×

মুক্তচিন্তা

রাজনীতির হালচাল

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ২৬ মে ২০১৮, ০৯:৩৮ পিএম

বিএনপি শক্তিহীন হয়ে তারচেয়ে উগ্র ধর্মাশ্রয়ী কোনো রাজনৈতিক শক্তি মাথা তুলে দাঁড়ালে খুব ভালো হবে কি? বিএনপিকে শেষ করার চেষ্টা না করে বিএনপি যাতে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় রাজনীতি করে সে জন্য চাপ দেয়া দরকার। বিএনপিকেও এটা উপলব্ধি করতে হবে যে, কেন তারা জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বারবার কৌশলের খেলায় হেরে যায়।

চলতি হাওয়া

পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলেই এখন ‘ভেতরের’ খবর জানতে চান। এত এত সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল, টেলিভিশন চ্যানেলে প্রতিদিন কত খবর প্রচার হচ্ছে- অথচ এতে যেন অনেকেরই আশ মিটছে না। তারা আরো খবর জানতে চান, বিশেষ কিছু জানতে চান। তারা বুঝতে চান না যে বিশেষ খবর প্রতি মুহূর্তে তৈরি হয় না। বিশেষ কিছু ঘটলেই না বিশেষ খবর হবে। তবে যারা খবর জানতে অতি কৌতূহলী তারা আসলে খবর নয়, গুজব বা গসিপ শুনতে চান বলে আমার ধারণা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে সব খবর প্রচার হচ্ছে সেগুলোকে মনে করা হয় এগুলো বাহ্যত, ভেতরে অন্য কিছু আছে। না, আমার কাছেও কোনো গোপন খবর নেই। গোপন খবরে আমার বেশি আগ্রহও নেই। আমি বরং প্রকাশিত খবর থেকেই পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করি।

দেশের রাজনীতিতে আপাতত কোনো উত্তেজনা নেই। পবিত্র রমজান মাস চলছে। মানুষ রোজা-নামাজ-ইফতার নিয়ে ব্যস্ত আছে। ছোট-বড় নানা আয়োজনের ইফতার পার্টি হচ্ছে। বিএনপিও একাধিক ইফতার পার্টি করছে, হয়তো আরো করবে। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে। বিএনপির ইফতার পার্টিতে খালেদা জিয়ার জন্য একটি চেয়ার খালি রাখা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, খালেদা জিয়ার জন্য চেয়ার খালি রাখা হলে তারেক রহমানের জন্য কেন চেয়ার খালি রাখা হচ্ছে না? তারেক রহমান তো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনিও অনুপস্থিত। তার জন্য কি তাহলে দলের বর্তমান নেতৃত্ব কিছু করণীয় ঠিক করতে পারছে না? এই যে দেশের রাজনীতিতে কোনো বাড়তি উত্তাপ-উত্তেজনা নেই তাতে কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ খুশি। যে রাজনীতি জনদুর্ভোগের কারণ হয় সে রাজনীতি মানুষ পছন্দ করে না। মানুষের এই মনোভাব কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন বিএনপি নেতৃত্ব। তাই আন্দোলনের নামে সহিংসতার পথ পরিহার করে তারা এখন নতুন পথে হাঁটার কথা ভাবছেন।

বিএনপি দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল। এই দল একাধিকবার ক্ষমতায় ছিল। ভবিষ্যতেও এই দলের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সাংগঠনিকভাবে বিএনপি এখন ভঙ্গুর অবস্থায় থাকলেও এই দলের জনসমর্থন আছে। বিএনপির প্রতি মানুষ যে এখনো ঝুঁকে আছে, সেটা এই দলের রাজনীতির কারণে নয়। বিএনপির একটি সমর্থক গোষ্ঠী আছে। যারা একসময় মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন, যারা চিন্তা-চেতনায় কিছুটা সাম্প্রদায়িক, যারা আমাদের দেশের সব খারাপ কিছুর জন্য ভারতকে দায়ী করে সুখ পায় বা এক কথায় ভারতবিরোধী তারা রাজনৈতিকভাবে বিএনপির সমর্থক। এ ছাড়াও নানা কারণে যারা সরকার তথা আওয়ামী লীগের প্রতি ক্ষুব্ধ-বিরক্ত তারা যেহেতু প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করে থাকে সেহেতু তাদেরও বিএনপি সমর্থক বলেই ধরে নেয়া হয়।

গত কয়েক বছরে বিএনপি রাজনীতিতে এমন কিছু বড় দাগে ভুল করেছে, যার খেসারত এখন দলটিকে দিতে হচ্ছে। বিএনপি এখন সরকারি চাপে দিশাহারা। ক্ষমতায় যাওয়ার অস্থিরতা বিএনপিকে ক্রমাগত ভুল রাজনৈতিক কৌশলে প্ররোচিত করেছে। বিএনপির বড় সমস্যা হলো তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি চর্চায় অভ্যস্ত নয়। আওয়ামী লীগকে তারা ক্ষমতায় দেখতে চায় না, মানতে পারে না। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি সন্ত্রাসী দলের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে বিএনপি আন্দোলনের নামে দেশে যে সহিংসতা ও বর্বরতা চালিয়েছে, যেভাবে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে, গাড়ি পুড়িয়েছে, আরো নানা রকম ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড করে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে তা দলটিকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে চরম বিপর্যয়ের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।

বিএনপি এখন বলছে, সরকার তাদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না, মামলা-হামলায় দলটি মাঠে নামতে পারছে না। তারা ভয়ানক চাপের মধ্যে আছে। অভিযোগগুলো সব মিথ্যা না হলেও বিএনপির বক্তব্যের পক্ষে প্রবল জনমত গড়ে উঠছে না। কারণ মানুষ মনে করে, সরকারকে এমন শক্ত অবস্থানে যেতে বাধ্য করেছে বিএনপি। বিএনপি যদি আগুন সন্ত্রাসের পথে না যেত, নির্বাচন বর্জনের মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত না নিত, তাহলে সরকার দমনপীড়নের আশ্রয় নিয়ে সুবিধা করতে পারত না। এখন বিএনপিকে আসলে নতুন করে শুরু করতে হবে। বিএনপিতে অভিজ্ঞ নেতা আছেন, কিন্তু তারা দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভ‚মিকা রাখতে পারেন বলে মনে হয় না। নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতা বদলের নিয়মতান্ত্রিক আর কোনো পথ নেই। বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের পতন চায়। অথচ নির্বাচনে অংশ নিতে চায় না। সে জন্যই বিএনপির আন্দোলনের ডাকে মানুষ সাড়া দেয় না। আবার বিএনপি আন্দোলনের জন্য যে সব ইস্যু ঠিক করে সেগুলোও সাধারণ মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয়। তাই বিএনপি এখন কার্যত একটি আস্ফালনের পার্টিতে পরিণত হয়েছে। দেশের নিয়ন্ত্রণ এখন এককভাবে সরকার তথা আওয়ামী লীগের হাতে। সংসদীয় রাজনীতিতে দেশের একটি বড় দল যদি সংসদের বাইরে থাকে তাহলে সরকারি দলের বেপরোয়া হয়ে ওঠা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়। দুর্বল ও অকার্যকর বিরোধী দল গণতন্ত্র বিকাশের জন্যও সহায়ক হয় না। বিএনপির ভুল সিদ্ধান্ত শুধু যে তাদের দলের জন্য ক্ষতির কারণ হয়েছে তা নয়, এটা সামগ্রিকভাবে দেশের রাজনীতিকেই সংকটে ফেলেছে। খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলায় শাস্তি ও জেল, তার বিরুদ্ধে আরো অসংখ্য মামলা, জামিন পেলেও মুক্তি পাওয়া নিয়ে সংশয়- সব কিছু মিলিয়ে বিএনপির রাজনীতি এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। খালেদা জিয়া জেলে গেলে তার প্রতি মানুষের সহানুভ‚তি বাড়বে, সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে, দেশে প্রবল আন্দোলন গড়ে উঠবে, বিদেশিরা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে- এ সব ছিল বিএনপি নেতাদের বিশ্বাস কিংবা ধারণা। কিন্তু সে সবের কিছুই হয়নি। না মানুষকে আন্দোলনমুখী করা যাচ্ছে, না বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়ে কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে! বিএনপির অবস্থা এখন না-ঘরকা, না-ঘাটকা।

শোনা যাচ্ছে, ঈদের পর বিএনপি মাঠে নামার কৌশল খুঁজছে। শুধু খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সীমাবদ্ধ না থেকে জনগণের দাবি নিয়ে আন্দোলনের পরিকল্পনা নাকি বিএনপি করছে। বিএনপির ‘ঈদের পরের আন্দোলন’ নিয়েও মানুষের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা দেবে বলে মনে হয় না। কারণ অতীতে বহুবার বিএনপি ‘ঈদের পর আন্দোলন’ করার কথা বলেছে। ঈদের পর ঈদ গেছে বিএনপির আন্দোলনের দেখা পাওয়া যায়নি। অতীতে এত ব্যর্থ হুমকি দেয়া হয়েছে যে সরকারেরও তা গা-সওয়া হয়ে গেছে। আন্দোলন বিএনপি করেছে, হরতাল, অবরোধসহ কিছুই বাদ দেয়নি, কিন্তু তাতে সরকার বা আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়নি, উল্টো বিএনপি কোণঠাসা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপিকে নিয়ে এখন ঠাট্টা-মশকারা করেন। বলে থাকেন যে বিএনপি এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে মিডিয়ার কল্যাণে। অর্থাৎ বিএনপিকে টিকিয়ে রেখেছে গণমাধ্যম। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্য আওয়ামী লীগ নেতাদের এই ধারণার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন বলে মনে হয় না। বিএনপিকে শুধু মিডিয়া টিকিয়ে রাখেনি, সরকার তথা আওয়ামী লীগও টিকিয়ে রেখেছে। সরকার যদি ভুল না করে, জনগণের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ না করে তাহলেই কেবল বিএনপি দুর্বল হতে পারে। কিন্তু সরকার তো মানুষের মনে বিরূপতা তৈরি হওয়ার মতো কাজ থেকে বিরত হচ্ছে না।

বিএনপি একেবারে অস্তিত্বহীন হবে বলে যারা মনে করেন তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতা এবং জনমানসের মনস্তত্ত¡ সম্পর্কে খুব একটা ধারণা রাখেন না। বিএনপি শক্তিহীন হয়ে তারচেয়ে উগ্র ধর্মাশ্রয়ী কোনো রাজনৈতিক শক্তি মাথা তুলে দাঁড়ালে খুব ভালো হবে কি? বিএনপিকে শেষ করার চেষ্টা না করে বিএনপি যাতে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় রাজনীতি করে সে জন্য চাপ দেয়া দরকার। বিএনপিকেও এটা উপলব্ধি করতে হবে যে, কেন তারা জনসমর্থন থাকা সত্তে¡ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বারবার কৌশলের খেলায় হেরে যায়।

বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে হুমকি-ধমকির রাজনীতি বাদ দিতে হবে। যে কোনো উপায়ে সরকার পতনের খোয়াব দেখা বন্ধ করতে হবে। কোনো অজুহাতেই নির্বাচন থেকে দূরে থাকা যাবে না। খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচন নয়- এ রকম কথা বিএনপি নেতারা যত বলবেন তত তাদের ঝুঁকি বাড়বে। তারা নির্বাচনে না এলে সরকারের কোনো ক্ষতি নেই। যেসব রাজনৈতিক পণ্ডিত মনে করেন, আর একটি বিতর্কিত নির্বাচন সরকার করবে না অথবা সে রকম নির্বাচন করে ক্ষমতায় এলে আন্তর্জাতিকভাবে সরকার চাপে পড়বে- তারা ভুল অবস্থানে আছেন। সরকার আরেক দফা ক্ষমতায় যেতে বা থাকতে চায়। সে জন্য যা যা করা দরকার তার সবই করবে সরকার। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অত্যন্ত স্পষ্ট করেই বলছেন, বিএনপির জন্য নির্বাচনী ট্রেন লেট করবে না। বিএনপি না এলেও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার স্বার্থে দেশে যথাসময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

বিএনপিকে এখনই নির্বাচন সম্পর্কে দলের ভাবনা স্পষ্ট করতে হবে। কিছু ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়া আদায় করার জন্য বিএনপিকে রাস্তায় নামতে হলেও তা যেন সহিংস না হয়। বিএনপি যদি সংঘাতের রাজনীতি পরিহার করতে পারে তাহলে, নির্বাচনের ফলাফল কি হবে সেটা নিয়ে অহেতুক দুর্ভাবনায় কালক্ষয় না করে যে কোনো পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয় তাহলে রাজনীতিতে তারা সুফল পেলেও পেতে পারে।

আবার সরকারকেও প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভাবার অহমিকা ত্যাগ করে এটা মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের রাজনীতির হাওয়া কোন ঘটনায় কীভাবে গরম হয়ে ওঠে তা আগে থেকে আন্দাজ করা যায় না। আজকের পরিস্থিতি সব সময় থাকবে না। পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হলে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে এই নীতিবাক্য : নিজে যারে বড় বলে বড় সে নয়/লোকে যারে বড় বলে বড় সে হয়।

বিভুরঞ্জন সরকার : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App