ শতাংশ মানুষ এবারে সূর্যোদয় থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাদের ধর্মীয় প্রথা কিংবা অবশ্যই করণীয় (ফরজ) রোজা পালন করছে। বলা হয়ে থাকে ব্রিটেনে প্রায় ২.৭ মিলিয়ন মুসলমানের আবাস। এই আড়াই মিলিয়নেরও অধিক মানুষই যেন এই সময়টাতে বদলে দেয় ব্রিটেনের অনেক শহরের চিত্র। মোট জনসংখ্যার মাত্র এক চতুর্থাংশ ব্রিটিশদের এই মাস সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকলেও মুসলিম কমিউনিটিতে এই সংযমের মাসটা আসে যেন উৎসবের উপলক্ষ হয়ে। রমজান কিংবা রামাদ্বান মূলত সংযমের মাস। কিন্তু সারা পৃথিবীতেই মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে এই মাসটাই যেন হয়ে ওঠে অধিক মাত্রায় খরচের একটা মাস হিসেবে। এক ধরনের সাজ সাজ রব আছে, বাড়তি খরচ, ইফতারের আয়োজনে মানুষের দোকানে দোকানে ঢুঁ মারা। ব্রিটেনের সুপার মার্কেটগুলোও যেন প্রতিযোগিতায় নামে। টেসকো, সেইন্সবারি, আসদা প্রভৃতি ব্যবসা কেন্দ্রগুলোতে হালাল ফুডের প্রদর্শনী ও বিক্রি বেড়ে যায়। এমনকি স্থানীয় কামউনিটি চ্যানেল থেকে শুরু করে মূলধারার গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন পর্যন্ত প্রদর্শিত হয়।

রমজান সংযমের মাস অথচ এই মাসেই ব্যয় বৃদ্ধি হয় মুসলমানদের। শুনেছি বাংলাদশে নাকি গত ক’টা বছর থেকে ইফতার পার্টির আদলে আরেক রূপ ধারণ করেছে সেহরি পার্টি। বিলাস আর ব্যয়ের খাতায় লেখা এই সেহরি পার্টি। ধনাঢ্য মানুষের এক বিলাস এই সেহরি। বলতেই হয় রমজান আসে যেন বিলাস হয়ে কতিপয় তথা ধনাঢ্য মানুষের। রমজান মাসকে উপলক্ষ করে ধনাঢ্যরা মেতে ওঠেন লোক দেখানো জাকাত প্রদানে। নিম্ন মূল্যের শাড়ি আর লুঙ্গি দিতে গিয়ে এরা প্রাণ নিয়ে নেন কিছু মানুষের। একদিকে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার আকুতি, বস্তিতে নিরন্ন মানুষ, অন্যদিকে ইফতার-সেহরির অর্ধশতাধিক বিলাসী আইটেম দিয়ে রমজানকে আসলে সম্মান দেখানো হয় না বরং এক ধরনের অপমান করা হয় ওই মানুষগুলোকেই। অথচ এরাই দেশের অধিকাংশ মানুষ। ব্রিটেনে অবশ্য এরকম পার্টি এখনো সংস্কৃতিতে রূপ নেয়নি। ইফতারের তোড়জোড় আছে। বিলাসী ইফতারে ছেয়ে যায় সভা-সমাবেশ। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা সামাজিক সংগঠনগুলোর জন্য এ এক উপলক্ষ, বন্ধু-সজ্জনদের নিয়ে আড্ডা দেয়ার এক মোক্ষম সুযোগ।

মুসলিম পরিবারগুলো তাদের রমজান খরচে বাড়িয়েছে বাজেট। যেন এ এক অবধারিত বাড়তি ব্যয়বৃদ্ধি। রমজানের শুরুতে ব্রিটেনের স্কাই টিভি চ্যানেল এ নিয়ে এক রিপোর্ট করে। সেখানে দেখানো হয়েছে, কীভাবে ব্রিটেনের অর্থনীতি প্রভাবিত হয় রমজান মাসকে কেন্দ্র করে। আগেই উল্লেখ করেছি এ দেশের সুপার মার্কেটগুলো নতুনভাবে সাজায় তাদের সেল কিংবা মূল্যছাড়ের পদ্ধতি। অথচ মুসলিম নেতারা দাবি করছেন সুপার মার্কেটগুলো যদি এশিয়ান ‘ক্যাশ এন্ড ক্যারি’র মতো ডিসপ্লে রাখত কিংবা বিক্রির ব্যবস্থা করত, তাহলে শুধু এ মাসেই ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড অতিরিক্ত ব্যবসা করতে পারত সুপার স্টোরগুলো। রমজানকে কেন্দ্র করে অর্থ সংগ্রহেরও উৎসব শুরু হয় ব্রিটেনে। রাস্তায়, ট্রাফিক জ্যামে টিন কিংবা পট নিয়ে ভদ্র আর শালীন আহ্বান- সিরিয়া-রোহিঙ্গা প্রভৃতি শব্দ দিয়ে আবেগী সাহায্যের আকুতি। এ এক বিস্ময়। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখভালের জন্য বাংলাদেশের সরকার কোটি কোটি ডলার সহায়তা পাচ্ছে, দেশের প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের দেখাশোনা করতে জনগণের কাছে কোনো সহায়তা চাননি এবং সারা পৃথিবী জুড়েই বাংলাদেশ প্রশংসিত হয়েছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে, সেখানে একধরনের চ্যারিটি কর্মীরা হাজারো-লাখো পাউন্ডের চাঁদা সংগ্রহ করছে। দেখলাম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন ব্রিটিশ ব্যবসায়ীও অর্থ সংগ্রহ করেছেন এই ব্রিটেনে, তার প্রতিষ্ঠানে চ্যারিটি ডিনার করেছেন।

বাংলাদেশি-পাকিস্তানি টিভি চ্যানেলগুলোতে চলছে চাঁদা উত্তোলনের এক মহোৎসব। এই উৎসবগুলো শুরু হয় বিকেল পাঁচটা থেকে ভোর পর্যন্ত। একজন দু’তিনজন মানুষ নিয়ে বসে আখেরাতের পথ পরিক্রমা সুগম করতে চলে এই জনমের মানুষের প্রতি আহ্বান। যারা টিভি দেখে, তাদের অধিকাংশই মহিলা এবং সেজন্যই চটকদার শব্দ প্রয়োগ থাকে এসব চাঁদা সংগ্রহে। বেগানা পুরুষদের সঙ্গে মহিলাদের কথা বলতে নেই। অথচ হাসি আর খোশ গল্পের মধ্য দিয়ে মহিলাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেয়া চ্যারিটিবাজদের টার্গেট থাকে এই মহিলারাই। হাজার-লাখো পাউন্ডের লক্ষ্য নিয়ে এরা প্রতিদিন উপাসনালয়, এতিমখানা কিংবা আবেগ নাড়া দেয় ইস্যু সামনে এনেই প্রতিরাতের পরিকল্পনা করে থাকেন তারা। চ্যারিটি সংস্কৃতি চালু হয়েছে বহু বছর থেকে। এখন সেই আগের মতো সাড়া না থাকলেও এটা যে একটা সম্মানজনক এবং লাভজনক স্বেচ্ছাসেবা (!) তা বোঝা যায়, যখন দেখা যায় অন্তত দুটো বাংলা টিভি চ্যানেল শুধু চ্যারিটির জন্য অর্থ সংগ্রহই মূল লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। অল্পসংখ্যক লোকবল প্রয়োজন হলেও ব্রিটেনের একটা কমিউনিটি টিভি পরিচালনায় কম করে হলেও প্রায় অর্ধ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয় প্রতি মাসে। স্বাভাবিকভাবেই এ অর্থ সঙ্কুলান করতে হয় এই ফ্রি ভিউইং টিভি চ্যানেলগুলোর বাণিজ্যিক পরিকল্পনা দিয়েই। বাণিজ্যিক পরিকল্পনাতে অর্থ সংগ্রহের একটা অংশ অবশ্যই তারা তাদের টিভি পরিচালনায় ব্যয় করতেই পারেন ব্রিটেনের চ্যারিটি আইন অনুসারেই। তবে তারা যে খুবই সফল, তা হয়তো বলা যাবে না। কারণ কয়েক বছর আগে শুরু হওয়া এ সংস্কৃতিতে আগে অর্থ উঠার ধুম পড়ে যেত, উপস্থাপক হয়তো সময়ই পেতেন না ফোনে অর্থ দিতে উৎসাহী পুরুষ মহিলাদের সঙ্গে কথা বলার। এখন বড় বেশি কথা বলতে হয়। বড় বেশি হাদিস-কুরআন থেকে ধর্মের কথা বলতে হয়, সওয়াবের পথ বাতলে দিতে হয়। তবে রমজানের সার্থকতা হলো, এ মাসটাকে উপলক্ষ করে বাঙালি-পাকিস্তানি কমিউনিটিকে এ টিভি চ্যানেলগুলো অর্থ উত্তোলনকে ইসলামি সংস্কৃতির পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছে কর্তৃপক্ষ।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রামাদ্বান হলো মুসলমানদের একটা পবিত্র মাস। এই মাসই প্রতিনিধিত্ব করে নিজেকে আত্মশুদ্ধির, অন্তর্দর্শনের, মানবতার প্রতি তথা সারা পৃথিবীর অগণিত ক্ষুধার্ত-শোষিত মানুষের প্রতি সহমর্মিতা-সহযোগিতা প্রকাশের মাস হিসেবে। ক্ষুধা-নির্যাতন-যুদ্ধ উন্মাদনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এবং প্রত্যয়ী হওয়ার সময় এই মাসটাই হওয়া উচিত একজন মুসলমানের। সারা পৃথিবীর মানুষের মাঝে ধর্মের শান্তির বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য এই মাসটাই বেছে নিতে পারেন মুসলমানরা।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App